Beta
মঙ্গলবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০২৪
Beta
মঙ্গলবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০২৪

কোরবানির হাটে বলদ কেন আর মিলছে না

ঢাকায় কোরবানির হাটে বলদের দেখা পাওয়া ভার। বেশিরভাগই ষাঁড়। ছবি : জীবন আমির
ঢাকায় কোরবানির হাটে বলদের দেখা পাওয়া ভার। বেশিরভাগই ষাঁড়। ছবি : জীবন আমির
[publishpress_authors_box]

কোরবানির হাটে আগে পশুর ভিড়ে প্রচুর বলদের দেখা মিললেও এখন আর তেমন দেখা যাচ্ছে না; অথচ গরুর কমতি নেই।

বৃহস্পতিবার ঢাকার মোহাম্মদপুরের বছিলার কোরবানির হাটের পুরোটা ঘুরে কোনও বিক্রেতার কাছে বলদ গরু পাওয়া যায়নি।

এই হাটেই টাঙ্গাইলের নাগরপুর থেকে ১৮টি গরু নিয়ে এসেছেন মো. শাহজাহান। তার সবগুলোই ষাঁড়, একটিও বলদ নেই।

বলদ কেন নেই- প্রশ্নে শাহজাহান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, বলদ গুরু পোষার খরচ বেশি বলে এখন আর কেউ তা পালতে চায় না।

প্রায় ২০ বছর ধরে গরু পেলে-পুষে বিক্রি করে আসা এই ব্যবসায়ী বলেন, “বলদের খোরাকি খরচ মেলা। আবার যত খায়, তত বেশি মোটা হয় না। তাই বলদ পাললে পোষায় না। আবার বিক্রি করলেও ষাঁড়ের মতো দাম পাওয়া যায় না।”

শাহজাহানের সঙ্গে ছিলেন তার সহকারী আশিক আহমেদ। তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আগে ভারত থেকে প্রচুর বলদ গরু আসত। কিন্তু এখন আর তেমন আসে না। সেকারণে হাটে বলদ গরু নেই।”

বলদ খোঁজা দেখে টাঙ্গাইল থেকে বছিলায় গরু নিয়ে আসা আরেক ব্যবসায়ী মো. ইসমাইল সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “শুধু এই হাটে না, কোনও হাটেই আর বলদ গরু পাবেন না। আপনার খুব দরকার হলে গাবতলী হাটে যেতে পারেন। সেখানেও পাবেন কি না, সন্দেহ।”

এরপর ঢাকার স্থায়ী পশুর হাট গাবতলীতে গিয়েও বলদের দেখা পাওয়া গেল না।

নাটোর থেকে গাবতলী হাটে গরু নিয়ে আসা ব্যবসায়ী মো. কুদরত আলী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এমনিতেই বলদ গরু খুব কম পাওয়া যায়।

“আর এখনও হাটে তেমন গরু ওঠেনি। তাই আপনি আরও ২/১ দিন পর আসলে হয়ত বলদ গরু পেতে পারেন। তবে এটা নিশ্চিত পুরো হাট তন্নতন্ন করে খুঁজলেও ২০টার বেশি বলদ পাওয়া যাবে না।”

ঢাকার কোরবানির হাটমুখী ট্রাকের গরুগুলোর মধ্যে ষাঁড়ই বেশি। ছবি : হারুন-অর-রশীদ রুবেল

দশককাল আগেও কোরবানির পশুর চাহিদার অনেকটাই মিটত ভারত থেকে আসা গরুতে। কিন্তু অবস্থা এখন বদলেছে। দেশে কৃষকের ঘরে গরু পালনের পাশাপাশি পশুর খামারও হয়েছে অনেক।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় হিসাব দিয়েছে, এবার কোরবানির ঈদে দেশেই চাহিদার চেয়ে ২২ লাখ ৭৭ হাজার গবাদি পশু বেশি রয়েছে।

মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, এবার কোরবানিযোগ্য পশুর সংখ্যা ১ কোটি ২৯ লাখ ৮০ হাজার ৩৬৭টি, যা গতবারের চেয়ে ৪ লাখ ৪৪ হাজারটি বেশি।

কৃষিতে প্রযুক্তির ব্যবহারও বলদের সংখ্যা কমিয়ে দিয়েছে বলে জানালেন গরু ব্যবসায়ী মো. বাছের আলী। তিনি জামালপুরের বাঘারচর থেকে ২৫টি গরু নিয়ে এবার বছিলার হাটে এসেছেন।

বাছের সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “কয়েক বছর আগেও গ্রামের বেশিরভাগ ঘরে বলদ পালন হতো। সেসব বলদ দিয়ে হাল চাষ, গাড়ি টানা, মালামাল পরিবহনের কাজ করতো। বলদের বয়স হলে হাটে বিক্রি করে দিত।

“কিন্তু এখন কেউ আর গরু দিয়ে হাল চাষ করে না। গরুর গাড়িও চলে না। তাই এখন আমার এলাকায় কোথাও বলদ গরু পালন হয় না।”

কৃষিতে হালচাষে এখন বলদের এমন ব্যবহার নেই বললেই চলে।

কৃষিতে প্রয়োজন ফুরিয়েছে বলদের

রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার কুদাপাড়া গ্রামের কৃষক বাহার প্রামাণিক। ২০০৫ সালেও তার বাড়িতে যে ১০টি গরু ছিল, তার আটটিই ছিল বলদ, বাকি দুটি গাভী। কিন্তু এখন আর তার বাড়িতে কোনও বলদ নেই।

৭৫ বছর বয়সী বাহার সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আগে বেশিরভাগ বাড়িতে জোড়ায় জোড়ায় বলদ গরু থাকত। আদর করে সেসব বলদের আবার নামও রাখত মালিকরা। লালু, বিষা, কালু- এমন নানা নামে গরুগুলোকে ডাকত তারা।

“সেসব বলদ দিয়ে হাল বওয়া থেকে বিভিন্ন কাজ করানো হতো। যার জমির পরিমাণ যত বেশি থাকত, তার বাড়িতে বলদও তত বেশি থাকত।”

এখন বলদ না থাকার কারণ ব্যাখ্যা করে এই কৃষক বলেন, “এখন সবাই পাওয়ার টিলারসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি দিয়ে জমি চাষাবাদ করছে। গরুর গাড়ি দিয়ে মাল টানাও আর হয় না। তাই লাঙ্গল ও জোয়াল আর গাড়ির সঙ্গে বলদও হারিয়ে যাচ্ছে।”

এই অঞ্চলে কৃষকের গোয়ালে সাধারণত তিন ধরনের গরু থাকত। পুরুষ গরুদের মধ্যে ষাঁড় মূলত প্রজনন এবং বিক্রির জন্য পালা হত। পুরুষ গরুগুলোর মধ্যে যেগুলো হালচাষ ও ভার বহনের জন্য ব্যবহার হতো, সেগুলোই বলদ। এগুলোকে আবার প্রজনন অক্ষম করা হতো। আর গাভী পালা হত দুধের চাহিদা মেটানো এবং প্রজননের জন্য।

নওগাঁ জেলার আত্রাইয়ের বাঁকা গ্রামের কৃষক হুরমুত আলী প্রামাণিক সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ষাঁড় অনেক রাগী আর চঞ্চল, তাই এটা দিয়ে হাল চাষ বা গাড়ি টানানোর মতো কোনও কাজ করানো সম্ভব হতো না। একারণে মানুষ বলদ গরু রাখত।

“এখন তার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। কেউ এখন গরু লালন-পালন করে মাংসের জন্য, কেউবা দুধের জন্য।”

খামারগুলোতে সাধারণত ষাঁড়ই পালন হয় বেশি। ছবি : হারুন-অর-রশীদ রুবেল

খামারেও নেই বলদ

গত এক দশকে বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা খামারগুলোতে দুধ ও মাংসের জন্যই গরু পোষা হয় বলে বলদ সেখানেও নেই।

নওগাঁ জেলার আত্রাই উপজেলার ভোঁপাড়া ইউনিয়নের ক্ষুদ্র খামারি মো. সাখাওয়াত হোসেন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বলদ গরুর তুলনায় ষাঁড়ে মাংস বেশি হয়। কারণ বলদ গরুর পেছনের অংশ ষাঁড়ের তুলনায় কিছুটা সরু হয়। বিপরীতে ষাঁড়ের তুলনায় বলদ গরুর খাবারের পরিমাণ বেশি লাগে। তাই বলদ পালন লাভজনক হয় না।”

ঢাকার কেরানীগঞ্জের আরশিনগর এলাকার খামারি আবুল হোসেনের ভাষ্যও প্রায় একই।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমার খামারে বেশিরভাগ গরুই দুধের জন্য। আর কোরবানি উপলক্ষে অল্প পরিমাণে ষাঁড় লালন-পালন করি। কোরবানির জন্য ক্রেতাদের পছন্দের শীর্ষে থাকে ষাঁড় গরু। চাহিদা না থাকায় আমিসহ আশপাশের কেউই বলদ লালন-পালন করে না।”

কোরবানির জন্য তেজি ষাঁড় অনেকের পছন্দ, সেখানে উপেক্ষিত শান্ত বলদ। ছবি : জীবন আমির

প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাদের চোখে কারণ

যখন থেকে ভারবাহী পশুর প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়েছে, তখন থেকেই বলদের সংখ্যা কমতে শুরু করেছে, বললেন বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রাণী উৎপাদন গবেষণা বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. সরদার মোহাম্মদ আমানুল্লাহ।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এখন আর ভারী কাজ করার জন্য পশুদের ওপর নির্ভরশীল নয় মানুষ। একারণেই বলদ লালন-পালন কমেছে। বলদের মতো মহিষ, ঘোড়া ও গাধার সংখ্যাও তাই কমেছে।”

এর সঙ্গে বলদ পোষার খরচে বেশি হওয়ার বিষয়টিও যোগ করেন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক (সম্প্রসারণ) ডা. মো. শাহিনুর আলম।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ষাঁড়ের তুলনায় বলদ গরু খাবার বেশি খায়। কিন্তু সেই তুলনায় মাংস হয় কম। অর্থাৎ একই পরিমাণ খাবার খাওয়ালে ষাঁড়ের যে পরিমাণ মাংস হবে, বলদের ততটা হবে না।”

কোরবানির হাটে বলদের সংখ্যা কমে যাওয়া নিয়ে শাহিনুর বলেন, “এখন কেউ বলদ গরু কোরবানি দিতে চায় না। মানুষ ষাঁড় গরুই পছন্দ করেন বেশি। কারণ বলদের থেকে ষাঁড় দেখতে আকর্ষণীয় হয়। ষাঁড় গরু চঞ্চলতাসহ বিভিন্ন কারণে ক্রেতাদের পছন্দের শীর্ষে থাকে।”

ষাঁড় পালনের চেয়ে বলদ পালনে ঝামেলা অনেক কম হলেও চাহিদা কমে যাওয়ায় খামারিরাও এতে আগ্রহী হচ্ছেন না, বলেন তিনি।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত