বাংলাদেশে প্রতি বছর মোট মৃত্যুর ৭০ শতাংশই হয় অসংক্রামক রোগের কারণে। এই রোগগুলোর মধ্যে ক্যান্সার একটি। কিন্তু দেশে এর ব্যাপকতা কতটা, তার কোনও সঠিক পরিসংখ্যান নেই। আনুমানিক তথ্য ধরে চলার প্রক্রিয়াটি এই রোগ ব্যবস্থাপনার গলদ থাকার ঝুঁকি তৈরি করছে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত।
ক্যান্সার প্রতিরোধে সচেতনতা তৈরিতে প্রতি বছর ৪ ফেব্রুয়ারি পালন হয় ‘বিশ্ব ক্যান্সার দিবস’। বাংলাদেশেও সরকারি-বেসরকারি নানা কর্মসূচি থাকে দিনটি িঘরে।
কত মানুষ ক্যান্সারে নতুন করে আক্রান্ত হয়েছে কিংবা বছরে কতজনের মৃত্যু হয়েছে, তা দিনটিতে জানানো হয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে।
গত বছর জানানো হয়েছিল, বছরে আনুমানিক ২ লাখ মানুষ নতুন করে ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে, আনুমানিক মৃত্যু হয় এক লাখ মানুষের। সে হিসেবে প্রতিদিন ক্যান্সারে হারিয়ে যায় ২৭৩ জন।
তাহলে দেশে ক্যান্সারের রোগী কত, তার হদিস পেতে যোগাযোগ করা হলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, এতদিন তারা হিসাবটি রাখেননি, এক বছর হলো কাজটি শুরু করেছেন।
“গত বছর থেকে আমরা ক্যান্সার রেজিস্ট্রি করা শুরু করেছি। তবে সেটা দিয়েও পুরো দেশের সব জায়গায় পৌঁছানো যাবে না।”
প্রতি বছর যে নতুন রোগীর সংখ্যা বলা হয়, তাও ধারণাপ্রসূত বলে জানলেন বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. গোলাম মহিউদ্দিন ফারুক।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “যত রোগী আসলে হাসপাতালে চিকিৎসা নেন, চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারে চিকিৎসা নেন এবং আমাদের বিভিন্ন ক্যান্সার সোসাইটির তালিকাভুক্ত যত রোগী রোগী আছেন, তার বাইরেও রোগী রয়েছে।”
গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক ক্যান্সার হাসপাতালের প্রকল্প সমন্বয়কারী অধ্যাপক ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিনেরও একই মত।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “দেশের অনেক রোগী সরকারি তালিকার বাইরে রয়েছেন। আবার অনেকেই আছেন, যারা কেবল একবার হাসপাতালে এসেছেন, পরের বার হয়ত আসেননি। যারা পরীক্ষা করিয়ে নিশ্চিত হননি, তারাও এই তালিকার বাইরে।
“আবার অনেকেই হয়ত বেসরকারিভাবে শনাক্ত হওয়ার পর চলে যান দেশের বাইরে। এভাবে মোট রোগীর মাত্র ২০ শতাংশ হয়ত হিসেবের মধ্যে আসে, ৮০ শতাংশই থেকে যাচ্ছে বাইরে।”
রোগীর সংখ্যার হিসাব না থাকাকে পরিকল্পনা প্রণয়নের ক্ষেত্রে অন্তরায় হিসেবে চিহ্নিত করছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হেমাটোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. অখিল রঞ্জন বিশ্বাস।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আপনি যদি সঠিক সংখ্যা না জানেন, তাহলে কীসের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেবেন? কী করে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করবেন?
“আমাদের কোনও এক্সটেনসিভ সোর্স নেই। পুরো স্বাস্থ্য বিভাগই এসব ক্রনিক ডিজিজ নিয়ে সংখ্যার দোলাচলে ভোগে। স্বাস্থ্যে তথ্য ব্যবস্থাপনা জটিল, কঠিন। হ য ব র ল অবস্থা।”
কোন ক্যান্সারের রোগী বেশি
দেশের ক্যান্সার বিশেষায়িত একমাত্র হাসপাতাল জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল দুই বছর আগে জানিয়েছিল, দেশে আট বিভাগের মধ্যে ঢাকা বিভাগে ক্যান্সার রোগী বেশি এবং তাদের মধ্যে বেশিরভাগই ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত।
আগের তিন বছরে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নেওয়া রোগীদের মধ্যে গড়ে ৩৩ শতাংশের বেশি ঢাকা এবং আশেপাশের এলাকার। এরপর ছিল চট্টগ্রাম বিভাগ, সে বিভাগের ছিল ২২ শতাংশ রোগী। এরপরের অবস্থানে যথাক্রমে বরিশাল, ময়মনসিংহ, খুলনা, রাজশাহী, রংপুর ও সিলেট।
সে হিসাব জানায়, আগের তিন বছরে সবচেয়ে বেশি মানুষ আক্রান্ত ছিল ফুসফুসের ক্যান্সারে, প্রায় ১৭ দশমিক চার শতাংশ। আর এতে বেশি আক্রান্ত ছিলেন পুরুষরা। মোট ৬ হাজার ২২৭ জনের মধ্যে ৫ হাজার ২০০ জন পুরুষ, ১ হাজার ২৭ জন নারী।
তবে এবারে আবার তার চিত্র ভিন্ন বলে জানাচ্ছেন বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক মহিউদ্দিন ফারুক।
তিনি বলেন, “গত কয়েক বছর আগে ফুসফুস ক্যান্সারের রোগী বেশি পাওয়া গেলেও গত দুই বছর যাবত বেশি রোগী পাওয়া যাচ্ছে হেডনেক ক্যান্সারের। এই ক্যান্সারের মধ্যেও রয়েছে আবার বিভিন্ন ভাগ। এর মধ্যে রয়েছে কণ্ঠনালী, মুখগহ্বর, তালুর ক্যান্সার, স্বরনালী ক্যান্সার, খাদ্য নালীর ক্যান্সার।”
আবার নারীদের মধ্যে কয়েকবছর আগে জরায়ুমুখ ক্যান্সারের রোগী বেশি পাওয়া গেলেও এখন এক নম্বরে স্তন ক্যান্সার। বর্তমানে শনাক্ত রোগীদের ২২ থেকে ২৫ শতাংশ ভুগছেন স্তন ক্যান্সারে, জরায়ুমুখ ক্যান্সারে ভুগছেন ২০ থেকে ২২ শতাংশ।
আবার তরুণ রোগীদের মধ্যে বর্তমানে বেশি ভুগছেন কোলন ক্যান্সারে। শিশুদের ভেতরে বেশি ব্লাড ক্যান্সারের রোগী।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে কোনও তামাক ক্যান্সারের প্রধান কারণ।
পুরুষদের ক্ষেত্রে ধোঁয়াযুক্ত এবং ধোঁয়াবিহীন দুই ধরনের তামাকই ক্যান্সারের মূল কারণ। ধোঁয়াবিহীন তামাকের মধ্যে রয়েছে জর্দা, সাদাপাতা, গুল। সেইসঙ্গে রয়েছে বিভিন্ন দূষণ।
অধ্যাপক মহিউদ্দিন ফারুক বলেন, “বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ধূমপানকে ফুসফুস ক্যান্সারের প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ডব্লিউএইচও বলছে, তামাক ব্যবহার পরিহারসহ অন্যান্য কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে ক্যানসারে মৃত্যু ঝুঁকি ৩০ শতাংশ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত প্রতিরোধ করা সম্ভব।”
বায়ূদূষণ, পরিবেশ দূষণের কারণেও এখন ক্যান্সার হচ্ছে অনেক বেশি।
অধ্যাপক মহিউদ্দিন ফারুক বলেন, “গাড়ির কালো ধোঁয়া অর্থাৎ কার্বন মনো অক্সাইড, ইটের ভাটা স্কিন ক্যান্সার-ফুসফুস ক্যান্সারের অন্যতম প্রধান কারন। সেইসঙ্গে খাদ্যাভাসও এখন যোগ হয়েছে তালিকায়।”
নারীদের ক্ষেত্রে দেরিতে বিয়ে, দেরিতে সন্তান ধারণ, সন্তানকে বুকের দুধ না খাওয়ানো স্তন ক্যান্সারের কারণ বলে চিহ্নিত করছেন এই চিকিৎসক।
এদিকে যত রোগী আছে, তাদের জন্য চিকিৎসা ব্যবস্থাও অত্যন্ত ‘দুর্বল ও রুগ্ণ’ বলে মন্তব্য করেন ক্যান্সার সোসাইটির সভাপতি।
তিনি বলেন, “বিভিন্ন ক্যান্সার হাসপাতালে যন্ত্রপাতি পড়ে রয়েছে, রেডিওথেরাপি মেশিন নষ্ট বছরের পর বছর ধরে। কোথাও এমন মেশিনও রয়েছে, যার প্যাকেটই খোলা হয়নি, জায়গা না থাকায় মেশিন বসানো সম্ভব হয়নি। সেজন্য মেশিন নষ্ট হয়েছে-এমন উদাহরণ দেশজুড়েই। আবার চিকিৎসক আছেন, কিন্তু তাদের সঠিক পদায়ন নেই।
“বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটিসহ যারা এসব রোগীদের নিয়ে কাজ করছে, সরকার তাদেরও সহযোগিতা করছে না।”
বেসরকারিভাবে চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকলেও তা বেশিরভাগ মানুষের নাগালের বাইরে থাকার বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, “সরকারিভাবে যদি চিকিৎসা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো যেত, তাহলে দেশের দরিদ্র মানুষ চিকিৎসা পেত।”