গাজায় ইসরায়েলের অভিযান বন্ধের দাবিতে গত প্রায় একমাস ধরে তুমুল বিক্ষোভ চলছে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। কলাম্বিয়া থেকে শুরু হওয়া ওই বিক্ষোভ হার্ভার্ড, এমআইটি, প্রিন্সটনসহ ৬০টিরও বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়েছে।
এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের সীমানা পেরিয়ে বিক্ষোভের ঢেউ লেগেছে যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের দেশগুলোতেও। সেই বিক্ষোভের ঢেউ এবার লাগল সাইবার স্পেসে। কয়েকদিন ধরে অনলাইন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে একটি ইসরায়েলবিরোধী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রধান দাবি, ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্কে থাকা কোম্পানি বা সংস্থাগুলোর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সম্পর্ক ছিন্ন করা। আর এই অনলাইন আন্দোলনে গাজায় ইসরায়েলের হত্যাযজ্ঞ নিয়ে চুপ থাকা বা ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন জানানো সেলেব্রিটি বা বিখ্যাত তারকাদের বয়কটের আহ্বান জানানো হচ্ছে।
হলিউড তারকা থেকে শুরু করে সোশ্যাল মিডিয়া তারকা বা ইনফ্লুয়েন্সারদেরও এই বয়কটের তালিকায় রাখা হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ফ্যাশন ও লাইফস্টাইল ম্যাগাজিন ভোগ আয়োজিত গত ৬ মের মেট গালার পর থেকে এই আন্দোলনের শুরু। আন্দোলনের নাম দেওয়া হয়েছে ‘ব্লকআউট ২০২৪’। এর ধারণাটি হল- সোশ্যাল মিডিয়া নেটওয়ার্ক যেমন- ইনস্টাগ্রাম, এক্স ও টিকটকে সেলেব্রিটিদের অ্যাকাউন্ট বা পেজ ব্লক করা, যারা ইসরায়েলের হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে কিছুই বলছেন না। সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে ওই সেলেব্রিটিদের আয়-রোজগার কমানো এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য।
মেট গালায় কী এমন ঘটেছে, যার জন্য এই আন্দোলন শুরু হল? এর সঙ্গে ফরাসি বিপ্লবের তুলনাই বা করা হচ্ছে কেন? কোনও সেলেব্রিটিকে ব্লক করলে তার ঠিক কতটা ক্ষতি হয়? আন্দোলনটির কি আদৌ কোনও প্রভাব পড়ছে? আসুন খুঁজি এসব প্রশ্নের উত্তর।
এবছরের মেট গালা কেন বিতর্কিত
গত ৬ মে নিউ ইয়র্কে অনুষ্ঠিত এবছরের মেট গালার প্রতিক্রিয়ায়ই মূলত এই ব্লকআউট ২০২৪ আন্দোলন শুরু হয়। মেট গালায় আসা সেলেব্রিটিদের অনেক দামী পোশাক পরা ছবি অনলাইনে প্রকাশিত হলে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। আর তা থেকেই এই আন্দোলনের সূচনা।
আন্দোলনকারীদের মতে, গাজায় ইসরায়েলের হত্যাযজ্ঞ চলাকালে তারকাদের এমন বিলাসব্যাসন প্রদর্শনী অনৈতিক। এই সেলেব্রিটিদের মধ্যে আবার কেউ কেউ ইসরায়েলের হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে কখনোই অনলাইনে কোনও বিবৃতি দেননি বা পোস্টও করেননি।
মেট গালার অপর নাম কস্টিউম ইনস্টিটিউট বেনিফিট। নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটনের মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অফ আর্টসের কস্টিউম ইনস্টিটিউটের তহবিল সংগ্রহের জন্য অনুষ্ঠানটির আয়োজন করা হয়। মেট গালা বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ ও গ্ল্যামারাস ফ্যাশন ইভেন্ট এবং সামাজিক সমাবেশ হিসেবে বিবেচিত। একে ‘ফ্যাশনের সবচেয়ে বড় রাত’ নামেও আখ্যায়িত করা হয়। সেলেব্রিটিরা এই অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ পেতে মুখিয়ে থাকেন।
ফ্যাশন, ফিল্ম, টেলিভিশন, সঙ্গীত, থিয়েটার, ব্যবসা, খেলাধুলা, সোশাল মিডিয়া ও রাজনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের যে সমস্ত ব্যক্তিত্বকে সমসাময়িক সমাজের সঙ্গে সাংস্কৃতিকভাবে প্রাসঙ্গিক বলে মনে করা হয়, তাদের মেট গালাতে যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়।
বিশ্বের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র নিউ ইয়র্ক সিটিতে এই আয়োজন দেখার জন্য এবার একটি টিকেটের দাম ছিল ৭৫ হাজার ডলার। ২০২৩ সালে যা ছিল ৫০ হাজার ডলার।
মেট গালার বিরুদ্ধে ক্ষোভ এবারই প্রথম নয়। বিশ্বব্যাপী ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের মধ্যেও ব্যাপক বিলাসব্যসনের প্রদর্শনীর কারণে মেট গালার বিরুদ্ধে এর আগেও বহুবার ক্ষোভ তৈরি হয়েছে।
‘ওরা তো কেক খেলেই পারে’
গত ৭ মে টিকটকে ইনফ্লুয়েন্সার হ্যালি কালিলের একটি ভিডিও প্রকাশিত হয়, যেখানে তাকে মজা করে ‘লেট দেম ইট কেক’ বা ‘ওরা তো কেক খেলেই পারে’ উক্তিটির একটি অডিওর সঙ্গে ঠোঁট মেলাতে দেখা যায়। কালিলের টিকটক অ্যাকাউন্টে ৯৯ লাখ ফলোয়ার রয়েছে।
‘ওরা তো কেক খেলেই পারে’ এই উক্তিটির সঙ্গে ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাস জড়িত। কথাটি ফরাসি বিপ্লবের সময়ে ফ্রান্সের তখনকার রানি মারি অঁতোয়ানেত বলেছিলেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে।
ফরাসি বিপ্লবের আগে রাজা ষোড়শ লুইয়ের সময় ফ্রান্সে প্রচণ্ড খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছিল। এমনকি সাধারণ মানুষ রুটিও খেতে পাচ্ছিলো না। বিষয়টি রানিকে বলা হলে তিনি নাকি বলেছিলেন, ‘রুটি নাই তো কী হয়েছে, ওরা তো কেক খেলেই পারে।’ রানি ঠিক কেকের কথাও বলেননি। তিনি ফরাসি ভাষায় ব্রোচে নামের এক ধরনের রুটির কথা বলেছিলেন, যা ডিম ও মাখন দিয়ে বানানো হতো। ইংরেজিতে কথাটি কেক হয়ে যায়। কথাটি বাংলায় ‘ভাত না পেলে পোলাও খাবে’ উক্তিটির মতো।
রানি অঁতোয়ানেত আসলেই কথাটি বলেছিলেন কি না, তার কোনও ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই। তবে অজনপ্রিয় এই রানির মুখে এই কথাটি লেগে আছে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে ফরাসি বিপ্লবের সময় থেকেই।
