বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনের দোকান থেকে ছোট্ট একটা জিনিস কিনে ভাবলাম, মতিঝিল তো ‘ক্যাশলেস’, দামটা ডিজিটালি দিই।
সেজন্য দোকানির কাছে কিউআর কোড চাইতেই তিনি বিরক্ত কণ্ঠে বললেন, “নাই, টাকা দেন।” অগত্যা মানিব্যাগ খুলতে হলো।
গত বছরের জানুয়ারিতে ‘ক্যাশলেস বাংলাদেশ’ উদ্যোগের যাত্রা শুরু করে মতিঝিলকে পাইলট প্রকল্প হিসাবে নিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।
তাহলে সেই যাত্রার কী হলো- বুঝতে কিছুক্ষণ কথা হল সেই দোকানির সঙ্গে। নাম তার মো. জাহিদ হোসেন; ঢাকার ব্যস্ততম এই এলাকায় পান-সিগারেটের দোকান করেন তিনি ৯০ এর দশক থেকে।
কথায় কথায় জাহিদ বললেন, “আমারেও দিছিল (কিউআর কোড)। কিন্তু মানুষ এইটা দিয়া বিল দেয় না। তাই রাখি নাই।”বাংলা কিউআর পরিশোধ ব্যবস্থায় ‘ক্যাশলেস বাংলাদেশ’ গঠন ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ এর লক্ষ্য অর্জনে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
কিন্তু প্রায় দেড় বছর বাদে বাংলাদেশ ব্যাংকের আশপাশে অনেকদূর ঘুরে কেবল তিনটি দোকানে কিউআর কোড পাওয়া গেল। কিন্তু যেদিন যাত্রা শুরু করেছিল, সেদিন ১২০০ মার্চেন্ট ছিল এই প্রকল্পে।
তাহলে কি ক্যাশলেস বাংলাদেশ প্রকল্প ব্যর্থ হলো? তা অবশ্য মানতে রাজি নন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
তারা বলছেন, আরও বড় পরিসরে আসতে যাচ্ছে ক্যাশলেস বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রকল্প। মতিঝিল প্রকল্প থেকে অভিজ্ঞতা নিয়ে হচ্ছে ‘মাস্টার প্ল্যান’। এই কোরবানির ঈদের পর সেই মহাপরিকল্পনা দেখবে আলোর মুখ।
কী ছিল পরিকল্পনা
১২০০ মার্চেন্ট নিয়ে গত বছরের ১৮ জানুয়ারি মতিঝিলে ‘ক্যাশলেস বাংলাদেশ’ উদ্যোগের যাত্রা শুরুর সময় বলা হয়েছিল, বাংলা কিউআর পরিশোধ ব্যবস্থায় ‘ক্যাশলেস বাংলাদেশ’ গঠন ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ এর লক্ষ্য অর্জন এবং কিউআর কোডের মাধ্যমে পেমেন্টসহ সব ডিজিটাল লেনদেনের সুফল সাধারণ মানুষকে জানাতে এ উদ্যোগ।
পরবর্তী সময়ে সারা বাংলাদেশে এ উদ্যোগের প্রচার ও কার্যক্রম পরিচালনা করার ঘোষণাও ছিল।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছিল, পণ্য বা সেবা মূল্য পরিশোধের ক্ষেত্রে নগদ অর্থ, কার্ড বা চেক ব্যবহৃত হয়ে থাকে। নগদ অর্থে পরিশোধ ঝুঁকিপূর্ণ, চেকে পরিশোধ সময়সাপেক্ষ ও জটিল। অন্যদিকে কার্ড ব্যবহারের জন্য ব্যাংক বা এমএফএসগুলোকে ডিজিটাল পেমেন্ট অবকাঠামো বিনির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণে বিপুল বিনিয়োগ করতে হয়। ফলে কার্ডে মূল্য পরিশোধ ব্যবস্থা মার্চেন্টদের জন্য ব্যয়বহুল।
ছোট মার্চেন্টের (যেমন : ডাব বিক্রেতা, ঝালমুড়ি বিক্রেতা, চা বিক্রেতা, মুচি ইত্যাদি) পক্ষে এ ব্যয় বহন করা সম্ভব নয় বলে ডিজিটাল পেমেন্টের প্রসারে বিশ্বব্যাপী লো-কস্ট সলিউশন প্রচলনের তাগিদ রয়েছে। কুইক রেসপন্স (কিউআর) ডিজিটাল পেমেন্ট এমনি একটি লো-কস্ট সলিউশন।
বাংলাদেশে কিছু ব্যাংক ও এমএফএসের কিউআর কোড থাকলেও সর্বজনীন কিউআর ছিল না। ফলে, শুধু ওই ব্যাংক বা এমএফএস গ্রাহকরা পারস্পরিক লেনদেনেই সীমাবদ্ধ ছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নেতৃত্বে ১০টি ব্যাংক, তিনটি মোবাইল ব্যাংকিং সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান এবং তিনটি আন্তর্জাতিক পেমেন্ট স্কিম এই কাজে প্রাথমিকভাবে যুক্ত হয়েছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সমন্বয়ে এ উদ্যোগে যেসব ব্যাংক সম্পৃক্ত হয়েছিল, সেগুলো হলো ডাচ-বাংলা ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, এবি ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, পূবালী ব্যাংক ও ওয়ান ব্যাংক।
এছাড়া মোবাইল আর্থিক সেবা প্রতিষ্ঠান বিকাশ, এমক্যাশ, রকেট এবং আন্তর্জাতিক পরিশোধ স্কিম মাস্টারকার্ড, ভিসা ও অ্যামেক্স এ সেবায় যুক্ত হয়েছিল।
বাড়ল না কেন ব্যবহারকারী
বাংলাদেশের বিভিন্ন দোকানেই এখন বিকাশ, নগদ কিংবা রকেটের মাধ্যমে পেমেন্ট করার সুযোগ রয়েছে। এসব মাধ্যম ব্যবহারে মানুষও অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে।
কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের এই সর্বজনীন কিউআর মডেল কাজ করল না কেন? এই উত্তর জানতে কথা হয় মতিঝিলের ডাব বিক্রেতা, ঝালমুড়ি বিক্রেতা, চা বিক্রেতা, মুচিদের সঙ্গে।
মতিঝিলে যে তিনজনের কাছে কিউআর কোড পাওয়া গেছে, তাদের মধ্যে একজন মো. মমিন। সেনা কল্যাণ ভবনের পাশেই তার চায়ের দোকান। সোমবার দুপুর নাগাদ যখন তার সঙ্গে কথা হয়, তখন পর্যন্ত শুধু দুজন ক্রেতা তার দোকানে কিউআর কোড ব্যবহার করে দাম পরিশোধ করেছে। তিনি একদিনে এমন ক্রেতা সর্বোচ্চ পাঁচজন পেয়েছিলেন।
কেন মানুষ এটা কম ব্যবহার করছে- প্রশ্ন করলে মমিন বলেন, “আমি তো বলতে পারব না। আমি লাগায় রাখছি। যারা জানে, তারা কেউ কেউ দেয়।”
প্রচার কম হওয়ায় সাধারণ মানুষের এ বিষয়টি সম্পর্কে ধারণা কম বলে মনে করেন এই দোকানি।
তার দোকানেই চা খেতে এসেছিলেন সেনা কল্যাণ ভবনে কর্মরত কাজী মোহাম্মদ তাজউদ্দীন। আপনি কখনও কিউআর কোড ব্যবহার করে দাম দিয়েছেন- প্রশ্ন করলে তিনি একটু থতমত খেয়ে বললেন, “বেশি তো বিল হয় না। ৩০-৪০ টাকা হয়। হাতে হাতে দিয়ে দিই।”
কিন্তু একটু নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে তিনিও স্বীকার করলেন, প্রকল্পটি ভালো। তারপর বললেন, “মানুষ একটু বিরক্ত হয়। কিছু টাকা বিল দিবে, এইটার জন্য আবার কত জিনিসপত্র লাগবে। এজন্য করে না হয়তো বা। মানুষ জানেও কম। প্রচারণার দিকটা আরেকটু বাড়াতে হবে বলে মনে হয় আমার।”
ফিরে যাই বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনের দোকানি জাহিদের কাছে। কেন এটার ব্যবহার কম, তা নিয়ে তিনি জানালেন বিক্রেতা হিসাবে তার কিছু জটিলতার কথা।
“এই একাউন্টে ৫০০ টাকা জমা না হলে টাকা তোলা যায় না। এখন দেখা যায়, আমি বিক্রি করি ১০-১৫ টাকা। বেশিরভাগ মানুষই নগদ টাকা দেয়। হঠাৎ করে কেউ এই জিনিস দিয়া আমারে টাকা দিলে আমি তো তুলতে পারি না। এমনও হয়েছে মাসে মাত্র ২০০-৩০০ টাকা এটার মাধ্যমে বিক্রি হইছে। কিন্তু সেই টাকা তুলতে পারি নাই। এই গ্যাঞ্জামের কারণে আমি এটা ব্যবহার করাই বাদ দিছি।”
“আমি তো বড় ব্যবসায়ী না। আমি যাদের কাছ থেকে মাল নিই, তাদের তো ক্যাশ টাকা দিতে হয়। আমার তো লাভ হয় না। লাভ হইলে তো রাখতামই,” সমস্যার কথটি সরল ভাষায় বলেন জাহিদ।
ক্যাশলেসই কেন ভবিষ্যৎ
মূলত ক্যাশলেস ব্যবস্থা আধুনিক অর্থনীতির বিকাশের একটা নতুন অধ্যায়। ক্যাশলেস ব্যবস্থা ব্যবহারে অনেক সুবিধা আছে।
যেমন ক্যাশলেসের ব্যবস্থার মাধ্যমে যে কোনও সময় ও জায়গা থেকে সহজে ও দ্রুত লেনদেন সম্পন্ন করা যায়, টাকা ছাপানোর খরচ কম আসে, অতিরিক্ত টাকা সঙ্গে না রাখার জন্য নিরাপত্তার ঝুঁকি কমে, ফলে অর্থ সংক্রান্ত অপরাধের ঘটনা কমে, এ ব্যবস্থায় কর ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ বন্ধ হয়, প্রতিটি লেনদেনের রেকর্ড রাখা সম্ভব হয়, নকল বা জাল টাকার ব্যবহার কমে, মুদ্রা হাতে ধরতে হয় না বলে রোগজীবাণুর সংক্রমণ কমে। সর্বোপরি পরিবেশবান্ধব নগদবিহীন লেনদেন ব্যবস্থায় বিশ্বে কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমাতে সহায়তা করে।
আগামী বিশ্ব নগদ টাকা ছেড়ে ক্যাশলেস সোসাইটির দিকে যাচ্ছে। এজন্য ক্যাশলেস অর্থনীতি বা ক্যাশলেস সোসাইটির আলোচনা বহুদিন ধরে চলে আসছে।
ক্যাশলেস সোসাইটি বা সমাজের বড় দৃষ্টান্ত বর্তমানে নর্ডিক দেশ সুইডেন, যেখানে এখন নগদ অর্থের ব্যবহার প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে বলা চলে। দেশটিতে মাত্র ১০ শতাংশের কম সংখ্যক মানুষ এখন কেনাকাটায় নগদ অর্থ ব্যবহার করে।
