কান চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা সিনেমা হিসেবে ‘স্বর্ণ পাম’ পুরস্কার জিতেছে মার্কিন নির্মাতা শন বেকার পরিচালিত ‘আনোরা’। দ্বিতীয় সেরার পুরস্কার হিসেবে পরিচিত ‘গ্র্যান্ড পি’ জিতে ইতিহাস গড়েছে ভারতীয় পরিচালক পায়েল কাপাডিয়ার ‘অল উই ইমাজিন অ্যাজ লাইট’ সিনেমাটি।
শনিবার রাতে কান চলচ্চিত্র উৎসবের মূল ভেন্যু পালে দে কান ভবনের গ্র্যান্ড থিয়েটার লুমিয়েরে চলে জমকালো পুরস্কার বিতরণী ও সমাপনী অনুষ্ঠান।
আগে থেকেই এবারের উৎসবে আসা সিনেমাগুলোকে আগের বছরগুলোর তুলনায় ‘দুর্বল’ ও ‘ম্যাড়মেড়ে’ বলে চলচ্চিত্রবোদ্ধারা মন্তব্য করে আসছিলেন। রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধ, বিনোদন জগতে মিটু আন্দোলন, কোভিড এবং গেল কয়েক বছর ধরে চলচ্চিত্রকর্মীদের মজুরি সংক্রান্ত আন্দোলনের ঘটনার রেশ এবারের আসরেও থাকবে- তা অবশ্য শুরু থেকেই বোঝা যাচ্ছিল।
তারপরও চূড়ান্ত প্রতিযোগিতা বিভাগে অন্তত ৭টি সিনেমার মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পূর্বাভাসও পাওয়া যাচ্ছিল।
পুরস্কার পাওয়া দুইটি সিনেমা ছাড়া লড়াইয়ে থাকা বাকি পাঁচটি হলো- ইরানি নির্মাতা মোহাম্মদ রাসুলফের ‘দ্য সিড অব দ্য স্যাক্রেড ফিগ’, ফরাসি নির্মাতা জ্যাক ওদিয়ার ‘এমিলিয়া পেরেজ’, নির্বাসিত রাশান নির্মাতা কিরিল সেরব্রেনিকভের ‘লিমোনোভ: দ্য ব্যালাড’ এবং চীনা নির্মাতা জিয়া জানকি পরিচালিত ‘কট বাই দ্য টাইডস’।
এরমধ্যে ‘এমিলিয়া পেরেজ’ সিনেমাটি জিতেছে জুরি পুরস্কার এবং রাসুলফের ‘দ্য সিড অব দ্য স্যাক্রেড ফিগ’ জিতেছে বিশেষ পুরস্কার।
অনেকেই মনে করছিলেন ‘দ্য সাবস্ট্যান্স’ সিনেমায় দুর্দান্ত অভিনয়ের জন্য এবারের সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কারটি হয়তো ডেমি মুরই পাবেন। তবে ইতিহাস গড়ে এ পুরস্কারটি যৌথভাবে জিতে নিয়েছেন ‘এমিলিয়া পেরেজ’ সিনেমার তিন অভিনেত্রী সেলিনা গোমেজ, জো সালডানা এবং স্প্যানিশ ট্রান্সজেন্ডার অভিনয়শিল্পী কার্লা সোফিয়া গ্যাসকোন।
ট্রান্সজেন্ডার কারও জন্য এটাই প্রথমবারের মতো কান চলচ্চিত্র ইতিহাসে সেরার পুরস্কার অর্জন ছিল।
পরিচালক ইয়র্গোস ল্যান্থিমোসের ‘কাইন্ডস অব কাইন্ডনেস’- এর জন্য জেসি প্লেমন্সকে সেরা অভিনেতার সম্মাননা দেওয়া হয়েছে । ছবিতে, তিনটি গল্প বলা হয়েছে মূলত একই অভিনেতাদের অভিনয় করিয়ে। গল্প তিনটি আবার একে-অপরের সঙ্গে সংযুক্ত্।
কেন ‘আনোরা’ সেরা চলচ্চিত্র?
‘আনোরা’-র নির্মাতা শন বেকার তার এ চলচ্চিত্রটির গল্প বলতে বেছে নিয়েছেন কমেডি ঘরানাকে। কিছু লেখক-পরিচালক সুপারহিরো বা ফ্যান্টাসি চলচ্চিত্রের জন্য বিশেষজ্ঞ। কেউ হয়তো কাউবয়, সাইফাই বা হরর সিনেমা করার জন্য। শন বেকার যৌনব্যবসায়ী ও যৌনকর্মীদের নিয়ে চলচ্চিত্রে পটু। এ জগতের আবেগ, হাস্যরস, সংশ্লিষ্ট মানুষগুলোর অনুভূতি বেকার যেন অনায়াস ভঙ্গিতে তুলে ধরতে পারেন তার পরিচালিত সিনেমায়। তাই তার নির্মিত ট্যাঙ্গারিন (২০১৫), দ্য ফ্লোরিডা প্রজেক্ট (২০১৭) এবং রেড রকেট (২০২১) ইতিমধ্যেই একটি বিশেষ শ্রেণির দর্শক তৈরি করেছে, যারা তার কাজকে ভালোবাসেন।
বেকারের পরিচালিত আগের সিনেমাগুলো বক্স অফিসে ঝড় তুলতে না পারলেও দর্শকের মন জয় করেছে। এবারের সিনেমা ‘আনোরা’ সম্ভবত বক্স অফিসেও সাড়া ফেলবে বলে মনে করছেন সিনেমার বাজার বিশেষজ্ঞরা।
আর কিছু না হোক ‘আনোরা’ চলচ্চিত্রের মূল চরিত্র- যৌনকর্মী ও স্ট্রিপারের ভূমিকায় অভিনয়কারী মাইকি ম্যাডিসন যে একজন তারকা অভিনেত্রী হিসেবে নিজেকে আরও এক ধাপ উপরে নিয়ে যাবেন তা সন্দেহাতীত।
মাইকি ম্যাডিসন যদিও এর আগে ‘ওয়ান্স আপন আ টাইম ইন হলিউড ২০১৯) এবং রিবুটেড স্ক্রিম (২০২২) এ ক্যামেরার সামনে উপস্থিত হয়েছেন।
কিন্তু ‘আনোরা’ সিনেমায় তিনি উপস্থাপিত হয়েছেন শক্তিমান অ্যানি চরিত্রে, যেটি সিনেমাটির মূল উপজীব্যকে এগিয়ে নিয়ে যায়।
ব্রুকলিনের একজন বিশোর্ধ্ব ‘স্ট্রিপার’ ও যৌনকর্মী অ্যানি। চটপটে অ্যানির পাক্কা নিউ ইয়র্কারদের মতো উচ্চারণ। কথার পিঠে কথা বলতে, খোঁচা ও খুনসুঁটিতে বিশেষ পটু সে। আবার আত্মবিশ্বাসীও। তাই সুন্দর চেহারায় কেবল নয়, বরং মানুষ তার ব্যক্তিত্ব ও সাহচর্যের বেশি আকর্ষণ বোধ করে। এই অ্যানি ঝোঁকের মাথায় বিয়ে করে ফেলে এক রাশিয়ান সামন্তপ্রভুর ছেলেকে এবং তারপর সেই দেশে যায়। সিনেমার কাহিনীর সঙ্গে সঙ্গে এগোয় যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার সংস্কৃতির মিল-অমিল। যৌনকর্মীর মনোজগত এবং সাধারণ মানুষের তাদের সম্পর্কে ধারণা এবং অর্থ ও যৌনতার বৈশ্বিক বিনিময়তা উঠে আসে বিদ্রুপের ছলে।
বেকারের আগে আমেরিকান নির্মাতা টেরেন্স মল্লিকের ‘ট্রি অব লাইফ’ সিনেমাটি ২০১১ সালে স্বর্ণ পাম জিতেছিল।
পুরস্কার গ্রহণ করতে এসে পরিচালক বেকার বলেন, তার সবচেয়ে বড় উচ্চাকাঙ্ক্ষা হলো সিনেমাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য লড়াই করে যাওয়া। তিনি বলেন, “ফোনের মাধ্যমে স্ক্রল করতে করতে বাড়িতে একটি ফিল্ম দেখা, ই-মেইলের উত্তর দেওয়া এবং অর্ধেক মনোযোগ দিয়ে সিনেমা দেখা কোনওভাবেই সঠিক উপায় নয়, যদিও কিছু প্রযুক্তি সংস্থা আমাদের এটি গেলাতে চায়।”
