Beta
শুক্রবার, ১৬ মে, ২০২৫
Beta
শুক্রবার, ১৬ মে, ২০২৫

কমিটি বিলুপ্ত হচ্ছে : কীভাবে চলবে চট্টগ্রাম চেম্বার

ss-ccci-logo-02092024
[publishpress_authors_box]

চট্টগ্রাম চেম্বারের পরিচালনা পর্ষদ থেকে ২৪ পরিচালকের সবাই পদত্যাগ করেছেন। ২৮ আগস্ট দুইজন পরিচালক, এরপর রবিবার ১০ জন এবং সোমবার বাকি ১২ পরিচালক পদত্যাগ করেছেন।

তিন দফায় সব পরিচালক পদত্যাগের পর চেম্বারের নির্বাহী কমিটি বিলুপ্ত করার আবেদনও করা হয়েছে। নির্বাহী কমিটি বিলুপ্ত হলে চট্টগ্রাম চেম্বার কীভাবে, কার নেতৃত্বে পরিচালিত হবে- এখন দেখা দিয়েছে সে প্রশ্ন।

চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (সিসিসিআই) ২০২৩ সালের নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়ে দায়িত্ব নেওয়ার এক বছরের মাথায় ২৪ পরিচালকের সবাই পদত্যাগ করলেন। ১১৮ বছরের ঐতিহ্যবাহী সংগঠন চট্টগ্রাম চেম্বারের ইতিহাসে এটি নজিরবিহীন ঘটনা।

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নতুন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে চট্টগ্রাম চেম্বার পরিচালনা পর্ষদের পদত্যাগের দাবি ওঠে।

চেম্বারের সদস্যরা বিভিন্ন ব্যানারে চেম্বারকে ‘পরিবারতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রমুক্ত’ করতে পরিচালক ও কমিটির পদত্যাগের আলটিমেটাম দেন। তার পরিপ্রেক্ষিতেই তারা একে একে সবাই পদত্যাগ করলেন।

পদত্যাগের বিষয়টির ‘ঝামেলমুক্ত সমাধানে’ এগিয়ে আসেন চেম্বারের সাবেক সভাপতি আমির হুমায়ুন মাহমুদ চৌধুরী।

চেম্বার নেতারা বলছেন, সব পরিচালক যদি পদত্যাগ করেন, নির্বাহী কমিটি যদি বিলুপ্ত হয় তাহলে চেম্বার পরিচালনার ভার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বাণিজ্য সংগঠন অনুবিভাগের (ডিটিও) কাছে বর্তায়। কারণ দেশের সব চেম্বার পরিচালিত হয় ট্রেড অর্গানাইজেশন রুলস (টিও রুলস) অনুযায়ী।

চট্টগ্রাম চেম্বার সচিব প্রকৌশলী মোহাম্মদ ফারুক সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “সোমবার বিকাল নাগাদ ২৪ পরিচালকের সবাই পদত্যাগ করেছেন। এরপর চেম্বার সভাপতি কার্যনির্বাহী কমিটি বিলুপ্ত করে প্রশাসক নিয়োগের জন্য আবেদন পাঠিয়েছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বাণিজ্য সংগঠন অনুবিভাগে (ডিটিও)। সোমবার বিকালে ইমেইলে সেটি পাঠানো হয়েছে। মঙ্গলবার সকালে মূল কপি পাঠানো হবে। বাকি পদক্ষেপ তারাই নিবেন।”

কবে নাগাদ সেই প্রশাসক নিয়োগ করা হবে সে সম্পর্কে কোনও সময়সীমা নেই আইনে। প্রশাসক নিয়োগ হওয়ার পর ১২০ দিনের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে তার।

প্রশাসক নিয়োগ হওয়ার আগ পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ সব কাজ চট্টগ্রাম চেম্বার সচিবালয় চালাবে জানিয়ে চেম্বার সচিব বলেন, তবে আর্থিক বিষয় অনুমোদন, সদস্যদের প্রতিদিনের সনদ ইস্যু চেম্বার বোর্ড বা প্রশাসকের অনুমতি ছাড়া চলবে না। তাই দ্রুত প্রশাসক নিয়োগ হওয়া উচিত।

আগ্রাবাদে চট্টগ্রাম চেম্বারের অর্থায়নে নির্মিত দেশের প্রথম ও একমাত্র ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার। এই ভবনেই চট্টগ্রাম চেম্বারের প্রধান কার্যালয়।

বলা হচ্ছে, টিও রুলস অনুযায়ী বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে একজন কর্মকর্তাকে প্রশাসক নিয়োগ করেই পরবর্তী কার্যক্রম পরিচালিত হবে। তারাই চেম্বার পরিচালনা ও ভোটার তালিকা প্রণয়ন করে একটি সু্ষ্টু ভোট নিশ্চিত করবেন। দৈনন্দিন চেম্বারের সব কাজ তার অধীনেই পরিচালিত হবে।

এ বিষয়ে জানতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক (বাণিজ্য সংগঠন) ড. নাজনীন কাউসার চৌধুরীকে মোবাইলে ফোন করা হয়। তার সাড়া পাওয়া যায়নি।

চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক সভাপতি আমীর হুমায়ুন মাহমুদ চৌধুরী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “শেষ পর্যন্ত আমি সবাইকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছি এবং সবাই কথা রেখেছেন। ফলে কোনও ঝামেলা ছাড়াই ২৪ পরিচালক পদত্যাগ করেছেন।

“এখন সরকার কাকে প্রশাসক নিয়োগ করবে- তার ওপর নির্ভর করছে পরবর্তী পদক্ষেপ। সরকার যদি একজন সরাসরি আমলাকে নিয়োগ দেন তাহলে তার পক্ষে এই বিশাল চাপ ধৈর্য ধরে সামাল দেওয়া অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং হবে। আবার ট্রেডবডি রিলেটেড একজনকে নিয়োগ দিলে তার জন্য বিষয়টি তুলনামূলক সহজ হবে।”

বিশাল ওই চাপের ব্যাখ্যায় চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক সভাপতি আমীর হুমায়ুন মাহমুদ চৌধুরী বলেন, “অনেক বছর ধরেই এখানে সঠিক ভোটার তালিকা করা হয়নি। অনেক পুরনো ব্যবসায়ী আছেন যাদের সদস্যপদ নবায়ন করা হয়নি। আবার নতুনদের মধ্যে যারা সদস্য হতে চেয়েছেন তাদের মধ্যে নিজেদের পক্ষে থাকবেন, এমন লোককে সদস্যপদ দেওয়া হয়েছে।”

বর্তমান ভোটার তালিকা যাচাই করতে বেশ সময় লাগবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “সদস্যদের জমা দেওয়া টিআইএন সনদের সঠিকতা যাচাই করতে হবে। জমা পড়া ট্রেড লাইসেন্স সঠিক কিনা যাচাই ও নবায়ন হয়েছে কিনা দেখতে হবে। তাতে ভুল ধরা পড়লে সেই ভোটার বাতিল করতে হবে। এই কাজগুলো প্রশাসক কতটা ধৈর্য্য ধরে করবেন, তার ওপর নির্ভুল ভোটার তালিকা নিশ্চিত হবে। আর সেই নির্ভুল তালিকার ওপর নির্ভর করছে একটি সুষ্ঠু ভালো ভোট।”

বাংলাদেশে থাইল্যান্ডের অনারারি কনসাল আমীর হুমায়ুন চৌধুরী বলেন, “আমরা আগে দেখেছি গোঁজামিল করে ভোটার তালিকা দিয়ে নির্বাচনে সুফল মেলেনি। ফলে এবারও সেটি হোক কেউই আমরা চাইবে না। প্রশাসক যাকেই নিয়োগ দেবে তার সাথেই আমরা কাজ করব।”

সংস্কার করেই নির্বাচন দাবি

চট্টগ্রাম চেম্বারের ইতিহাস ১১৮ বছরের। ঐতিহ্যবাহী এই সংগঠনে ২০০৮ সালে প্রথম মেয়াদে সভাপতি হন এমএ লতিফ। দ্বিতীয় মেয়াদে ২০১২ সাল পর্যন্ত তিনি সভাপতি ছিলেন।

চট্টগ্রাম চেম্বারে ২০১৩ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত টানা পাঁচবার সভাপতি ছিলেন মাহবুবুল আলম। ২০২৪ সালে এফবিসিসিআই সভাপতি নির্বাচিত হলে চট্টগ্রাম চেম্বার ছেড়ে দেন তিনি।

অভিযোগ রয়েছে, সেই থেকে এই দুই নেতার বলয়ের বাইরের কারও পরিচালক পদে নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ ছিল না।

২০১৩ সাল থেকেই চট্টগ্রাম চেম্বারের নেতৃত্ব নির্ধারণ করে দিয়ে আসছিলেন সাবেক সভাপতি এম এ লতিফ। তার বলয়ের বাইরে কারও পরিচালক পদে নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ হয়নি সংগঠনটিতে। সেই থেকে চট্টগ্রাম চেম্বার নেতৃত্ব বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে আসছিলেন।

জানতে চাইলে ‘সাধারণ ব্যবসায়ী সমাজ’ এর ব্যানারে ‘সংস্কার আন্দোলনে’ নেতৃত্ব দেওয়া চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি এস এম নুরুল হক সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমাদের প্রধান দাবি ছিল বর্তমান চেম্বারে থাকা পরিবারতন্ত্রের অবসান করে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করা। এখন পদত্যাগ করে তাদের শুভবুদ্ধির পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু বিদ্যমান ভোটার তালিকায় নির্বাচন করলে হবে না।”

তিনি বলেন, “বর্তমান তালিকা থেকে ভুয়া ভোটার বাতিল করতে হবে। নতুন যারা ভোটার হতে চান তাদের সদস্যপদ দিতে হবে। সেই কাজ করতে প্রয়োজনে বেশি সময় লাগুক, আমরা দিতে রাজি আছি। এই তালিকায় ভোট হলে আবার সেই পরিবারতন্ত্রই আসবে। একইসাথে চেম্বারে গত ১৬ বছরে যত অনিয়ম হয়েছে সেগুলোর তদন্ত করতে হবে।”

চট্টগ্রাম চেম্বারে ২০২৩ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন ২৪ পরিচালক। তাদের প্রায় সবাই দুই নেতার বলয়ের ও পরিবারের সদস্যদের। নির্বাচনে পরিবারতন্ত্রের জের ধরে কমিটি থেকে পদত্যাগ করেছিলেন প্যাসিফিক জিন্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর।

এ নিয়ে বেশ তোলপাড় হয়, হৈ চৈ পড়ে যায় ব্যবসায়ী মহলে। চট্টগ্রাম চেম্বারের ১১৮ বছরের ইতিহাসে সেটি ছিল প্রথম ঘটনা। পরিস্থিতি শান্ত হলে এম এ লতিফের আত্নীয়তার সুবাদে সেই পরিচালক পদে বিনা ভোটে নির্বাচিত করে নিয়ে আসেন ওয়েল গ্রুপের পরিচালক সৈয়দ নজরুল ইসলামকে। যিনি এখন বিজিএমইএর প্রথম সহ সভাপতি।

চট্টগ্রাম চেম্বারের কমিটিতে এম এ লতিফের ছেলে ওমর হাজ্জাজ সভাপতি ও ওমর মুক্তাদির পরিচালক ছিলেন। এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলমের মেয়ে রাইসা মাহবুব ছিলেন সহ সভাপতি এবং ভাই আলমগীর পারভেজ ছিলেন পরিচালক। কমিটিতে পরিচালক ছিলেন নির্বাচনী বোর্ডের প্রধান নুরুন নেওয়াজ সেলিমের মেয়ের জামাই বেনাজির চৌধুরী নিশান ও ছেলে মোহাম্মদ সাজ্জাদ উন নেওয়াজ।

অভিযোগ রয়েছে, দীর্ঘদিন ধরেই ঘুরে ফিরে নির্ধারিত কয়েকজন ব্যবসায়ী সেই বলয়ে থেকেই পরিচালক নির্বাচিত হয়েছেন। এ নিয়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে অনেক ক্ষোভ ছিল। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সেই ক্ষোভের বিষয়টি প্রথম প্রকাশ্যে আসে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত