অর্থনীতির সবচেয়ে উদ্বেগজনক সূচক মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে নীতি সুদহার (পলিসি রেট বা রেপো রেট) আরেক দফা বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এতদিন এই হার ছিল ৯ দশমিক ৫০ শতাংশ। তা থেকে ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো রেপো রেট দুই অঙ্কের (ডাবল ডিজিট) ঘরে উঠল। এতে সব ধরনের ব্যাংক ঋণের সুদের হার আরও বাড়বে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকাররা।
এছাড়া নীতি সুদের করিডরের ঊর্ধ্বসীমা ও নিম্নসীমাও বাড়ানো হয়েছে। নীতি সুদহারের ঊর্ধ্বসীমা স্ট্যান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটি (এসএলএফ) রেট ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ১১ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়েছে এবং নিম্নসীমা স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফ্যাসিলিটি (এসডিএফ) রেট ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৮ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়েছে।
২৭ অক্টোবর থেকে নতুন সুদের হার কার্যকর হবে বলে মঙ্গলবার এক সার্কুলারে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
সবশেষ এক মাস আগে গত ২৪ সেপ্টেম্বর নীতি সুদহার ৯ শতাংশ থেকে ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৯ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়েছিল। এসএলএফ রেট ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ১১ শতাংশ করা হয়েছিল। এসডিএফ রেট ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে করা হয়েছিল ৮ শতাংশ।
তার আগে ২৫ আগস্ট রেপো রেট ৮ দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৯ শতাংশ করা হয়। এসএলএফ রেট ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ১০ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়েছিল। এসডিএফ রেট ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে করা হয়েছিল ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ।
গত ৮ মে নীতি সুদহার ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৮ দশমিক ৫ শতাংশ করা হয়। এসএলএফ রেট ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়। এসডিএফ রেট ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৭ শতাংশ করা হয়।
২০২২ সালের মে মাস থেকে বেশ কয়েকবার নীতি সুদহার বাড়াল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
মূল্যস্ফীতির পারদ নামাতে নীতি সুদহার আরও বাড়ানো হবে বলে গত ২৩ সেপ্টেম্বর সংবাদ সম্মেলননে ঘোষণা দিয়েছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর।
তিনি বলেছিলেন, “আগস্টে মূল্যস্ফীতি খানিকটা কমলেও সাড়ে ১০ শতাংশে অবস্থান করছে। এতে মানুষ খুব কষ্ট পাচ্ছে। আমাদের প্রধান অগ্রাধিকার হচ্ছে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা। আর সেজন্য এই সূচক কমানোর অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে নীতি সুদহার আরও বাড়নো হবে। চলতি সপ্তাহেই এক দফা বাড়ানো হবে। আগামী মাসে আরেক দফা বাড়ানো হবে।”
গভর্নরের ঘোষণার একদিনের মাথায় ২৪ সেপ্টেম্বর নীতি সুদহারের পাশাপাশি এসএলএফ ও এসডিএফ রেট ৫০ বেসিস পয়েন্ট করে বাড়ানো হয়। এক মাস না যেতেই এই তিন ধরনের সুদের হার আরও ৫০ বেসিস পয়েন্ট করে বাড়ানো হলো।
মুদ্রানীতিতে সংকোচনমূলক পদক্ষেপ অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে নীতি সুদহার বাড়ানো হয়েছে বলে মঙ্গলবারের সার্কুলারে উল্লেখ করা হয়।
সেখানে বলা হয়, গত ২৫ আগস্ট মনিটরি পলিসি কমিটির পঞ্চম সভায় মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক অনুসৃত সংকোচনমূলক পদক্ষেপ অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্তের পেক্ষিতে মঙ্গলবার ওভারনাইট রেপো নীতি সুদহার, এসএলএফ রেট ও এসডিএফ রেট আরও ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়ানো হয়েছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ পাওয়ার অন্যতম প্রধান শর্ত ছিল ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাজারের উপর ছেড়ে দিতে হবে। একইসঙ্গে মূল্যস্ফীতি কমাতে নীতি সুদহার বাড়াতে হবে।