সিনেমা বাঁচাতে হলে যেখান থেকে এর শুরু অর্থাৎ থিয়েটার হলের কোনও বিকল্প নেই বলে বেকার মন্তব্য করেন।
গ্রেটা গারউইগের নেতৃত্বে নয়-সদস্যের জুরি বোর্ড ‘আনোরা’-কে সেরা সিনেমা হিসেবে বাছাই করার বেশ কিছু কারণও রয়েছে। গ্রেটা গারউইগ মঞ্চে তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “আনোরা এমন একটা সিনেমা যেটি দেখার সময় হাসতে হাসতে বুকের দম বন্ধ হয়ে যায়, আবার পর মুহূর্তেই সেখান থেকে গভীর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।”
গারউইগ ‘আনোরা’কে ক্লাসিক সিনেমার কাতারে ফেলে প্রশংসা করেন, “এটি একটি আর্নস্ট লুবিটস বা হাওয়ার্ড হকস এর নির্মিত চলচ্চিত্রের মতো লেগেছে, যার কাহিনীর মোড় অপ্রত্যাশিত বাঁক-বদলের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে।”
ভারতীয় সিনেমার জয়রথ
২৩শে মে কানে অনুষ্ঠিত হয় ‘অল উই ইমাজিন অ্যাজ লাইট’ সিনেমাটির প্রিমিয়ার শো। ছবি শেষ হওয়ার পর আট মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে দর্শকরা করতালি দিয়ে অভিনন্দন জানান পরিচালক পায়েল কাপাডিয়া ও তার সিনেমার কলাকুশলীদের।
পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে এই সিনেমার মধ্য দিয়েই আত্মপ্রকাশ করেছেন পায়েল। শুরুতেই বাজিমাত করলেন। ইন্দো-ফরাসি প্রযোজনায় তৈরি এই ছবির মূল চরিত্র নার্স প্রভা। এ চরিত্রে অভিনয় করেছেন কানি কুশ্রুতি। এতে তার রুম মেট এবং আরেকজন নার্স ‘আনু’র চরিত্রে অভিনয় করেছেন দিব্যা প্রভা। ছায়া কদম অভিনয় করেছেন পার্বতী চরিত্রে, যিনি হাসপাতালের রান্নার কাজে জড়িত এবং বিধবা।
সিনেমাটি শুরু হয় প্রভার কাছে তার স্বামীর পাঠানো জার্মানি থেকে আসা একটি ‘সারপ্রাইজ গিফট’- হাই-টেক রাইস কুকার নিয়ে। এমনিতে তাদের মধ্যে যোগাযোগ ছিলই না। হঠাৎ এই উপহার প্রভার মনোজগতে ভিন্ন আলোড়ন তৈরি করে। ওদিকে অপর নার্স চরিত্র আনু প্রেমে পড়ে এক মুসলিম ছেলের। হিন্দু-মুসলিম প্রেম, তার ওপর আবার ভিড়-ভাট্টার মুম্বাই শহরে একটু যৌন মিলনের জন্য জায়গা খুঁজে পাওয়া নিয়ে তার স্ট্রাগল।
আরেকজন পার্বতী, যাকে বাড়ি থেকে উৎখাত করা হচ্ছে এবং যার ফিরে যেতে হবে নিজের গ্রামে। ঢিলেঢালাভাবে এগোচ্ছে মনে হলেও, এ সিনেমার গাঁথুনিতে এক অদৃশ্য টানটান উত্তেজনা রয়েছে, যা কেবল অনুভব করা যায়।
কানে পরিচালক পায়েলের সাফল্যের ইতিহাস অবশ্য বহু পুরোনো। এর আগে ‘আ নাইট অফ নোয়িং নাথিং’ নামে একটি ডকুমেন্টারির জন্য কান চলচ্চিত্র উৎসবে গোল্ডেন আই পুরস্কার জিতেছিলেন পায়েল।
অন্যান্য পুরস্কার কারা পেলেন
