বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-২১ হকি দলের সামনে বিশ্বকাপে খেলার হাতছানি। আগামী ১১-১৯ নভেম্বর ওমানের মাসকটে অনুষ্ঠিত হবে ১০ দলের জুনিয়র এশিয়া কাপ হকি। এই টুর্নামেন্টে অংশ নেবে চীন, ভারত, চাইনিজ তাইপে, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, ওমান, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড ও বাংলাদেশ।
এখান থেকে সেরা ৬ দল খেলবে ২০২৫ সালে ভারতে অনুষ্ঠিত জুনিয়র বিশ্বকাপে। স্বাগতিক হিসেবে জুনিয়র বিশ্বকাপে সরাসরি খেলবে ভারত। শক্তিশালী ভারত এশিয়া কাপের সেরা ছয়ে থাকবে ধরে নেওয়াই যায়, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের সপ্তম হয়েও বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ থাকছে।
বাস্তবতা হচ্ছে এমন বড় টুর্নামেন্ট সামনে রেখে এই মুহূর্তে কোনও পরিকল্পনা নেই হকি ফেডারেশনের। খেলোয়াড়েরা মন খারাপ করে কোচদের ফোন করছেন। ক্যাম্পে যোগ দেওয়ার জন্য তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষায় রয়েছেন। কিন্তু জাতীয় দলের ক্যাম্প ডাকার সিদ্ধান্ত যিনি নেবেন সেই সাধারণ সম্পাদক মমিনুল হক সাঈদ লাপাত্তা! দেশের হকি ডুবিয়ে সাঈদ পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বিদেশে।
সাঈদের ক্রীড়াসংগঠক ট্যাগ
সেই অর্থে কখনও ক্রীড়া সংগঠক ছিলেন না সাঈদ। রাজনৈতিক পরিচয়ই মুখ্য ছিল তার। ছিলেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর। ছিলেন যুব লীগের ঢাকা দক্ষিণের যুগ্ম সম্পাদক। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ও চাঁদাবাজির টাকা দিয়ে দখল করেন আরামবাগ এলাকার বেশ কয়েকটি ক্লাব। এই শক্তির জোরে এবং কাউন্সিলরদের স্ত্রীর জন্য সোনার চেইন উপহার দিয়ে ২০১৯ সালের নির্বাচনে জেঁকে বসেন হকি ফেডারেশনে। ওই টাকা ও সোনার চেইনের কাছে হার মেনে বিদায় নিতে হয়েছিল হকির কিংবদন্তি তারকা আবদুস সাদেককে।
জুয়া ও হকি মিলেমিশে একাকার
“ক্যাসিনো সাঈদ” বলে পরিচিত এই হকি সংগঠক মতিঝিলের ক্লাবপাড়ায় রীতিমতো ক্যাসিনো বসিয়ে জুয়ার মহোৎসব চালিয়েছিলেন এক সময়। কিন্তু ২০১৯ সালে ক্যাসিনো কান্ডের একাধিক মামলায় আত্মগোপনে চলে যান। হকি এবং তার ইমেজের জন্য ওটা ছিল বড় ধাক্কা। ওই সময় হকি চলে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক দিয়ে।
সাঈদ প্রায় সাড়ে ৩ বছর আত্মগোপনে থাকার পর আবারও ফিরে আসেন গত বছর। অবিশ্বাস্যভাবে হকি ফেডারেশনের তৎকালীন সভাপতি এয়ার চিফ মার্শাল শেখ আবদুল হান্নান কোনও নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই তাকে বসিয়ে দেন ফেডারেশনের সম্পাদকের চেয়ারে। আবার শুরু হয় তার অনিয়ম। হকির দিকে নজর দেওয়ার পরিবর্তে ফেডারেশন কার্যালয়কে বানিয়ে ফেলেন রাজনৈতিক আড্ডাখানা।
পরিকল্পনাহীন পথচলা
হকিতে সেই অর্থে কোনও পরিকল্পনায় ছিল না। ২০২২ সালের নভেম্বরে ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে যা কটা ম্যাচ হয়েছে, এর বাইরে ঘরোয়া খেলা নেই। প্রিমিয়ার হকি লিগ হয়েছে নামকা ওয়াস্তে। লিগের নামে হয়েছে সার্কাস। অনিয়মিত হয়ে পড়া হকি লিগের খেলাগুলো মাঠে গড়ালেও ঠিক সময়ে শেষ করতে পারেননি আম্পায়াররা। খেলোয়াড়দের মধ্যে ঠুনকো বিষয়ে হয়েছে কথা কাটাকাটি, হাতাহাতির ঘটনাও ঘটেছে প্রতিনিয়ত। আম্পায়ারদেরও সিদ্ধান্ত নিতে ভিডিও আম্পায়ারের দ্বারস্থ হতে হয়েছে বারংবার। ৪ কোয়ার্টারে ৬০ মিনিটের একটি ম্যাচ শেষ করতে কখনও কখনও লেগে গেছে ৩ থেকে ৪ ঘন্টা। আর এর সবই হয়েছে সাঈদের কার্যনির্বাহী কমিটির লিগ কমিটির অধীনে চলতি বছরের এপ্রিলে।
তবে কেউ কেউ তার সুনাম করার চেষ্টা করেন। ক্যাসিনোর টাকা দিয়ে আরামবাগের কয়েকটি ক্লাবকে হকি দল গড়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু এটা তো কোনও স্বাভাবিক চর্চা নয়। তাই ক্যাসিনো কান্ডে সাঈদ বিপাকে পড়ায় দলগুলোও বিপদগ্রস্ত হয়।
ধ্বংস হয়েছে তৃণমূলের হকি
বাংলাদেশের হকি মূলত বিকেএসপি নির্ভর। গত কয়েক বছর ধরেই এটা চলছে। কখনও তৃণমূলে নজর দেওয়া হয়নি। ঢাকার বাইরে হকির ধ্বংস আগে থেকে শুরু হয়েছিল। সাঈদের হাতে তার পুরোপুরি মৃত্যু হয়েছে।
রাজশাহী জেলা ক্রীড়া সংস্থার হকি কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান হকি ফেডারেশনের সদস্য তৌফিকুর রহমান রতনের অভিযোগ, “তৃণমূলের কথা কখনও ভাবেননি সাঈদ। উনি উড়ে এসে জুড়ে বসেন হকিতে। কখনও জানতে চাননি কিভাবে জেলাগুলো চলছে, কিভাবে খেলছে। আমি নিজের টাকা দিয়ে ১২টি ক্লাব নিয়ে রাজশাহীতে ১ম বিভাগ লিগের আয়োজন করেছি। কোনও দিন একটি টাকাও উনি দেননি কোনও জেলাকে। তিনি ভোট কিনেছেন নিজের আখের গোছানোর জন্য। উনার কারণে হকি ধব্বংস হয়ে গেছে।”
সাঈদের কারণেই প্রকৃত সংগঠকেরা হকি থেকে মুখ সরিয়ে নিয়েছেন বলে মনে করেন তিনি, “আসলে দিনাজপুর, রাজশাহী, যশোরসহ বিভিন্ন জেলার প্রতিষ্ঠিত সংগঠকদের দিকে নজর দেননি। এ জন্য সবাই সরে গেছে। চক্ষুলজ্জায় ও আত্মসম্মান বোধের কারণে সরে গেছেন তারা। কারণ একে তো সাঈদ বিতর্কিত লোক। এরপরও যদি মানুষকে সম্মান না করেন তাহলে কেন আসবে ওরা !”
কোচ খেলোয়াড়ের গণ-শাস্তি
২০২৪ সালে প্রিমিয়ার হকি লিগে নজিরবিহীনভাবে কোচ ও খেলোয়াড় মিলিয়ে ৩১ জনকে শাস্তি দেয় সাঈদের নির্বাহী কমিটি। যেখানে মোহামেডানের খেলোয়াড় রাসেল মাহমুদ জিমিকে ১২ ম্যাচ নিষিদ্ধের পেছনে অদ্ভূত কারণ দেখানো হয়। হকি ফেডারেশন থেকে চিঠিতে বলা হয় আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচে সৃষ্ট অপ্রীতিকর ঘটনায় তদন্তে প্রমাণ পাওয়ায় জিমিকে ১২ ম্যাচ সাসপেন্ড করা হয়েছে। অথচ এর আগে তিন হলুদ কার্ডের কারণে জিমি সেই ম্যাচে মাঠেই নামতে পারেননি!
আত্মগোপন থেকে ফিরে আসার পর সাঈদ একটি নির্দিষ্ট ক্লাবকে সুবিধা দিয়েছেন। জাতীয় দলের সাবেক খেলোয়াড় ও কোচ মামনুর রশীদের চোখে সাঈদ ছিলেন আবাহনীর আজ্ঞাবহ, “তাকে আওয়ামী লীগ সরকারের হাই কমান্ডের সঙ্গে আলোচনা করে আবারও হকিতে নিয়ে এসেছিল কমিটির সুবিধাবাদী সহ-সভাপতি রশিদ শিকদার এবং যুগ্ম সম্পাদক মাহবুবুল এহসান রানা, রিপন খানেরা। শেষ দিকে আবাহনীর আজ্ঞাবহ ছিলেন উনি। এই এক বছরে তারা যা বলেছে তাই শুনতে হয়েছে তাকে।”
সাজেদ আদেলের কাউন্সিলরশিপ ছিনতাই
দিনটি আজও ভোলেননি সাজেদ এএ আদেল। ২০২৩ সালে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে মনোনয়নপত্র জমা দিতে গিয়েছিলেন হকি ফেডারেশনের সাবেক সহ-সভাপতি। তার আরেকটা পরিচয় হল, দীর্ঘদিন এই সংগঠকের নেতৃত্বেই মোহামেডানের হকি দল চলতো, দল গঠন হতো। এমন ব্যক্তিকে সেদিন জোর করে এনএসসি থেকে বের করে দেন হকি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মমিনুল হক সাঈদ।
প্রবীণ এই ক্রীড়া সংগঠককে রীতিমতো হুমকি দিয়েছিলেন সাঈদ। সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে জাতীয় দলের সাবেক এই খেলোয়াড় জানান, “নির্বাচনে আমার দুইটা ক্লাব হকি ঢাকা ইউনাইটেড ও কম্বাইন্ড স্পোর্টিং ক্লাবের কাউন্সিলরশিপ ছিনতাই করা হয়। এই দুটি ক্লাবের সভাপতি আমি। ঢাকা ইউনাইটেড থেকে আমার নাম ও কম্বাইন্ড থেকে জহিরুল ইসলাম মিতুলের নাম কাউন্সিলরশিপ হিসেবে গেছে। কিন্তু সাঈদ ওই কাগজ রেখে নতুন করে দুজনকে কাউন্সিলর বানান। আমি যখন এটার প্রতিবাদ করেছি খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ করার সময় তখন থেকেই আমাকে হুমকি দিচ্ছিল সে।”
তিনি যোগ করেন, “আমাকে নমিনেশন পেপার কিনতে দেওয়া হয়নি। এনএসসিতে গেলে ৪০ জন আমাকে ঘিরে ফেলে। সাঈদ আমাকে বলেন টাকা-পয়সাতে আপনি আমার ওপরে থাকতে পারেন, পেশী শক্তিতে নয়। এরপর আমার হাত থেকে সাঈদের লোকজন কাগজপত্র ছিনিয়ে নেয়। আমাকে লিফট দিয়ে জোর করে নিচে নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল। একজন ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে এমন অসম্মানিত হবো কখনো ভাবিনি। ” উদ্দেশ্য ছিল সাজেদ আদেল যেন ফেডারেশনে নির্বাচন করতে না পারেন।
চ্যাম্পিয়নস ট্রফি করে দেনায় হকি
এশিয়ান হকির সবচেয়ে বড় আসর চ্যাম্পিয়নস ট্রফি, ঢাকায় যেটি প্রথমবার আয়োজন করা হয় ২০২১ সালের ডিসেম্বরে। ৫ জাতির টুর্নামেন্টে স্বাগতিক বাংলাদেশ ছাড়াও অংশ নেয় ভারত, পাকিস্তান, জাপান ও কোরিয়া। প্রথমবারের মতো এই আসর আয়োজন বাবদ বাংলাদেশ হকি ফেডারেশন খরচ করে প্রায় ২ কোটি ১০ লাখ টাকা। বড় অঙ্কের ব্যয়ের বিপরীতে আয় মাত্র ১ কোটি ২০ লাখ টাকা। বাকি টাকা পরিশোধ করতে হকি ফেডারেশনের হয়েছিল গলদঘর্ম অবস্থা! ফেডারেশনের এককালীন স্থায়ী আমানতে (এফডিআর) গচ্ছিত প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টাকা থেকে দেনা শোধ করে ফেডারেশন। অথচ ৮০ হাজার ডলার দিয়ে টুর্নামেন্টের স্বত্ব কেনা হয়েছিল। এশিয়ান হকি ফেডারেশনের ১৯ কর্মকর্তার আসা-যাওয়া, পাঁচ তারকা হোটেলে থাকা-খাওয়ার ব্যয় প্রায় কোটি টাকা।
হকি ফেডারেশন আগেই জানত টাইটেল স্পন্সর বা টিভি স্বত্ব থেকে কোনও টাকা পাবে না। শুধু জাতীয় দলের স্পন্সর বাবদ ১ কোটি ২০ লাখ টাকা আয় করতে পেরেছিল ফেডারেশন। অথচ এমন অলাভজনক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সাধারণ সম্পাদক মমিনুল হক সাঈদ। ওই সময়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকারে প্রয়াত ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইউসুফ বলেছিলেন, “ আমি আসার আগেই (তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক মমিনুল হক সাইদের সময়) এই টুর্নামেন্ট আয়োজন নিয়ে এশিয় হকি ফেডারেশনের সঙ্গে লিখিত চুক্তি হয়ে গিয়েছিল। ইচ্ছা থাকলেও বাতিল করতে পারিনি। চুক্তি বাতিল করলে আমাদের আন্তর্জাতিক হকি থেকে সাসপেন্ড করা হতো। চুক্তির আগে তার বোঝা উচিত ছিল টুর্নামেন্ট থেকে আমরা কী পেতে পারি। এখন কোটি টাকা দেনায় ফেডারেশন।”
হকি ফান্ডে ৩৮ হাজার টাকা
হকির তহবিল থেকে দেদারছে টাকা পয়সা খরচের অভিযোগ আছে সাঈদের বিরুদ্ধে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে ফেডারেশনের তহবিলে এখন আছে মাত্র ৩৮ হাজার টাকা। ক্ষোভের সুরে ফেডারেশনের সাবেক সহ-সভাপতি সাজেদ আদেল বলেন, “এফডিআরের ৩ কোটি টাকা একাধিকবার ভাঙার চেষ্টা করেন সাঈদ। কিন্তু তখনকার সভাপতি সাহেব রাজি হননি বলে সেটা ভাঙতে পারেন নি।”
এখনও এফডিআর-টা বাঁচিয়ে রেখেছে হকি ফেডারেশন। তবে সাজেদ আদেলের দাবি, “আমরা যখন ফেডারেশনে ছিলাম তখন সব মিলিয়ে সাড়ে ৩ কোটির ওপরে টাকা ছিল। এরপর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বদল হওয়ার ৬ মাস আগে ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের থেকে আরও ৫০ লাখ পায়। সেই টাকারও কোনও খোঁজ নেই। এখন তহবিলে মাত্র ৩৮ হাজার টাকা আছে।”
ডলারের বিনিময়ে এশিয়ান হকিতে পদ
২০২৩ সালের মার্চে দক্ষিণ কোরিয়ায় অনুষ্ঠিত এশিয়ান হকি ফেডারেশনের নির্বাচনে দুটি গুরুত্বপূর্ণ পদে নির্বাচিত হন বাংলাদেশের দুজন। সহ-সভাপতি হন সাঈদ, নির্বাহী সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন আবদুর রশীদ সিকদার।
গুঞ্জন রয়েছে এশিয়ান হকির কমিটিতে পদ পেতে প্রচুর পরিমাণ উপহার ও ডলার খরচ করেন সাঈদ। এর আগে এশিয়ান হকি কমিটির সদস্য পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন বাংলাদেশের সাজেদ আদেলও। তিনি বলেন, “সাঈদ কৌশলে এশিয়ান হকি ফেডারেশনের দুই কর্মকর্তা গাউস ও তৈয়ব ইকরামকে ডলার এবং নানা কিছু উপহার দিয়ে সহ সভাপতি হয়েছেন। আসলে ব্যক্তি সাঈদ কোনও ভাবে সহ-সভাপতি হওয়ার যোগ্য নয়।”
শেষ কথা
সাঈদের মতো অযোগ্য লোকের হাতেই পড়েছিল হকি ফেডারেশন। তার চারপাশে কিছু সংগঠকও ছিলেন যারা নিজেদের সুবিধা নেওয়ায় ব্যস্ত ছিলেন। সাঈদকে ব্যবহার করার লোকও ছিল অনেক। তাই ফেডারেশনের কর্মকান্ডে হকি কখনও প্রাধান্য পায়নি।