Beta
মঙ্গলবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০২৪
Beta
মঙ্গলবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০২৪

হারিয়ে যায়নি কার্ডের আবেদন

ছবি: আজাদ প্রোডাক্টসের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া
ছবি: আজাদ প্রোডাক্টসের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া
[publishpress_authors_box]

স্মৃতিকাতর হয়ে অনেকেরই মনে পড়বে, ছোটবেলায় কাগজ কেটে রঙতুলি দিয়ে আঁকিবুকি করে ঈদের শুভেচ্ছা কার্ড বানিয়ে বন্ধুদের বিলি করার গল্প। পাড়ার স্টেশনারি দোকানে সারি সারি ঝুলিয়ে রাখা চকচকে জন্মদিনের কার্ডও কেনা হতো শখ করে। আবার ঈদের সময় টেবিল পেতে কিছু কার্ড নিয়ে বিকিকিনি করতো মৌসুমী ব্যবসায়ীরা।

শুভেচ্ছা কার্ড জাঁকজমক আর খানিক দামি হতে পারে তা শিখিয়েছিল বিদেশি ব্র্যান্ড আর্চিস আর হলমার্ক।   

আর জনপ্রিয় দেশি ব্র্যান্ড আজাদ প্রোডাক্টস দেশি-বিদেশি নায়ক-নায়িকাদের ভিউকার্ডের পাশাপাশি  ঈদ, জন্মদিন, ভ্যালেন্টাইনস ডে এবং বিয়ের নিমন্ত্রণ কার্ড দিয়েও রমরমা ব্যবসা করেছিল।     

ভ্যালেন্টাইন কার্ড যেভাবে এলো

মধ্যযুগে কাগজের টুকরা দিয়ে ভ্যালেন্টাইন কার্ড বানানো হতো। ছোট ছোট কাগজের স্তুপ করা হতো দুই সারি; এক স্তুপে প্রতিটি টুকরাতে লেখা হতো নারীর নাম; আর স্তুপের কাগজে পুরুষের নাম। তারপর মনের মানুষের নাম লেখা কাগজ তুলতে হতো স্তুপ থেকে।

ভ্যালেন্টাইনকে উপহার দেওয়াটা প্রথা ছিল তখন। ১৭ শতকে উপহারের বদলে ভালোবাসার কথা লেখার চল শুরু হলো। সবাই নিজের মনের কথাই লিখতো এবং হাতে লেখা হতো।

তারপর চলে এলো ভ্যালেন্টাইন লেখক পেশা। অর্থের বিনিময়ে প্রেমে টইটুম্বুর কথা লিখে দিতো এই লেখকরা। বলা চলে, তাদের দিয়েই বাণিজ্যিকভাবে ভ্যালেন্টাইন কার্ডের সূচনা হয়।    

ছাপাখানা চলে আসায় ১৮ শতকের ৫০ দশকের মাঝামাঝিতে বিপুল পরিমাণে ভ্যালেন্টাইন কার্ডের মুদ্রণ শুরু হলো। তাতে ঘরে বানানো হাতে লেখা কার্ডের আবেদন থাকলো না আর। ছাপানো ভ্যালেন্টাইন কার্ড তখন সাধ্যের বাইরেও ছিল না। কর্মজীবী শ্রেণির একজন বছরে একবার ভালোবাসার মানুষের কাছে কার্ড কিনে পাঠানোর বিলাসিতাটুকু সহজেই করতে পারতেন।   

এরপরের আধা শতাব্দী ধরে ভ্যালেন্টাইন কার্ডে শৈল্পিক ছাপ বসেছে। তীর ও ধনুক হাতে সন্তান কিউপিডের সঙ্গে ভালোবাসার দেবতা ভেনাস তখন কার্ডের উপর জায়গা করে নিয়েছেন। কবুতর, ফুল, হৃদয় এবং গির্জার ছবিও খুব দেখা যেত কার্ডের গায়ে। যতই দিন যেতে লাগলো, কার্ডের সজ্জা ততই বেড়ে গেল। লেইস ফিতা আর শুকনা ফুল বসানো কার্ডের নকশাও চলে এলো।    

