একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচারে যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার, গত জুলাই ও আগস্টে হত্যাকাণ্ডের বিচারে সেই আদালতেই শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে হলো মামলা।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের নয় দিন পর বুধবার এই মামলার আবেদনটি জমা পড়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায়।
এর আগে এদিনই নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল এই আইনে পতিত সরকারের বিচারের পক্ষে মত জানিয়েছিলেন।
ছাত্র আন্দোলনে গুলি চালিয়ে হত্যা এবং ২০১৫ সালে এক ব্যক্তিকে গুম করার অভিযোগে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ঢাকার আদালতে আরও তিনটি মামলা হয়েছে দুদিনে।
তার বাইরে গণহত্যার অভিযোগে মামলাটি করেছেন বাগেরহাট সদরের বড় বাঁশবাড়ীয়া গ্রামের বুলবুল কবির নামে এক ব্যক্তি। তার ছেলে নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থী আরিফ আহমেদ সিয়াম গত ৫ আগস্ট ঢাকার সাভারে পুলিশের গুলিতে আহত হয়ে দুদিন পর মারা যান।
বুলবুলের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী গাজী এম এইচ তামিম ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার কাছে মামলার আরজি জমা দিয়েছেন।
তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় আবেদন দায়ের করা হয়েছে। আবেদনে ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ঘটনার তারিখ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
“এছাড়া এ সময়ে আহত হয়ে পরবর্তীতে বিভিন্ন তারিখে নিহতরা এর আওতায় থাকবে। ঘটনার স্থান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে সমগ্র বাংলাদেশকে।”
সরকারি চাকরিতে নিয়োগে কোটা সংস্কারের দাবিতে গত জুলাই মাসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ব্যানারে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল।
শুরুতে এই বিক্ষোভ শান্তিপূর্ণ থাকলেও গত ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগ হামলা চালালে তা সহিংসতায় গড়ায়।
এরপর কয়েকদিনে সারাদেশে সংঘাতে শতাধিক নিহত হলে সরকার কারফিউ জারি করে সেনা মোতায়েন করে, বন্ধ করে দেওয়া হয় ইন্টারনেট।
আন্দোলনের দাবি মেনে আদালতের নির্দেশে কোটা সংস্কার হলেও শিক্ষার্থীরা হত্যাকাণ্ডের দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিলে তা কঠোর হাতে দমনের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।
এরপর ব্যাপক সংঘাতে কয়েকশ মানুষ নিহত হওয়ার পর শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন গণআন্দোলনে পরিণত হয়। তার চাপে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন।
এর তিন দিন পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। জুলাই ও আগস্টে হত্যাকাণ্ডের বিচারের প্রতিশ্রুতি যাদের রয়েছে।
আসামি কারা কারা
সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে মামলার ১ নম্বর আসামি করা হয়েছে। আসামির তালিকায় ২ নম্বরে রয়েছেন সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
সাবেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের মধ্যে আসাদুজ্জামান খান কামাল, জুনাইদ আহমেদ পলক, মোহাম্মদ আলী আরাফাতের নাম আসামির তালিকায় ২, ৩ ও ৪ নম্বরে রয়েছে।
সাবেক পুলিশ প্রধান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, অতিরিক্ত আইজিপি হারুন-অর রশীদ, ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান ও র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক হারুন-অর রশীদের নাম রয়েছে যথাক্রমে ৬, ৭, ৮ ও ৯ নম্বরে।
সংগঠন হিসাবে আসামির তালিকায় ১০ নম্বরে রয়েছে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ তাদের সহযোগী অন্য সংগঠনগুলোকে।
আসামিদের মধ্যে শেখ হাসিনা গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার পর এখন ভারতে রয়েছেন।
ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান কামাল ও আরাফাতের অবস্থান ৫ আগস্টের পর থেকে অজানা। পলক বিমানবন্দরে আটকের পর এখন কোথায় আছেন, তা এখনও জানা যায়নি।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর চাকরি হারিয়েছেন আল মামুন ও হাবিব। তারা সহ অন্য দুই হারুনের অবস্থানও জানা যায়নি।
অভিযোগ কী
এজাহারে আসামিদের অপরাধ হিসাবে বলা হয়েছে- ১ থেকে ৯ নম্বর আসামিদের নির্দেশে ও পরিকল্পনায় অন্য আসামিরা দেশীয় ও আগ্নেয়াস্ত্র দ্বারা নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারী সাধারণ নিরস্ত্র জনতাকে হত্যা করে তাদের সমূলে বা আংশিক নির্মূল করার উদ্দেশ্যে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংগঠন করে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩(২), ৪ (১) ও ৪ (২) ধারা অনুযায়ী আসামিরা অপরাধ করেছে বলে দাবি করা হয়েছে।