যাই হোক, গত ৭ মাসেরও বেশি সময় ধরে ইসরায়েলের হামলা ও অবরোধের ফলে ফিলিস্তিনের গাজায়ও চরম খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। এমন পটভূমিতে কালিলের ভিডিওটি ক্ষোভ জাগিয়েছে।
মেট গালার মাত্র দুই দিন আগে গত ৪ মে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) প্রধান সিন্ডি ম্যাককেইন এক সংবাদ সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, উত্তর গাজায় পুরো মাত্রার দুর্ভিক্ষ শুরু হয়েছে।
অনলাইন আন্দোলনকারীরা এখন ব্লকআউটকে ‘ডিজিটাইন’ বা ‘ডিজিটাল গিলোটিন’ বলা শুরু করেছে। ফরাসি বিপ্লবের সময় বিপ্লবীরা অভিজাতদের ধরে ধরে প্রকাশে গিলোটিনে চড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করত।
ব্লকআউট আন্দোলনকারীরা সেলেব্রিটিদের আইডি ও পেজ ধরে ধরে ব্লক করতে চাইছে।
কালিল তার টিকটক অ্যাকাউন্টে ১০ মে আরেকটি ভিডিও প্রকাশ করে ক্ষমা চান। ভিডিওটিতে তিনি বলেন, মেট গালায় তাকে আসলে আমন্ত্রণ করা হয়নি, তিনি শুধু নিউজের হোস্ট হিসেবে ইভেন্টটিতে যোগ দিয়েছিলেন।
‘ওরা তো কেক খেলেই পারে’ এই উক্তির যে অডিওটি তিনি তার প্রথম ভিডিওতে ব্যবহার করেছেন, তার পক্ষে কালিল বলেন, এটি টিকটকের একটি ট্রেন্ডিং অডিও।
গাজায় যা ঘটছে তা নিয়ে কেন কথা বলছেন না সেই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “বিষয়টি নিয়ে অর্থপূর্ণ বা শিক্ষামূলকভাবে কথা বলার জন্য আমার যথেষ্ট জ্ঞান ও জানাশোনা নেই।” এমনকি তিনি ভিডিওটিতে ‘ফিলিস্তিন’ বা ‘গাজা’ বা ‘ইসরায়েল’ এমন কোনও শব্দও উচ্চারণ করেননি।
ব্লক করলে সেলেব্রিটিরা কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন
কালিল ছাড়াও ব্লকআউট আন্দোলনের তালিকায় ইসরায়েলি বংশোদ্ভুত হলিউড অভিনেত্রী ও সাবেক সৈনিক গল গ্যাডোট; মার্কিন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, ব্যবসায়ী ও মডেল- অভিনেত্রী কিম কারদাশিয়ান; হলিউড অভিনেত্রী জেন্দায়া ও অভিনেতা নোয়াহ স্ন্যাপ এবং গায়িকা টেইলর সুইফট ও ব্রিটিশ গায়ক হ্যারি স্টাইলসের মতো তারকারাও রয়েছেন।
অতীতে বিভিন্ন বিষয়ে অনেক সেলেব্রিটির বিরুদ্ধে তাদের পেজ বা আইডি আনফলো করার মাধ্যমে আন্দোলন হয়েছে, যাদের এখন ব্লক করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আনফলো করার চেয়ে ব্লক করা প্রতিবাদের কৌশল হিসেবে আরও বেশি কার্যকর।
কাতারের নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক এডি বোর্গেস-রে আল জাজিরাকে বলেন, একজন সেলেব্রিটির সামগ্রিক অডিয়েন্স ও এনগেজমেন্ট ম্যাট্রিক্সে আনফলো করার প্রভাব খুব কমই পড়ে। বোর্গেস-রে তার গবেষণায় সোশাল মিডিয়া ও অ্যালগরিদম নিয়ে পরীক্ষা চালান।
তিনি বলেন, “সোশাল মিডিয়া সেলেব্রিটিদের কনটেন্টগুলোতে বিজ্ঞাপন আসে সেগুলোর ভিউ ও এঙ্গেজমেন্টের ওপর ভিত্তি করে। কেউ যখন কোনও সেলেব্রিটিকে আনফলো করে, তখন তারা শুধু তাদের নিউজ ফিডেই ওই সেলেব্রিটির পোস্ট দেখতে পান না। কিন্তু সেই সেলেব্রিটির কনটেন্টগুলো তাদের সার্চ পেজ বা অ্যালগরিদম-চালিত ফিড যেমন, ইনস্টাগ্রাম এক্সপ্লোর পেজ বা টিকটক ও এক্সের ‘ফর ইউ’ পেজের মাধ্যমে তাদেরকে পরোক্ষভাবে দেখানো হতে পারে।