পর্তুগিজ লেখক ও পরিচালক মিগুয়াল গোমেজ তার ‘গ্র্যান্ড ট্যুর’ সিনেমার জন্য এ বছর কান উৎসবে পেয়েছেন সেরা পরিচালকের সম্মান। ১৯১৭ সালের প্রেক্ষাপটে তৈরি ‘গ্রান্ড ট্যুরে’ দেখানো হয়, বার্মায় কর্মরত এক ব্রিটিশ কর্মকর্তা তার প্রেমিকাকে বিয়ে করার ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন এবং মনোকষ্টে ভুগছেন। তার প্রেমিকা মলিও তাকে ছাড় দিতে নারাজ। পিছু নেয় ওই ব্রিটিশ যুবকের।
সাজা মাথায় নিয়ে ইরান থেকে পায়ে হেঁটে পালিয়ে এসে কানে অংশ পরিচালক মোহাম্মদ রাসুলহফ পেয়েছেন বিশেষ সম্মাননা পুরস্কার। যদিও তার সিনেমাটিও ‘স্বর্ণ পাম’ এর বলিষ্ঠ দাবিদার ছিল।
ফরাসি সিনেমা ‘দ্য সাবস্ট্যান্স’ এর স্ক্রিপ্টও লিখেছেন নির্মাতা কোরালি ফারজা। তিনিই পেয়েছেন সেরা স্ক্রিন প্লে রাইটারের পুরস্কারটি।
স্বল্প দৈর্ঘ্য ক্যাটাগরিতে ‘স্বর্ণ পাম’ পুরস্কার পেয়েছে দুইটি চলচ্চিত্র। এর একটি হচ্ছে, নেবুজা স্লিজেপসোভিচ পরিচালিত ‘দ্য ম্যান হু কুড নট রিমেইন সাইলেন্ট’।
এ সিনেমাটি ১৯৯৩ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারির একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে তৈরি। পটভূমি বসনিয়া। একটি প্যাসেঞ্জার ট্রেন থামায় একদল প্যারামিলিশিয়া। উদ্দেশ্য জাতিগত হত্যা। ৫০০ রেল যাত্রীকে তারা নানাভাবে গালিগালাজ ও শারিরীক নির্যাতন করতে থাকে। কেবল একজন ব্যক্তি ওই ঘটনার প্রতিবাদ করেন।
আরেকটি সিনেমা ড্যানিয়েল সোরেস পরিচালিত ‘ব্যাড ফর আ মোমেন্ট’ তৈরি হয়েছে একটি আর্কিটেক্ট ফার্মের মালিকের সঙ্গে তার নিম্নবিত্ত প্রতিবেশীদের দ্বন্দ্বের ওপর ভিত্তি করে।
কানকে চমকে দেওয়া বাঙালি অনুসূয়া
দিল্লীর একটি যৌনপল্লী থেকে এক পুলিশ অফিসারকে খুন পালিয়ে যায় রেনুকা। আশ্রয় নেয় উত্তর প্রদেশের আরেকদল যৌনকর্মীর সঙ্গে। সেখানে তার সঙ্গে পরিচয় ঘটে দেভিকা নামে এক তরুণীর সঙ্গে যে যৌনকর্মীর জীবন থেকে বের হতে চায়। তাদের মধ্যে সহমর্মিতা থেকে গড়ে ওঠে প্রেম ও সমকামিতার সম্পর্ক। তারা যৌনপল্লীর জীবন ও আইন থেকে পালাতে চায়।‘দ্য শেইমলেস’ সিনেমার কাহিনীটি এরকম।
কনস্টান্টিন বোজানভ পরিচালিত এ সিনেমাটিতে অভিনয় করে লাইম লাইটে চলে এসেছেন বাঙালি অভিনেত্রী অনুসূয়া সেনগুপ্ত। অথচ আশ্চর্যজনক হলেও অনুসূয়া পেশায় একজন প্রোডাকশন ডিজাইনার। যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজিতে স্নাতক অনুসূয়া কিছুদিন থিয়েটার করেছেন। আর অঞ্জন দত্ত পরিচালিত প্রায় দেড় দশক আগের সিনেমা ‘ম্যাডলি বাঙালি’-তে একটি পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন।
‘আ সার্তে রিগা’ হচ্ছে কানের সেই বিভাগ যেখানে সিনেমায় নতুন ট্রেন্ডকে উৎসাহিত করার জন্য পুরস্কৃত করা হয়। এ বিভাগেই অনুসূয়া জিতেছেন সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার।