কয়েকদিনের টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পানির ঢলে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা দেখল ফেনীর মানুষ। দীর্ঘ ৩৭ বছর পর এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়ায় রীতিমতো বিহ্বল হয়ে পড়েছে তারা। তীব্র বন্যার পূর্বাভাস যেমন ছিল না, তেমনি ছিল না প্রস্তুতিও।
ফলে হঠাৎ করে ১৮ আগস্ট বন্যার পানি ঢুকতে শুরু করলে হতবাক হয়ে পড়ে ফেনীবাসী।
ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, লক্ষ্মীপুর ও কক্সবাজারসহ দেশের ১২ জেলা বন্যার কবলে পড়লে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় ফেনীতে।
বিশেষ করে ফেনীর ছাগলনাইয়া ও পরশুরাম উপজেলা একেবারে যোগাযোগবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। বন্যাদুর্গতদের কাছে ত্রাণ পৌঁছানো তো দূরের কথা, কারও সঙ্গে যোগোযোগের উপায় বের করাও কঠিন হয়ে পড়েছিল।
সবশেষ রবিবার পর্যন্তও অন্ধকারে ছাগলনাইয়ার মানুষ। স্থানীয় সাংবাদিকরা বলছেন, এখনও বন্যার পানিতে ডুবে রয়েছে গোটা এলাকা। অধিকাংশ মানুষের হাতেই পৌঁছেনি ত্রাণ। ফলে পানিবন্দী মানুষকেই নানা বাধাবিঘ্ন পেরিয়ে ত্রাণের খোঁজে বের হতে হচ্ছে।
ছাগলনাইয়ার ৯৫ শতাংশ এলাকা পানির নিচে
স্থানীয় কয়েকজন সাংবাদিকের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করেছে সকাল সন্ধ্যা। তারা বলছেন, পানি প্রবেশের সাতদিন পেরোলেও এখনও ডুবে আছে ছাগলনাইয়া। প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোয় পৌঁছানোর মতো যানবাহন সাধারণ মানুষের কাছে নেই। ফলে বেশিরভাগ অঞ্চলেই পৌঁছেনি ত্রাণ।
উপজেলার প্রায় সব গ্রাম, উপজেলার প্রায় ৯৫ শতাংশ এলাকা পানির নিচে। ত্রাণ না পৌঁছায় পানিবন্দী মানুষকেই নিরাপদ আশ্রয় ও খাবারের খোঁজে ছুটতে হচ্ছে।
এক সাংবাদিক বলেন, “এখানে যতদূর চোখ যায় কেবল পানি আর পানি। স্মরণকালে এ দৃশ্য পুরো ফেনী বা নোয়াখালী এলাকার মানুষ দেখেনি। ভয়াবহ ও অপ্রত্যাশিত এ বন্যায় ছাগলনাইয়ার মানুষ গত কয়েকদিন ধরেই পানিবন্দী। ঘর বাড়ি সব পানির নিচে। কেউবা আবার কেবল প্রাণ বাঁচাতে মাইলের পর মাইল পেরিয়ে ছুটছেন শহরের দিকে, একটুখানি আশ্রয় পেতে।”
ফেনীর যে পরিমাণ বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার বড় অংশই ছাগলনাইয়াতে বলে জানালেন তিনি।
রবিবার এক ব্রিফিংয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. কামরুল হাসান জানিয়েছেন, ছাগলনাইয়া ও পরশুরাম উপজেলায় সেনাবাহিনীর ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌ ও সড়ক পথে এবং তাদের হেলিকপ্টারসহ বিমানবাহিনী, র্যাব ও বিজিবির হেলিকপ্টার যোগে প্রত্যন্ত এলাকায় ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দিচ্ছে। পাশাপাশি উদ্ধার কার্যক্রমও চলছে।
তবে উদ্ধারকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার মানুষ এবং ত্রাণ নিয়ে যাওয়া মানুষেরা বলছেন ভিন্ন কথা। স্থানীয়রাও জানালেন ত্রাণের অপ্রতুলতা ও সবার কাছে সহায়তা পৌঁছে না দিতে পারার কথা। কারণ হিসেবে বারবারই উঠে আসছে যোগাযোগ সক্ষমতা না থাকা, গ্রামের গভীর এলাকায় পানির তীব্র স্রোত ও বিদ্যুৎহীনতার কথা।
ভেতরের দিকে যায়নি ত্রাণ
ছাগলনাইয়ার খবর নিতে কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা জানান, কিছু পথ নৌকায়, কিছু পথ পানি পেরিয়ে হেঁটে আশ্রয়কেন্দ্রের দিকে যেতে হচ্ছে। ঘরে ওষুধ নেই, খাবার নেই। প্রয়োজনীয় যেকোনো সামগ্রীর জন্য ছুটতে হচ্ছে শহরের দিকে।
কিন্তু এই ছুটে যাওয়ার পথ যে কতটা ‘বন্ধুর’ সেটা কেবল বুঝতে পারছেন ছাগলনাইয়ার মানুষ।
গত ৫০ বছরে এমন পরিস্থিতি দেখা যায়নি জানিয়ে স্থানীয়রা বলছেন, ত্রাণ পাননি বেশিরভাগ দুর্গত মানুষ।
রায়হান নামের এক স্থানীয় তরুণ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “পানি কিছুটা কমতে শুরু করেছে। তবে ভয়ের বিষয় হলো, নতুন করে কিছু এলাকা প্লাবিতও হচ্ছে। আর শহরের প্রধান সড়কের আশপাশে যারা রয়েছেন, তারা ত্রাণ পাচ্ছেন। কিন্তু যারা ভেতরের দিকের বাসিন্দা, তারা ত্রাণ পাচ্ছেন না। নেই উদ্ধারকারী টিমও।”
একই কথা বললেন, ঢাকা থেকে ব্যক্তি উদ্যোগে ত্রাণ নিয়ে যাওয়া বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত কাওসার শাকিল।
ভীষণ ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, “ছাগলনাইয়াতে যাওয়ার কোনও সুযোগ হয়নি, উপায়ই নেই। বোট নেই, ট্রলার নেই, স্পিডবোটও নেই। ইঞ্জিনচালিত বোট ‘সিভিলিয়ানদের’ জন্য নয়। ফলে সব এলাকায় মানুষ যেতে পারছে না, ত্রাণ পৌঁছাচ্ছে না।”
এই এলাকার মানুষ বন্যার জন্য প্রস্তুত ছিল না জানিয়ে কাওসার শাকিল বলেন, “এমন বাড়িও রয়েছে যার বাসিন্দারা চারদিন ধরে ভাত খায় না। তাদের ঘরে কিচ্ছু ছিল না, ঘরের ভেতরে একদানা খাবারও ছিল না। আমরা আজ কিছু চাল, ডাল, পেঁয়াজ, স্যালাইন, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট দিয়েছি।
“চারদিন পর তারা হয়ত আজ ভাত অথবা খিচুড়ি খাবেন।”
ত্রাণ বিতরণে নানা অব্যবস্থাপনা দেখে এসেছেন বলে জানালেন কাওসার শাকিল।
তিনি বলেন, “দেখলাম সেই চিরচেনা দৃশ্য। দুর্যোগ আক্রান্ত এলাকার রাস্তার পাশে ত্রাণের সামগ্রী বিক্রি হচ্ছে, ভলান্টিয়াররা ট্রাক ভরে ভরে ত্রাণ এনে মানুষের ওপর ঢেলে দিয়ে যাচ্ছে।
“অথচ বন্যা আক্রান্ত দুর্গম এলাকাগুলোয় আটকে পড়া মানুষজন প্রথমবার উদ্ধারকারী ট্রলার বা স্পিডবোট দেখলে এখন খাবারও চাইছে না। তারা কেবল এক বোতল পানি চাইছেন পরিবারের সবাই মিলে ভাগ করে পান করা জন্য।”
স্থানীয় বাসিন্দা থেকে শুরু করে উদ্ধারকারী, সবার একটাই বক্তব্য। এমন তীব্র বন্যার জন্য একেবারেই অপ্রস্তুত ছিল ছাগলনাইয়ার মানুষ। যা বাড়িয়েছে দুর্ভোগ।
আবরার ফাহাদ নামের আরেক উদ্ধারকারী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “অনেক মানুষকে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দিলেও সীমাবদ্ধতা থাকায় বেশিরভাগ মানুষকেই সাহায্য করার সুযোগ হয়নি।”
এখনও যারা ছাগলনাইয়ায় যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন, তারা যেন অবশ্যই প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাওয়ার চেষ্টা করেন, সেই অনুরোধ জানান ফাহাদ। সেখানে সুপেয় পানি ও খাবারের তীব্র সংকট রয়েছে বলেও জানান তিনি।
ছাগলনাইয়ার আলোকদিয়া গ্রামের নতুন সমিতি বাজার এলাকার সুমন জানান, ত্রাণসামগ্রী পায়নি বেশিরভাগ মানুষ। সবাই মূল সড়কের আশপাশের বাসিন্দাদের কাছে ত্রাণ পৌঁছে দিচ্ছে। কিন্তু ভেতরের দিকের গ্রামগুলোয় কেউ যাচ্ছে না।
সুমন বলেন, গ্রামের আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতেও খাবারের প্রয়োজন। তবে এখন পর্যন্ত কোন স্বেচ্ছাসেবক, উদ্ধারকর্মী যেতে পারেননি। তাই সরকারি বাহিনীগুলোকে ভেতরের দিকে যেতে অনুরোধ করেন তিনি।
বিদ্যুৎহীন জীবন
ফেনীর বেশিরভাগ এলাকাতেই ছিল না বিদ্যুৎ, নেই ইন্টারনেট। যার কারণে স্থানীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। এমনকী ফেনী শহরের সব এলাকাতেও রবিবার রাত পর্যন্ত বিদ্যুৎ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক সংযোগ সচল হয়নি।
যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছে ছাগলনাইয়া, পরশুরাম ও ফুলগাজী। ফলে অনেককেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোয় বাবা-মা বা আত্মীয়-বন্ধুদের ঠিকানা দিয়ে তাদের খোঁজ চাইছেন। দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন উদ্ধারকারীদেরও।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, শুরু থেকেই পরশুরাম এবং ছাগলনাইয়ায় পানির স্রোত ছিল ভীষণ তীব্র। যার সঙ্গে টিকে থাকাই কঠিন ছিল।
ঢাকায় বেসরকারি চাকরি করেন মো. রিয়াজ উদ্দিন সুমন। বাড়ি ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া থানার উত্তর কুহুমা গ্রামে। গত বুধবার তার বাবা মো. নাসির উদ্দিন পাটোয়ারির সঙ্গে শেষ কথা হয়েছে। এরপর থেকে আর কোনও খোঁজ পাননি বাবা-মায়ের।
রিয়াজ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “পানি কিছুটা কমতে শুরু করেছে। তবে ত্রাণ সহায়তা যা পাওয়া যাচ্ছে, সেটাও শহরকেন্দ্রিক। গ্রামের দিকে কেউ যাচ্ছে না বলেই খবর পেয়েছি।
ওদিকে কেউ ত্রাণ পাচ্ছে না। মোটকথা, আসলে এসব এলাকায় যত মানুষ রয়েছে, সে পরিমাণে ত্রাণ মানুষ পায়নি। আর যোগাযোগ করার মতো অবস্থা নেই। মানুষ যোগাযোগ করে ত্রাণ নিয়ে যাবেই বা কীভাবে?”
মঙ্গলবার রাত থেকে বাড়িতে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন বলে জানতে পেরেছিলেন রিয়াজ। বুধবার থেকে মোবাইলগুলোও বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে সেদিন থেকে মা, বাবা আর দুই বোনের কোনও খবর জানেন না রিয়াজ।
তিনি বলেন, “শুধু আমি কেন, আমার বংশের কেউ এমন বন্যা কখনো দেখেনি। তাই আমাদের এ নিয়ে কোনও অভিজ্ঞতা ছিল না, আমরা ভাবতেও পরিনি।
“বাবার সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, তখন তিনি খুবই স্বাভাবিকভাবে বলেছিলেন, পানি বাড়ছে, বন্যার কথা শুনছি। হয়তো আশপাশে পানি উঠবে। তাই জিনিসপত্র সরায়ে নিচ্ছি। সর্বোচ্চ হয়তো ঘর পর্যন্ত পানি উঠবে।”
এটুকুই সতর্কতা ছিল জানিয়ে রিয়াজ বলেন, এরপর কত পানি এলো সে তো দেশের মানুষ দেখলই। সব এলোমেলো হয়ে গেল।
যতটুকু দেখা যাচ্ছে, পরিস্থিতি তার চেয়েও বেশি খারাপ বলে মন্তব্য করছেন তিনি।
যোগাযোগ ব্যবস্থাও কষ্টকর
উদ্ধার কাজে ঢাকা থেকে যাওয়া কাওসার শাকিল বললেন, রাস্তার অবস্থা খুবই খারাপ। ঢাকা চট্টগ্রাম রোড ধরে কারও যদি ফেনীতে যাওয়ার পরিকল্পনা থাকে, তাহলে তা বাদ দেওয়াই ভালো।
তিনি বলেন, “পদুয়ার বাজার ফ্লাইওভার থেকে ফেনী পর্যন্ত রাস্তা ব্লক। লালপুলের রাস্তা কাটা। একটা একটা করে গাড়ি যায়। তিনদিন ধরে লোকজন বসে আছে গাড়িতে। যেতে হলে চৌমুহনী হয়ে যাওয়া ভালো। অন্তত দিনে দিনে পৌঁছানো যাবে।”
নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “আমি গাড়ি পেছনে ফেলে মহিপাল থেকে ২৪ কিলোমিটার রাস্তা পেরিয়ে প্রথমে ফেনী হয়ে তারপর মীররসরাই গিয়েছি। এরমধ্যে ১৭ কিলোমিটার হেটে, আর বাকিটা ভ্যান গাড়ি এবং ত্রাণের ট্রাকে লিফট চাইতে চাইতে আসতে হয়েছে। রাস্তায় আর কোনও লোকাল ট্রান্সপোর্ট নেই।”
পরশুরাম, ফুলগাজী, ছাগলনাইয়া সবচেয়ে দূর্যোগপ্রবণ এলাকা জানিয়ে তিনি বলেন, এসব এলাকার বেশিরভাগ মানুষের কাছেই সাহায্য পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়নি। প্রচুর মানুষ আটকে আছেন, যাদের কাছে সহায়তা পৌঁছে দেওয়া তো দূরের কথা, যোগাযোগই করা যায়নি।
রবিবার শেষ বিকেলে ফেনীর আকাশে রংধনু দেখা গেছে জানিয়ে শাকিল বলেন, “আশার কথা হলো, রংধনু উঠলে বন্যা আর বেশিদিন থাকে না।”
রবিবার পর্যন্ত বন্যায় দেশের প্রায় ৫২ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়।
সচিব মো. কামরুল হাসান জানান, দেশের ১১ জেলায় পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছে ১০ লাখ ৪৭ হাজার ২৯টি পরিবার।