হলমার্কের শুরু

১৯১০ সালে জয়েস ক্লাইড হল ছিল ১৮ বছরের এক আমেরিকান তরুণ।পকেটে কানাকড়ি না থাকলেও একজন উদ্যোক্তা হওয়ার উদ্দীপনা ভরপুর ছিল তার মনে। পোস্ট কার্ড বিক্রির ব্যবসা শুরু করলেন।

এরপর ভাই রলি হল যোগ দিলেন এই ব্যবসায়। দুজনের উদ্যোগের নাম হলো হল ব্রাদারস। কিন্তু ১৯১৫ সালের জানুয়ারিতে আগুন লেগে ধ্বংস হয়ে গেল তাদের অফিস ও পণ্য। নতুন করে দোকান চালু করার সময় ১৭ হাজার ডলার ঋণে ডুবে ছিল তারা।

এদিকে পোস্টকার্ডের বিক্রিতে ভাটা পড়ায় দুই ভাই ভেবে দেখলেন, সবাই প্রিয়জনের সঙ্গে যোগাযোগে আরেকটু গোপনীয়তা চাইছে। এরপর খামে ভরে ভ্যালেন্টাইনস ডে ও বড় দিনের কার্ড বিক্রি শুরু করলেন তারা। ছাপাখানাও কিনে নিলেন দুই ভাই মিলে। তারপর ১৯১৫ সালে শুরু হলো নিজেদের কারখানায় শুভেচ্ছা কার্ড ছাপানো।    

স্বর্ণকারেরা গহনায় মান বোঝাতে যে নির্দশক ছাপ দেন তাকে ইংরেজিতে হলমার্ক বলে। এই ইংরেজি শব্দটি জে সি হলের নজর কাড়ে। এই শব্দে মান বোঝানোর পাশাপাশি তাদের পারিবারিক নামের ছাপও রয়েছে। ১৯২৮ সাল থেকে নিজেদের ছাপানো প্রতিটি কার্ডের পেছনে হলমার্ক লিখতে শুরু করে হল ভাইয়েরা।    

মিরপুর আর্চিস শোরুম। ছবি: আইরিন সুলতানা

শুভেচ্ছা কার্ডের জগতে আর্চিস

ভারতের অনিল মুলচন্দানি তার গ্রাজুয়েশন শেষ করে দিল্লিতে শাড়ির ব্যবসায় নেমে যান। আর্চিসের আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৯৭৯ সালে। শুরুতে এই ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান থেকে পোস্টার, গানের বই বিক্রি হতো। ধীরে ধীরে শুভেচ্ছা কার্ড হয়ে উঠলো এই প্রতিষ্ঠানের মূল পণ্য। ১৯৮০ সাল থেকে শুভেচ্ছা কার্ড বিক্রি শুরু করে আর্চিস। ১৯৮৪ সালে ওয়াল্ট ডিজনির সঙ্গে চুক্তি করে আর্চিস। তারপর থেকে শুভেচ্ছা কার্ডে ডোনাল্ড ডাক এবং মিকি মাউসের দেখা মেলে। এতে করে আর্চিসের যশ ছড়িয়ে পড়ে।

সময়ের বদলের সঙ্গে তাল মেলাতে আর্চিসের বিপণন কৌশলে যোগ হয় ই-কার্ড।    

মিরপুর অরিজিনাল ১০ এলাকায় আর্চিস লেখা লাল-সাদা রঙে রাঙানো বড় একটি আউটলেট রয়েছে। ভ্যালেন্টাইনস ডে-র আগের দিন দোকানের ভেতরে গিয়ে দেখা গেল নানা রকম উপহার সামগ্রী ঠাসা। মাঝে দুটো তাকে শুভেচ্ছা কার্ড রাখা।

সহকর্মীকে বিদায় দেওয়ার কালে কর্মক্ষেত্রের বাকিরা ঢাউস আকারে কার্ড কিনে তাতে নানা শুভেচ্ছা বার্তা হাতে লিখে দিতেন; এই চল খুব ছিল কয়েক বছর আগেও। সেক্ষেত্রে ঢাকায় আর্চিস অথবা হলমার্ক শো রুম থেকেই কার্ড কেনা হতো সবার।      

তখন দোকানে যত কার্ড দেখা যেত তা এখন কমে এসেছে।

আগের তুলনায়  আর্চিস কার্ডের বাজার একটু ’স্লো’ বলে সকাল সন্ধ্যাকে জানালেন এই কার্ডের একজন পরিবেশক সনেট।   

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমি আমার বনানী আউটলেটের জন্য আর্চিসের কার্ড নিয়ে আসি। মিরপুর ১০ এর আউটলেটের আর্চিস আমার থেকেও নেয়, হয়তো আরও অন্যজনের কাছ থেকেও কার্ড নেয়।”

মিরপুরে আর্চিসের দোকানে  ১০০ টাকার নিচেও সাধারণ কার্ড রয়েছে। আবার  ৬০০, ৭৫০, ৮২৫ টাকা দামের মনকাড়া রঙের কার্ডও রয়েছে।  

মিরপুরে আর্চিস শোরুমে সাজানো কার্ড। ছবি: আইরিন সুলতানা

বিয়ের কার্ড এখনও প্রথা

সারা দেশে আজাদ প্রোডাক্টসের ৮টি শোরুম রয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে গেলেই বাহারি বিয়ের কার্ডের ছবি দেখা যায়।

৮০ টাকা থেকে শুরু করে ৭০০ টাকা মূল্যের বিযের কার্ডের নমুনা তোলা আছে আজাদ প্রোডাক্টসের ওয়েবসাইটে।

চট্টগ্রামে আন্দরকিল্লা মসজিদ বিল্ডিংয়ের আজাদ প্রোডাক্টসের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার ডেরেন রড্রিক্স অবশ্য জানালেন, তাদের ২০ টাকা থেকে ২০০ টাকার মধ্যেও বিয়ের কার্ড রয়েছে।

কার্ড বানানোর ক্ষেত্রে ট্রেসিং পেপার, সাটিন কাপড়, ভেলভেট কাপড় দিয়ে বানানো কার্ডও করে থাকে আজাদ প্রোডাক্টস। নকশা ও ছাপায় থাকে অ্যাক্রেলিক পেইন্ট, অ্যামবুশ, স্ক্রিন প্রিন্ট, আলপনা এবং ফুল।  

ডেরেন রড্রিক্স সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমরা সব ধরনের রঙের বিয়ের কার্ড করি। তবে এখানে ক্রিম বা অফ হোয়াইট রঙের প্রতি ঝোঁক আছে। আর হিন্দু সম্প্রদায়ের বিয়েতে বরকনের ছবি বসানো কার্ডের চাহিদা রয়েছে।”

কার্ডে বাংলা অথবা ইংরেজিতে বরকনের নাম এবং নেমন্তন্ন জানানো হয়। মুসলিমদের বিয়ের কার্ডে আরবিতে ‘বিসমিল্লাহ’ লেখা হয়ে থাকে।

বিয়ে কার্ডের জন্য নাম ও ঠিকানা দিলে শোরুম থেকে কার্ডের নমুনা দেখানো হয়। ওই নমুনা ক্রেতার অনুমোদন পেলে ছাপা হয়ে যায় বিয়ের কার্ড হিসেবে। অর্ডার দেওয়ার পর তিন ঘণ্টা থেকে দুতিন দিনের মধ্যে কার্ড হয়ে যায়।

“এখানে আমাদের আউটলেটে স্টকে না থাকলে সেন্ট্রালি ঢাকা থেকে আনাই আমরা।”

খামসহ সর্বনিম্ন ৫০টি বিয়ের কার্ড নেওয়া যাবে আজাদ প্রোডাক্টসের এই শোরুম থেকে।

“নভেম্বর, ডিসেম্বর, জানুয়ারি মোটামুটি বিয়ের মৌসুম। তখন একেকজন ক্রেতা প্রয়োজন মতো একশ-দুইশ যা প্রয়োজন হয় নেয়।”   

বিয়ের কার্ড ছাড়াও এরমধ্যে ঈদ কার্ড চলে এসেছে চট্টগ্রামে আজাদ প্রোডাক্টসের শোরুমে।  

“নববর্ষের কার্ড, লাভ কার্ড, কার্ড জগতের যত রকম কার্ড আছে তা এখানে পাওয়া যাবে। আমাদের থেকে দেখে এখন কার্ডের অনেক শিল্প বিকশিত হয়েছে।”

ফেইসবুকে ‘বিয়ের কার্ড’ নামে পেইজ রয়েছে উদ্যোক্তা নাঈম হোসেনের। আট বছর ধরে এই ব্যবসায় আছেন বলে জানালেন সকাল সন্ধ্যাকে।

নকশা ও ছাপা নিজেরা করেন; আবার চাহিদা বেশি হলে  ‘ব্র্যান্ড ও নন-ব্র্যান্ড’ কোম্পানির কার্ড কিনেও বিক্রি করেন নাঈম হোসেন।

“তবে ব্র্যান্ডের কার্ডের প্রচুর দাম। এগুলো তো সবার ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে নেই। আমরা ক্রেতার দেওয়া বাজেটের মধ্যে কার্ড করে দিতে পারি।”

তবে ‘কিছুদিন আগে’ একটি কার্ড আড়াই হাজার টাকাতেও বিক্রি করেছেন বলে জানালেন তিনি সকাল সন্ধ্যাকে।

ঢাকার বাংলাবাজারে দোকান রয়েছে নাঈম হোসেনের।  গত ডিসেম্বরে বিয়ের মৌসুমে একেকটি বিয়েতে ৩০০ থেকে ৪০০টি কার্ডের অর্ডার পেয়েছিলেন তিনি। সেসময় তার শোরুম থেকে একেকদিন দুই হাজার কার্ডও বিক্রি হয়েছিল।

হিন্দু পরিবারের বিয়েতে লাল রঙের কার্ডের দিকে আগ্রহ বেশি বলে জানালেন নাঈম হোসেন। এছাড়া সাদা ও কালো রঙের বিয়ের কার্ডও ‘বেশ চলে’।

‘নিকাহ ফ্রেম’ও বিয়ের বাজারে ক্রেতাদের কাছে ভালো সাড়া পেয়েছে, বললেন নাঈম হোসেন।

বর ও কনের নাম, তাদের বুড়ো আঙ্গুলের ছাপ অথবা সই এবং বিয়ের তারিখ বসানো হয় স্বচ্ছ ফাইবারের উপরিতলে। এরই নাম ‘নিকাহ ফ্রেম’।

একেকটা ‘নিকাহ ফ্রেম’ ১৮ টাকা থেকে আড়াই হাজার টাকা পর্যন্ত হতে পারে। ‘নিকাহ ফ্রেমে’র আকার হতে পারে লম্বায় ১১ ইঞ্চি এবং চওড়ায় সাড়ে ৮ ইঞ্চি। অর্ডার করলে দুয়েক দিনেই বানানো হয়ে যায়।

তবে নিত্য নতুন চমকের এই ডিজিটাল যুগেও কেন এখনও বিয়ের কার্ড টিকে আছে?

নাঈম হোসেন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বিয়ের দাওয়াত হচ্ছে মানুষের জীবনে খাঁটি একটা দিন। এই দিনটাকে স্পেশাল বানানোর জন্য হচ্ছে বিয়ের কার্ড। বিয়ের কার্ডে মানুষের আগ্রহ মনে হয় সবসময়ই থাকবে।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত