‘ছুটি কাটিয়ে ফিরলেন হাথুরুসিংহে’- ২০১৪ সাল থেকে এমন শিরোনামে খবর প্রকাশিত হয়েছে অসংখ্যবার। কখনও ঢাকা-সিডনি তো কখনও ঢাকা-কলম্বো, পরিবারের সঙ্গে দীর্ঘদিন সময় কাটিয়ে ফিরতেন চন্ডিকা হাথুরুসিংহে।
২০২৩ সালে দ্বিতীয় দফা বাংলাদেশের কোচ হওয়ার পর চুক্তিতে ছিল বছরে ৪৫ দিন ছুটি পাবেন হাথুরুসিংহে। সেই ছুটি এতদিনে কাটিয়েও ফেলেছেন তিনি। শুধু তাই নয়, বিসিবির একটি সূত্র বলছে বাড়তি ছুটিও কাটিয়ে ফেলেছেন তিন মাসের মতো!
প্রথম মেয়াদে ২২০ ও ১৫০ দিনের ছুটি
২০১৪ সালের জুন থেকে ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত বাংলাদেশ জাতীয় দলের কোচের পদে মেয়াদ ছিল চন্ডিকা হাথুরুসিংহের। পরে সেটা বাড়িয়ে করা হয় ২০১৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপ পর্যন্ত। তবে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে ২০১৭ সালের নভেম্বরেই পদত্যাগ করেন তিনি।
এই সময়ে হাথুরুসিংহের সঙ্গে বিসিবির চুক্তি ছিল বছরে ৩০ দিন ছুটির। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, ২০১৪ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত এই লঙ্কান ছুটি কাটিয়েছিলেন ২২০ দিন! ২০১৬ সালে চুক্তির মেয়াদ বাড়ানোর পরও বদলায়নি ব্যাপারটা। পদত্যাগের আগে পর্যন্ত ছুটি কাটিয়েছিলেন প্রায় ১৫০ দিন।
একজন জাতীয় দলের কোচ, যার বেতন কিনা আকাশছোঁয়া (তখন ছিলেন বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পারিশ্রমিক পাওয়া চতুর্থ কোচ) তিনি কীভাবে এতদিন ছুটি কাটাতে পারেন? তখনকার বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন এ নিয়ে খোঁড়া যুক্তি দিয়ে বলেছিলেন, ‘‘কোচদের তো আর সাপ্তাহিক ছুটি থাকে না। আমাদের সূচিতে যখন খেলা থাকে না, সে সময় তিনি ছুটিতে থাকতেই পারেন। সমস্যার কিছু নেই তো।’’
সমস্যা না থাকলে চুক্তির কাগজে বছরে ৩০ দিনের ছুটির কথা লেখা ছিল কেন? এর কোনো জবাব ছিল না বিসিবির কারও কাছে। গত বছর দ্বিতীয় মেয়াদে বাংলাদেশের দায়িত্বে ফেরার পরও বদলাননি হাথুরুসিংহে। বিশ্বকাপ কিংবা কোনো সিরিজ শেষেই ঢাকার বাইরে উড়াল দেন তিনি।
নতুন চুক্তিতে ২০২৫ সালের চ্যাম্পিয়নস ট্রফি পর্যন্ত মেয়াদ রয়েছে হাথুরুসিংহের। এই সময়ে প্রতি বছর তিনি ছুটি পাবেন ৪৫ দিন। ২০১৪ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত ছুটির চুক্তি ছিল বছরে ৩০ দিনের।
মেয়াদ পূর্তির আগে বরখাস্ত করা হলে হাথুরুসিংহেকে দিতে হবে ৩ মাসের বেতন। প্রথম দফায় তার বেতন ছিল মাসে ২৭ হাজার ৭২৩ ডলার। তবে উৎসে কর বাবদ কেটে নেওয়া হতো ৩০ শতাংশ, মানে বেতন কমত ৮ হাজার ৩১৭ ডলার। তাতে বেতন দাঁড়াত ১৯ হাজার ৪০৬ ডলার।
নতুন চুক্তিতে হাথুরুর বেতন মাসে ২৫ হাজার ডলার। উৎসে করও দিতে হবে না তাকে। হাথুরুর বেতনের কর দিয়ে দেয় বিসিবি।
দ্বিতীয় মেয়াদে চার উপলক্ষ্যে ১৫০ দিনের ছুটি
বছরে ৪৫ দিনের ছুটি থাকলেও ২০২৩ থেকে এ পর্যন্ত হাথুরুসিংহে কাটিয়ে ফেলেছেন চুক্তির অনেক বেশি সময়ের ছুটি। দীর্ঘ মেয়াদের চারটা ছুটির কথা উল্লেখ করা যেতেই পারে। গত বছর ১১ জুলাই থেকে ৩৩ দিন ছুটি কাটিয়ে ফিরেছিলেন ৯ আগস্ট। এরপর ৩১ ডিসেম্বর ২০২৩ নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে অ্যাওয়ে সিরিজের পর যান অস্ট্রেলিয়ায়। ৫৩ দিন ছুটি কাটিয়ে দেশে ফিরেছিলেন ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ বিপিএলের মাঝপথে ।
২৭ মার্চ ২০২৪ শ্রীলঙ্কার সিরিজের মাঝপথে অস্ট্রেলিয়া ফেরেন স্ত্রীর অসুস্থতায়। তখন গুঞ্জন উঠেছিল আর হয়তো ফিরবেন না হাথুরু। তবে শেষ পর্যন্ত লম্বা সময় ছুটি কাটিয়ে ফিরেছিলেন বাংলাদেশে।
২৫ দিন পর বাংলাদেশে ফিরেছিলেন ২১ এপ্রিল জিম্বাবুয়ে সিরিজের আগে।
২৫ জুন ২০২৪ বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ শেষ হয়। ছুটি নিয়ে অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার পর ২৫ জুলাই দেশে ফেরার কথা ছিল হাথুরুর। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতায় ৪ আগস্ট পাকিস্তানে দলের সঙ্গে যোগ দেন হাথুরু। ছুটির মেয়াদ ৩৯ দিন। অর্থাৎ এই চারটা ছুটির মেয়াদের যোগফলই ১৫০ দিনের।
অস্ট্রেলিয়া গেছেন আবারও
পাকিস্তানে ঐতিহাসিক টেস্ট সিরিজ জয়ের পর বাংলাদেশে ২৪ ঘণ্টার জন্য এসেছিলেন হাথুরু। দুবাই থেকে অস্ট্রেলিয়া না গিয়ে, ছুটি কাটাতে গেছেন ঢাকা হয়ে। ফিরবেন ১২ সেপ্টেম্বর। এরপর ভারত সফরে প্রধান কোচ হয়ে যাওয়ার কথা তারই।
গুঞ্জন ছিল পাকিস্তান সফর শেষে বরখাস্ত করে দেওয়া হবে হাথুরুসিংহেকে। কিন্তু সবশেষ লম্বা বোর্ড সভায় বদলে যায় অঙ্কটা। সেই সভায় থাকা এক পরিচালক সকাল সন্ধ্যাকে জানিয়েছেন, ‘‘উপস্থিত পরিচালকদের কেবল একজনই বলেছিলেন হাথুরুকে বরখাস্ত করার কথা। অন্য সবাই পাকিস্তান সিরিজের পরে ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরামর্শ দেন।’’
সংবাদ সম্মেলনেও বোর্ড সভাপতি ফারুক আহমেদ জানিয়েছিলেন, সিরিজ শেষে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা। এমন মনোভাব জেনে, হাথুরুসিংহে চাইছিলেন ফারুক আহমেদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে। ফারুক আহমেদ দুবাইয়ে থাকায় সেই আলোচনাটা সরাসরি হয়নি। তবে ভারত সফরের আগে অল্প সময়ের ব্যবধানে নতুন কোনো কোচ নিয়োগ দেওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। ভারত সফরে তাই হাথুরুর যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
বিসিবি কী বলছে
হাথুরুকে যদি বরখাস্তই করা হয় তাহলে কী চুক্তি অনুযায়ী তিন মাসের বেতনের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে তাকে? বিসিবিরি একটি সূত্র জানিয়েছে, সেই সম্ভাবনাও নেই। কারণ চুক্তি অনুযায়ী বছরে ৪৫ দিনের বেশি ছুটি কাটিয়ে ফেলেছেন হাথুরু। সেই পরিমাণটা ছাড়িয়ে গেছে তিন মাসের বেশি। অর্থাৎ বরখাস্ত হলে ছুটি বিলাসের কারণে তিন মাসের বেতনের ক্ষতিপূরণও পাবেন না হাথুরু!
বিসিবির একজন কর্মকর্তা সকাল সন্ধ্যাকে বললেন,‘‘ এটা খুব গোপনীয়। আমি বললে প্রতিষ্ঠানের নিয়ম বহির্ভূত কাজ করা হয়। তবে চুক্তির অতিরিক্ত ছুটি কাটিয়েছেন তিনি। খালি চোখে দেখলে এই মুহূর্তে বাংলাদেশের কোচ হিসেবে চন্ডিকা হাথুরুসিংহেকে বরখাস্ত করা হলে বা তার সঙ্গে চুক্তি ভঙ্গ করা হলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট মহলে বাংলাদেশের বা বিসিবির সুনামটা ক্ষুণ্ন হবে। বাংলাদেশের ক্রিকেটের ওপর একটা বাজে ধারণা তৈরি হবে।’’
সেই কর্তা আরও যোগ করেন, ‘‘তার অধীনে পাকিস্তানের মতো জায়গায় বাংলাদেশ ২-০ তে টেস্ট সিরিজ জিতেছে। দিন শেষে সাফল্যেই তো গণনা করা হয়। হাথুরুর পক্ষে সেটা কথা বলছে। এখানে এই বিষয়টাই এখন সামনে আনা উচিত।’’