সেই শর্ত পূরণের অংশ হিসেবে নীতি সুদহার বাড়িয়ে চলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
নীতি সুদহার বাড়ার ফলে ব্যাংক ঋণের সুদের হারও বাড়ছে। বর্তমানে ব্যাংকগুলো ১৫ শতাংশ পর্যন্ত সুদে ঋণ বিতরণ করছে।
নতুন রেপো রেট কার্যকর হলে ঋণের সুদহার আরও বাড়বে বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে সকাল সন্ধ্যাকে জানিয়েছেন বেসরকারি এক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সবশেষ তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসওয়ারি বা মাসভিত্তিক) দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি এক লাফে বেড়ে ১১ শতাংশ ছাড়িয়ে ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশে উঠেছিল; খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ।
আগস্টে তা কমে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশে নামে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি নামে ১১ দশমিক ৩৬ শতাংশে।
সেপ্টেম্বরে তা আরও কমে সার্বিক মূল্যস্ফীতি এক অঙ্কে (সিঙ্গেল ডিজিট) ৯ দশমিক ৯২ শতাংশে নামে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি নামে ১০ দশমিক ৪০ শতাংশে।
সেপ্টেম্বর মাসে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ মূল্যস্ফীতির অর্থ হলো- গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে যে পণ্য বা সেবা ১০০ টাকায় পাওয়া যেত, এই বছরের সেপ্টেম্বরে সেই পণ্য বা সেবা পেতে ১০৯ টাকা ৯২ পয়সা খরচ করতে হয়েছে।
তবে চলতি মাসে বাজারে প্রায় প্রতিটি পণ্যের দাম বাড়ে। এ নিয়ে সমালোচনার মুখে সরকার কিছু পণ্যে আমদানি শুল্ক কমানোসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়। তাতে ডিমের মতো পণ্যের দাম কিছুটা কমে।
তবে বাজারে নতুন করে মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে চাল, ভোজ্যতেল, চিনি ও পেঁয়াজের। পণ্যগুলোর দাম কমাতে সরকার শুল্ক–করে ছাড় দিলেও এর সুফল এখনও বাজারে পড়েনি। এই চারটি পণ্যের দাম আরও বাড়ল এমন সময়ে, যখন বাজারে কোনও স্বস্তি নেই।
গত বছরের মার্চ থেকে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৯ শতাংশের উপরে অবস্থান করছে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে মূলত নীতি সুদহার বাড়ানো হয়। বিষয়টি এমন- কোনও দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি মনে করে সেই দেশের মানুষের হাতে অর্থের সরবরাহ বেশি এবং সেই বাড়তি অর্থের কারণে বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গিয়ে মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমূখী হয়, তাহলে অর্থপ্রবাহ কমাতে নীতি সুদহার বাড়ায় তারা।
নীতি সুদহার বৃদ্ধির অর্থ হলো- ব্যাংকগুলোকে অতিরিক্ত সুদ দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ করতে হবে। ফলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের যে ঋণ দেয়, তার সুদহার বাড়ে। নীতি সুদহার বেশি থাকলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ধার করতে নিরুৎসাহিত হয়।
নীতি সুদহার হলো রেপো। এর সঙ্গে রিভার্স রেপো রেটের আলোচনাও প্রাসঙ্গিকভাবে চলে আসে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি মনে করে বাজারে অতিরিক্ত তারল্য আছে, তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ওই তারল্য তুলে নিতে পারে। এই তুলে নেওয়ার জন্য সুদের নির্দিষ্ট হার থাকে।
অর্থ তুলে নেওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে যে হারে সুদ দেয়, তাকে বলা হয় রিভার্স রেপো। সাধারণত নীতি সুদহার বা রেপো রেটের তুলনায় রিভার্স রেপোর সুদহার কম থাকে।