তার মানে কোনও সেলেব্রিটিকে ব্লক না করে শুধু আনফলো করলেও সেই সেলেব্রিটির কনটেন্ট দেখা যেতে পারে এবং এতে তার ভিউ বা এঙ্গেজমেন্টেরও খুব বেশি ক্ষতি হয় না।
“অন্যদিকে যদি কেউ কোনও সেলেব্রিটিকে ব্লক করে, তাহলে তারা তাদের কনটেন্টের সঙ্গে সমস্ত মিথষ্ক্রিয়া সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেয়,” বলেন বোর্হেস-রে।
এতে সেই সেলেব্রিটির কনটেন্টের অডিয়েন্স ও এঙ্গেজমেন্ট কমে যায়, ফলে সোশ্যাল মিডিয়া অ্যালগরিদমগুলোও তার কনটেন্টকে আর বেশি দেখায় না। কোনও সোশাল মিডিয়ায় যত বেশি লোক একজন সেলেব্রিটিকে ব্লক করবে তার পোস্টগুলো সেই প্ল্যাটফর্মে তত কম দেখাবে, এমনকি যারা সেই সেলেব্রিটিকে ব্লক করেননি, তাদের কাছেও কম দেখাবে।
বোর্হেস-রে বলেন, “কোনও সেলেব্রিটির কনটেন্ট কম দেখালে বিজ্ঞাপনদাতারাও সেই সেলেব্রিটিকে কম মূল্যবান ও কম জনপ্রিয় মনে করেন। এতে বিজ্ঞাপনদাতারা সেই সেলেব্রিটির প্রোফাইলে বিজ্ঞাপনের জন্যও খুব বেশি টাকা দিতে চাইবেন না। ফলে সেই সেলেব্রিটির বিজ্ঞাপন থেকে প্রাপ্ত আয়ও কমে যাবে।”
ব্লকআউট আন্দোলনে কতটা সাড়া
অনেকেই এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন। অনেকে আবার একে শুধু পারফরমেটিভ অ্যাকটিভিজম বা মেকি তথা লোক দেখানো তৎপরতা বলে আখ্যা দিয়েছেন। মানে তাদের মতে, আন্দোলনকারীরা এর মধ্য দিয়ে আসলে শুধু নিজেদের সামাজিক পরিচিতি বাড়াতে ও বাহবা কুড়াতে চাইছেন। কিন্তু বাস্তবে তাদের আসলে গাজার মানুষদের জন্য কিছু করার সাহস বা জোরালো সদিচ্ছা ও নিষ্ঠা নেই।
কেউ কেউ আবার এমন সন্দেহও প্রকাশ করেছেন, ব্লকআউট সম্পর্কিত পোস্টগুলো সোশাল মিডিয়ায় জ্যাম লাগিয়ে ফিলিস্তিনে আসলে কী ঘটছে, সে সম্পর্কে হালনাগাদ তথ্য থেকে মনোযোগ সরিয়ে দিচ্ছে। এমনকি এতে গাজার জন্য তহবিল সংগ্রহকারীদের পোস্টগুলোও সাধারণ ইউজারদের সামনে আসতে পারছে না বলে অভিযোগ করেছেন অনেকে।
ব্লকআউট আন্দোলনের কী প্রভাব
ব্লকআউট আন্দোলন মাত্র কয়েকদিন আগে শুরু হয়েছে। এ ছাড়া সোশাল মিডিয়ায় কোনও অ্যাকাউন্টকে ব্লক করা ইউজারদের সংখ্যাও দেখা যায় না। তবে অনেক সেলেব্রিটিরই ফলোয়ার কমে যাওয়ার বিষয়টি চোখে পড়ছে।
শনিবার এনপিআরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত এক সপ্তাহে টেইলর সুইফট টিকটকে প্রায় ৩ লাখ ফলোয়ার হারিয়েছেন। আর ইনস্টাগ্রামে হারিয়েছেন ৫০ হাজার ফলোয়ার।
এক এক্স ব্যবহারকারী পোস্ট করেছেন, “তারা [সেলেব্রিটিরা] আমাদের মনোযোগের ওপর ভিত্তি করেই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকেন। আমরা যদি তাদের প্রতি মনোযোগ দেওয়া বন্ধ করে দিই, তাহলে তাদের আর কোনও প্রভাব থাকবে না এবং তাদের আয়-রোজগারও কমে যাবে।”
তথ্যসূত্র : আল জাজিরা