আসামিদের কার কী দায়
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমনে উসকানিমূলক বক্তব্য দেন এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগকে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতাকে সমূলে বা আংশিক নির্মূলের নির্দেশনা দেন।
ওবায়দুল কাদেরের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ আনা হয়েছে। আন্দোলনকারীদের দমনে ‘ছাত্রলীগই যথেষ্ট’, কারফিউ চলাকালে ‘দেখা মাত্রই গুলি করা হবে’, তার এমন বক্তব্য ছাত্র-জনতাকে নির্মূলের পরিকল্পনা হিসাবে দেখানো হয়েছে।
আসামিদের নির্দেশনায় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ নেতা-কর্মীরা সারাদেশে শিক্ষার্থীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংগঠন করে বলে অভিযোগ করা হয়েছে।
তথ্য প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী পলক ও তথ্য প্রতিমন্ত্রী আরাফাত ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়ে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের তথ্য প্রচার বাধাগ্রস্ত করেছেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে।
৭ নম্বর আসামি হারুনের বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয়জন সমন্বয়ককে ধরে নিয়ে নির্যাতনেসর অভিযোগ আনা হয়েছে।
আর সব আসামির পরিকল্পনায় সারাদেশে সাড়ে ৪ লাখ ব্যক্তিকে আসামি করে ২৮৬টি মামলা দায়েরের পর ১২ হাজার জনকে গ্রেপ্তার করে নির্যাতন চালানো হয় অভিযোগ করা হয়েছে।
১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত পুলিশ, র্যাব, অস্ত্রধারী আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের গুলিতে কমপক্ষে ৪৯৩ জন শিক্ষার্থীকে হত্যা করা হয় বলে এজাহারে অভিযোগ করা হয়। এর মধ্যে ৩২টি শিশু রয়েছে।
এছাড়া ১০ হাজার ছাত্র-জনতা গুলিবিদ্ধ হয় বলেও উল্লেখ করা হয়। এর মধ্যে ১ হাজার জন গুলিবিদ্ধ হয়ে অন্ধত্ব ও পঙ্গুত্বের পথে বলে এজাহারে বলা হয়।
আইন উপদেষ্টা যা বললেন
জুলাই-আগস্টে সংঘটিত ‘গণহত্যা’র বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করা সম্ভব মত দিয়ে সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে অন্তর্বর্তী সরকারের আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, বিচারের স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিতে জাতিসংঘের সর্বাত্মক তত্ত্বাবধানে কাজ করবে তদন্ত দল।
তিনি বলেন, “গণহত্যা ও গুলিবর্ষণের ঘটনায় বিচারের জন্য এরই মধ্যে কিছু মামলা হয়েছে। আমরা নিজেরা এবং রাজপথে থাকা বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন, মানবাধিকার সংগঠন, জনগণের বিভিন্ন গোষ্ঠী দাবি করেছেন, এটাকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে বিচার করার সুযোগ আছে কি না। আমরা সেটা খতিয়ে দেখেছি।”
আসিফ নজরুল বলেন, “১৯৭৩ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন আছে, যেটা পরে ২০০৯ ও ২০১৩ সালে সংশোধনী হয়েছে, সেই আইনে আমরা জুলাই গণহত্যা, জুলাই গণহত্যা বলতে আমি আগস্টের প্রথম পাঁচ দিনের গণহত্যাও বোঝাচ্ছি, এর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারের জন্য আমরা এরই মধ্যে ছোটখাটো গবেষণা করেছি।
“করে দেখেছি, এই আইনের অধীনে এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি অর্থাৎ যারা আদেশ দিয়েছেন এবং যারা বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন, তাদের সকলকে বিচারের আওতায় আনা সম্ভব।”
“বিচারের সত্যিকারের স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার জন্য জাতিসংঘের সর্বাত্মক তত্ত্বাবধানে আমাদের তদন্ত দল কাজ করবে। সেটার লক্ষ্যে সব উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে,” বলেন তিনি।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে যারা পাকিস্তানি বাহিনীকে সহায়তা করে এদেশে গণহত্যা চালিয়েছিল, তাদের বিচারে ১৯৭৩ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন হয়েছিল।
এই আইনে গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আটক, বিচার এবং শাস্তি প্রদান সংক্রান্ত আইনি কাঠামো দেওয়া আছে। যে কোনও ব্যক্তি, দল, সংগঠন, সশস্ত্র বাহিনী, প্রতিরক্ষা বাহিনী বা সহযোগী বাহিনীর যে কোনও সদস্যের বিচার এই আইনে করা যায়।
২০১০ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষসতায় যাওয়ার পর আইনে কিছু সংশোধন করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়। সেই ট্রাইব্যুনালে বিচারে জামায়াতে ইসলামীর নেতা গোলাম আযম, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, মতিউর রহমান নিজামী, আবদুল কাদের মোল্লা, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, মুহাম্মাদ কামারুজ্জামান, মীর কাসেম আলীর পাশাপাশি বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সাজা হয়।