বিশেষজ্ঞের মতে, সুইডেন হয়ত পৃথিবীর প্রথম দেশ হবে, যারা সম্পূর্ণ ক্যাশলেস সোসাইটিতে রূপান্তরিত হবে।
একই পথে হাঁটছে নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, ডেনমার্কসহ ইউরোপের বেশিরভাগ দেশ। নরওয়ে, ফিনল্যান্ড ও ডেনমার্কে প্রায় ৯০ শতাংশের কাছাকাছি মানুষ এখন ক্যাশলেস ব্যবস্থার আওতায় চলে গেছে।
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীন তাদের দেশের আলি পে, উইচ্যাট পে, টেনসেন্ট মোবাইল পেমেন্টের মাধ্যমে বহু আগের মোবাইল পেমেন্ট দিয়ে ক্যাশলেস যাত্রা চালু করেছিল। কোভিড-পরবর্তী সময়ে চীন তাদের প্রথম জাতীয় ডিজিটাল মুদ্রা তৈরি করেছে।
চীন আগামী কয়েক বছরের মাঝে সম্পূর্ণ স্পর্শবিহীন ক্যাশলেস লেনদেন রূপান্তরের কাজে রয়েছে। চলতি বছরে চীনের মোট জনসংখ্যার ৬০ শতাংশ মোবাইলের মাধ্যমে লেনদেন করবে বলে আশা করছে দেশটি।
বাংলাদেশের পাশের দেশ ভারতও ডিজিটাল লেনদেনের বাস্তব প্রয়োগে দৃষ্টান্ত হয়ে উঠতে যাচ্ছে। ভারতে ২০১৬ সালের নোট বাতিলের পরে ডিজিটাল পেমেন্ট তরতরিয়ে বাড়ছে।
আসছে মহাপরিকল্পনা
মতিঝিলকে ক্যাশলেস করার পরিকল্পনা সফল হয়নি, তা মানতে রাজি নন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক।
তিনি বলেন, “এটা আমাদের একটি প্রকল্প ছিল। আমরা দেখতেও চেয়েছিলাম, কী ধরনের সমস্যা তৈরি হয়। এখানকার যেই অভিজ্ঞতা, তা আমাদের সামনের দিনে কাজে লাগবে। ফলে একদম সফল হয়নি, তা বলতে পারবেন না।”
ক্যাশলেসই ভবিষ্যৎ- এমন কথা শুনিয়ে মেজবাউল বলেন, “এটার বিস্তার হবেই। এটি নিয়ে আমরা কাজ করছি। এর মধ্যে আমাদের ‘টাকা পে’ কার্ডটিও লঞ্চ হয়ে যাচ্ছে। এর সাথে যে চিপ টেকনোলজি আছে, তাও আমরা ইনকর্পোরেট করে ফেলছি। এটার মধ্যে প্রাইসিং নিয়ে আমরা কিছু এবিউজ দেখেছি, সেগুলোর ব্যাপারেও আমরা পদক্ষেপ নিচ্ছি।”
সামনে ক্যাশলেস আরও ব্যাপক আকারে দেখা যাবে বলে দাবি করছেন মেজবাউল; আর সেজন্য একটি মহাপরিকল্পনার কথাও তিনি জানান।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র বলেন, “আমাদের দুটি এরিয়ায় কাজ করতে হবে। একটি হলো আমাদের এক্সেস পয়েন্ট তৈরি করতে হবে। আরেকটি হল এক্সেস পয়েন্টের সাথে সেকেন্ডারি লেভেল যেটা হোলসেল বা ডিস্ট্রিবিউশন লেভেল, ওইখানেও কাজ করতে হবে।”
মহাপরিকল্পনার বিষয়ে তিনি বলেন, “যেহেতু এখন সরকারও চায় ক্যাশলেস সোসাইটি তৈরি করতে। এজন্য আমরা কেবিনেটের সাথে মিলে মাস্টারপ্ল্যানের কাজ করছি। ঈদের পরই এই মাস্টারপ্ল্যান জনসম্মুখে আসবে।”