নিউ ইয়র্কে ‘ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ’ আয়োজিত অনুষ্ঠানের মঞ্চে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পাশে থাকা এক তরুণকে নিয়ে আলোচনার ঝড় চলছে।
ওই তরুণ কীভাবে মঞ্চে ঠাঁই পেলেন, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার পর প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ওই তরুণকে অনুপ্রবেশকারী হিসাবে চিহ্নিত করেছেন তিনি।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্র সফরে রয়েছেন ড. ইউনূস। মঙ্গলবার নিউ ইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের প্রতিষ্ঠান ‘ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ’র অনুষ্ঠানে যোগ দেন তিনি।
অনুষ্ঠানে ড. ইউনূস বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের নানা দিক নিয়ে কথা বলার এক পর্যায়ে অনুষ্ঠানে উপস্থিত আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী তরুণদের মঞ্চে ডেকে নেন। তখনই মাহফুজ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আয়েশা সিদ্দিকা তিথির সঙ্গে ওই তরুণও মঞ্চে ওঠেন।
নিজের বিশেষ সহকারী মাহফুজকে জুলাই আন্দোলনের ‘কারিগর’ হিসাবে ক্লিনটনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন ড. ইউনূস।
সেই ছবি ও ভিডিওতে মঞ্চে ওই তরুণকে দেখে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, তিনি কীভাবে সেখানে ওঠার সুযোগ পেলেন?
প্রবাসী অনুসন্ধানী সাংবাদিক জুলকারনাইন শায়ের ফেইসবুকে ওই তরুণের পরিচয় দিয়ে লিখেছেন, “আওয়ামী সমর্থক ব্যবসায়ী রবিনটেক্স গ্রুপের মালিক, আবুল খায়ের মো. সাখাওয়াতের ছেলে জাহিন রোহান রাজিনকে গতকাল ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিশ্ব দরবারে সমন্বয়ক হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়ার সময় বেশ অবাকই হয়েছিলাম। হাজারের বেশি প্রাণের বিনিময়ে যে স্বৈরাচারকে বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা ঝেটিয়ে বিদায় করলো, সেই স্বৈরাচার সমর্থক এবং ওই দলের ডোনার ব্যক্তির সন্তানকে সমন্বয়ক হিসেবে স্টেজে তোলার আসল মাজেজাটা কী?”
জাহিনের সঙ্গে আওয়ামী লীগ আমলের স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলামের একটি ছবি দিয়ে নুরুল হক নুর নেতৃত্বাধীন গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ রাশেদ খান লিখেছেন, “জাহিন রোহান রাজিন আন্দোলনে ছিলো না, সে সমন্বয়কও না, সে গণঅভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে ছিল।”
প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গীদের তালিকায় মাহফুজ ও তিথির নাম থাকলেও জাহিনের নাম ছিল না।
ফেইসবুক জাহিনের একাউন্টে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে যে তিনি হাইড্রোকুইয়ো প্লাস নামে একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা।
মঞ্চে ওঠার ব্যাখ্যায় জাহিন দেশের ইংরেজি দৈনিক দি ডেইলি স্টারকে বলেছেন, “ওই অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ আমি পেয়েছিলাম সিজিআই ফেলো হিসাবে। যখন ড. ইউনূস ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দকে ডাকলেন, তখন আমি দর্শকসারি থেকে করতালি দিচ্ছিলাম। আমার পাশে বসেছিলেন দুই বিদেশি ভদ্রলোক। তারা আমাকে বললেন যে- তুমি তো বাংলাদেশি তরুণ, তুমিও যাও। তাই আমিও কিছু না ভেবেই স্টেজে উঠে গেছি মাহফুজ ভাইদের পেছন পেছন।”
জাহিন আরও বলেন, “আমি ২০২১ সালের ইউনূস অ্যান্ড ইয়ুথ ফেলো। আমার প্রতিষ্ঠান হাইড্রোকুইয়ো প্লাসের কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমি প্রফেসর ড. ইউনূসের সঙ্গে দেখা করতে চাচ্ছিলাম। নিউ ইয়র্কে সিজিআইয়ের অনুষ্ঠানে ড. ইউনূস আসবেন শুনে আমি খুবই খুশি হয়েছিলাম যে তার কাছাকাছি যাওয়ার একটা সুযোগ হবে।”
জাহিনের মঞ্চে ওঠা নিয়ে বিতর্কের প্রেক্ষাপটে মাহফুজ এক ফেইসবুক পোস্টে লিখেছেন, “ওই তরুণ একজন অনুপ্রবেশকারী ও অসৎ ব্যক্তি।”
পোস্টের কোথাও জাহিনের নাম উল্লেখ না করে মাহফুজ বলেছেন, তিনি নিজ থেকে ওই অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন।
“প্রতিনিধি দলে থাকা আমরা কেউ তাকে চিনতাম না, তার উপস্থিতি কিংবা উদ্দেশ্য সম্পর্কেও কোনও ধারণা ছিল না। তিনি আমাদের কারও সঙ্গে যোগাযোগও করেননি।”
ড. ইউনূস তরুণ নেতাদের মঞ্চে আহ্বান করার পর জাহিন তড়িঘড়ি দাঁড়িয়ে মঞ্চের দিকে ছুটে যান বলে মাহফুজের দাবি।
তিনি বলেছেন, তখন তার সন্দেহ হলেও ওই পরিস্থিতিতে অতিথিদের সামনে তাকে আটকানোর মতো অবস্থা ছিল না।
এটি পতিত ‘ফ্যাসিবাদী সরকারের’ একটি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র মনে করছেন মাহফুজ। তিনি এই ঘটনার জন্য বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা, সমন্বয়কসহ আন্দোলনকারী সবার কাছে দুঃখও প্রকাশ করেছেন।
মাহফুজ বলেছেন, আগামীতে তিনি এসব বিষয়ের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকবেন।
এদিকে রাশেদ খান লিখেছেন, “ইন্টারন্যাশনাল ইভেন্টে হুট করে দৌড় দিয়ে ওঠা যায় না। তাও আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের ইভেন্টে! একমাত্র বোকা লোককেই এটি বিশ্বাস করানো যাবে। জাহিন রোহান রাজিন যে আওয়ামী লীগের সাবেক এমপির নাতি, এই পরিচয় বাইরে আসার আগে কিন্তু বিষয়টি ক্লিয়ার করা হয়নি। মূলত পরিচয় বাইরে আসায় বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।”
জুলকারনাইন শায়ের লিখেছেন, “তলে তলে এ ধরনের আঁতাত, বাংলাদেশের মানুষ কখনোই মেনে নেবে না। ড. ইউনূস সাহেব হাজার শহীদের রক্তের সাথে তামাশা করার জন্যে আপনাকে সরকার প্রধান করা হয় নাই। আপনার আশেপাশে এত লোক, আগামীতে যথাযথ ভেটিং করায়ে লোকজনকে পরিচয় করাবেন।”
এদিকে জাহিন ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের বিষয়ে ডেইলি স্টারকে বলেন, “আন্দোলনের সময় আমি দেশেই ছিলাম। আমি নিজেই জেন-জি। সুতরাং এই আন্দোলন সমর্থন না করার প্রশ্নই আসে না।”
সাবেক মন্ত্রী তাজুলের সঙ্গে ছবির বিষয়ে তার ভাষ্য, “২০২২ সালে ঢাকা ওয়াসার সঙ্গে একটা কাজ করে আমার প্রতিষ্ঠান হাইড্রোকুইয়ো প্লাস। ওই কাজের জন্যই স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলামের সঙ্গে দেখা করতে হয়েছিল। সেসময় ছবিটি তোলা হয়। ছবিটা কীভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এলো, তাও আমি জানি না।”
তার এই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় রাশেদ খান লিখেছেন, “উত্তর দিয়ে দিই। ছবিটি আমাকে দেয়, তারই একসময়কার বিশ্বস্ত বন্ধু। এই ছবি আর কারও কাছে ছিল না। জাহিন গর্ব করে তার বন্ধুর WhatsApp এ ছবিটি পাঠিয়ে বলেছিল, আজকে মন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করে আসলাম! দেশের প্রয়োজনে জাহিনের সব তথ্য ফাঁস করে দিয়েছে তার বন্ধু। কোম্পানি খুলে জাহিন অনেক টাকা লোপাট করেছে ঢাকা ওয়াসার তাসকিম এ খানের সহায়তায়। সবকিছুর তদন্ত হোক।”