১১ বছর আগে মতিঝিলে শাপলা চত্বরে অভিযানের নামে গণহত্যা চালানোর অভিযোগ এনে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা করেছে হেফাজতে ইসলাম।
কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠনটির যুগ্ম মহাসচিব হারুন ইজহার চৌধুরী মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় মামলার আবেদনটি জমা দেন। তার পক্ষে আইনজীবী ছিলেন গাজী এম এইচ তামিম।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছেড়ে দেশত্যাগের ১৫ দিন পর এই মামলাটি হলো। এতে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও সাবেক মন্ত্রী, সাবেক সেনা কর্মকর্তা, রাজনীতিক, পুলিশ, সাংবাদিক, আইনজীবী ও গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকারকে আসামি করা হয়েছে।
ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার উপপরিচালক (প্রশাসন) মো. আতাউর রহমান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আজকে আমরা আরেকটি মামলা রিসিভ করেছি। এরই মধ্যে অভিযোগটি নথিভুক্ত হয়েছে। এখন তদন্তের কার্যক্রম শুরু হবে।”
যে আন্দোলনে শেখ হাসিনার পতন ঘটেছে, তাতে সহিংসতায় কয়েকশ মানুষ নিহত হয়। সেই ঘটনায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আগের মামলাটি হয়।
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে আওয়ামী লীগ সরকার আমলে ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়।
তার তিন বছর পর যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শান্তির দাবিতে গণজাগরণ আন্দোলন শুরু হলে তার প্রতিক্রিয়ায় মাঠে নেমেছিল হেফাজতে ইসলাম।
২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজত ঢাকার মতিঝিলের শাপলা চত্বরে সমাবেশ ডেকেছিল, যাতে সারাদেশ থেকে মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জড়ো করা হয়।
দিনভর সংঘাতের মধ্যে হেফাজত মতিঝিলে অবস্থান নেওয়ার ঘোষণা দিলে রাতে সেখানে সাঁড়াশি অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ভোররাতের সেই অভিযানে হেফাজতকর্মীদের তুলে দেওয়া হয়।
সেই অভিযানে বহু নিহত হয়েছিল বলে হেফাজতের দাবি। তবে সরকারের পক্ষ থেকে এক প্রেসনোটে বলা হয়েছিল, সেদিন অভিযানের পর শাপলা চত্বরে চারজনের লাশ পাওয়া গিয়েছিল। এছাড়া সেদিন বিভিন্ন স্থানে সংঘাতে তিন পথচারী, একজন পুলিশসহ ১১ জন নিহত হয়। পরদিন সহিংসতায় নিহত হয় ১৩ জন।
তখন মানবাধিকার সংগঠন অধিকার এক প্রতিবেদনে নিহতের সংখ্যা ৬১ বলে দাবি করেছিল। সেই সংখ্যাটি অতিরঞ্জিত অভিযোগ করে তখন অধিকারের সম্পাদক আদিলুর রহমান খান শুভ্রকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তার বিরুদ্ধে তথ্য প্রযুক্তি আইনে মামলাও হয়, তাতে গত বছর দেওয়া রায় তার দুই বছরের কারাদণ্ড হয়।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে, তাতে উপদেষ্টা হিসাবে যোগ দিয়েছেন আদিলুর।
হেফাজতের মামলায় ২০১৩ সালের ৫ ও ৬ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বর এলাকা, ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গণহত্যা, লাশ গুম ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে।
অপরাধের ধরনে বলা হয়েছে, হেফাজত নেতা-কর্মীদের সমূলে বা আংশিক নির্মূল করার উদ্দেশ্যে ১ থেকে ২৪ নম্বর আসামিদের নির্দেশে ও পরিকল্পনায় অন্যান্য আসামি কর্তৃক শহরব্যাপী ব্ল্যাকআউট করে টিভি চ্যানেল সম্প্রচার বন্ধ ও নিয়ন্ত্রণ করে আগ্নেয়াস্ত্র দ্বারা মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন করা হয়েছিল।
মামলার আসামি তালিকায় ১ নম্বরে রয়েছে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম।
তারপর ক্রমানুসারে রয়েছে- আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, ঢাকা দক্ষিণের সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস, সাবেক মন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সাবেক সংসদ সদস্য হাজি সেলিম, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সাবেক সংসদ সদস্য এ কে এম শামীম ওসমান, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিকী, সাবেক আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক ও বেনজীর আহমেদ, র্যাবের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক জিয়াউল আহসান, পুলিশ কর্মকর্তা হারুন অর রশীদ ও বিপ্লব কুমার সরকার, একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির, সদস্য মুনতাসীর মামুন, আইন সম্পাদক তুরিন আফরোজ, গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার, একাত্তর টিভির মোজাম্মেল বাবু, সময় টিভির আহমেদ জোবায়ের, এবি নিউজের সুভাষ সিংহ রায়, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব নাইমুল ইসলাম খান, বিজিবির সাবেক ডিজি ও সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ, গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআইয়ের সাবেক ডিজি এম মনজুর আহমেদ।
এছাড়া অজ্ঞাতনামা আসামির মধ্যে রয়েছে কতিপয় মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও কতিপয় বিজিবি, র্যাব, পুলিশ সদস্য এবং তৎকালীন কয়েকটি ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার নীতি-নির্ধারকরা।
অভিযোগে বলা হয়, ১ থেকে ৯ নম্বর আসামিরা তৎকালীন সরকারের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও এমপি হিসাবে প্রত্যক্ষভাবে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংগঠনের সহায়তা করে। ১০ থেকে ১৪, ২৩ ও ২৪ নম্বর আসামি তৎকালীন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তা হিসেবে ১ থেকে ৯ নম্বর আসামিদের নির্দেশে গণহত্যা চালায়। ১৫ থেকে ১৯ নম্বর আসামিরা তৎকালীন সরকারের তথাকথিত সুশীল ও প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসাবে গণহত্যা চালানোর পরামর্শ এবং বিভিন্ন বক্তৃতা, বিবৃতি, টকশো ও লেখনির মাধ্যমে গণহত্যার উস্কানি দেয়। এছাড়া ১৯ থেকে ২২ নম্বর আসামি ও অন্যান্য তৎকালীন কয়েকটি ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া মিথ্যা খবর ছড়িয়ে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে ও দেশের বাইরে প্রোপ্রাগান্ডা ছড়ায়।