খারাপ আবহাওয়া এবং বহনক্ষমতার অতিরিক্ত দুজন যাত্রী বহনের কারণেই ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির হেলিকপ্টারটি বিধ্বস্ত হয়েছিল।
ইরানের নিরাপত্তা সূত্রের বরাতে বুধবার এক প্রতিবেদনে দেশটির বার্তা সংস্থা ফার্স নিউজ এই খবর দিয়েছে।
এ বিষয়ে অবগত একটি সরকারি সূত্রের বরাতে প্রতিবেদনে বলা হয়, “নিরাপত্তা এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এই ঘটনার বিষয়ে তাদের তদন্ত শেষ করেছে। তদন্তের পর তারা নিশ্চিত হয়েছে যে, এটি নিছকই একটি দুর্ঘটনা ছিল।”
গত ১৯ মে ইরানের পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশের পাহাড়ি এলাকায় হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় মারা যান ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি।
ঝড়ো বাতাসের সঙ্গে ভারি বৃষ্টিপাত এবং ঘন কুয়াশার কারণে হেলিকপ্টারটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পাহাড়ি বনে বিধ্বস্ত হয়।
সেদিন কুয়াশার কারণে সেখানে ১৫ ফুটের বেশি দূরত্বেও কিছু দেখা যাচ্ছিল না। আর এ কারণেই চালক হেলিকপ্টারটির নিয়ন্ত্রণ হারান।
দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে এমনকি পরের দিন পর্যন্ত উদ্ধারকারীরাও দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে পারেননি। ফলে হেলিকপ্টারটিতে থাকা কাউকে আর জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। এতে দুর্ঘটনার কারণ নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়।
বিধ্বস্ত হওয়া হেলিকপ্টারে ইরানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আবদুল্লাহিয়ান, পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশের গভর্নর মালেক রাহমাতি ও সেই প্রদেশে ইরানের সর্বোচ্চ নেতার মুখপাত্র আয়াতুল্লাহ মোহাম্মদ আলী আলে-হাশেমসহ ৯ জন যাত্রী ছিলেন।
প্রেসিডেন্ট রাইসি যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি বেল ২১২ মডেলের একটি হেলিকপ্টারে ভ্রমণ করছিলেন। আর এটাও দুর্ঘটনার একটি বড় কারণ বলে ধারণা করা হয়।
এই হেলিকপ্টারগুলো যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের মহাকাশ কোম্পানি বেলের তৈরি। বেল এই মডেলের হেলিকপ্টার প্রথম আকাশে উড়ায় ১৯৭১ সালে। তার কয়েক বছর পরই ইরান বেল ২১২ মডেলের কয়েকটি হেলিকপ্টার কিনে। সেসময় ইরানে ক্ষমতায় ছিল শাহ রাজবংশ।
কিন্তু ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দেশটির সম্পর্কের ফাটল বাড়তে থাক। যুক্তরাষ্ট্র একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে দেশটির ওপর।
ফলে ইরানের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বেল ২১২ হেলিকপ্টারের নতুন যন্ত্রাংশ বা নতুন হেলিকপ্টার জোগাড় করা কঠিন হয়ে পড়ে। এতে হেলিকপ্টারগুলো পুরোনো এবং অকেজো হয়ে পড়তে থাকে। আর এ কারণেও দুর্ঘটনাটি ঘটে থাকতে পারে বলে ধারণা করা হয়।
রাইসির মৃত্যু আঞ্চলিক যুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি করেছিল। কারণ যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন ছিল যে, ইরান হয়তো ইসরায়েলকে দায়ী করবে। ওই দুর্ঘটনার মাত্র একমাস আগে ইরান ইসরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করেছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন পরিস্থিতিকে আরও তাঁতিয়ে তুলেছিলেন এই বলে যে, রাইসিকে ছাড়াই ইরানীরা বেশি ভালো থাকবে।
দুর্ঘটনার কারণ নিয়ে তদন্তে ৩০ হাজার মানুষের বিষয়ে খোঁজ খবর নেওয়া হয়েছে। কিন্তু কারও কোনও মানবিক ত্রুটি বা নাশকতার প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
ফলে তদন্তকারীরা উপসংহারে পৌঁছেছেন যে, রাইসিকে বহনকারী হেলিকপ্টারটি বহন ক্ষমতার চেয়ে বেশি যাত্রী বহন করায় খুব বেশি ভারী হয়ে পড়েছিল।
তদন্তের চুড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তাব্রিজে ফেরার পথে পাইলট যখন ঘন কুয়াশার সম্মুখীন হন, তখন তিনি এর উপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু আরও উপরে ওঠার জন্য ইঞ্জিনগুলোর যথেষ্ট শক্তি ছিল না। বিমানটি তখন সামনের একটি পাহাড়ে আঘাত হানে, যেটি কুয়াশার কারণে দেখা যায়নি।
তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, রাইসি সেদিন নির্ধারিত সময়ের চেয়ে দেরিতে যাত্রা শুরু করেছিলেন। এতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসায় তারা কুয়াশা ও বৃষ্টিপাতের কবলে পড়েন।
ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি সেদিন আজারবাইজানের সীমান্তবর্তী এলাকায় দুই দেশের যৌথভাবে নির্মিত একটি বাঁধ ও জলাধার উদ্বোধন করতে গিয়েছিলেন। আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভও সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
বাঁধ ও জলাধার উদ্বোধন শেষে তিনটি হেলিকপ্টারের একটি বহর নিয়ে ইরানের পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশের রাজধানী তাবরিজে ফিরছিলেন ইব্রাহিম রাইসি ও তার সঙ্গে থাকা অন্য কর্মকর্তারা। প্রেসিডেন্ট রাইসিকে বহনকারী হেলিকপ্টারটি বিধ্বস্ত হলেও বাকি দুটি হেলিকপ্টার নিরাপদেই গন্তব্যে পৌঁছায়।
কট্টরপন্থী প্রেসিডেন্ট রাইসির মৃত্যুর পর ইরান তড়িঘড়ি নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ডাক দেয়। জুলাইয়ে অনুষ্ঠিত সেই নির্বাচনে অপেক্ষাকৃত মধ্যপন্থী হিসাবে বিবেচিত মাসুদ পেজেশকিয়ান দেশটির প্রেসিডেন্ট হন। এতে ইরানে কিছুটা পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে।