দেশে ক্ষমতার পালাবদলের পর পরিবর্তন আর সংস্কারের দাবি উঠছে বিভিন্ন মহল থেকে। এমন পরিস্থিতিতে পিছিয়ে নেই চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোও। ১৫/২০ বছর ধরে এসব সংগঠন নির্বাচন দেখেনি। একই নেতৃত্ব দীর্ঘদিন দখল করে রেখেছে সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকের পদ।
খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন, চট্টগ্রাম চাল ব্যবসায়ী সমিতির মতো সংগঠনগুলোর তৃণমূল ব্যবসায়ীরা এখন পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে অর্থবহ নির্বাচন আয়োজনের দাবি তুলেছেন।
তাদের এই দাবির পেছনে প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে চট্টগ্রাম চেম্বারের পরিচালনা পর্ষদ এবং নির্বাহী কমিটির একযোগে পদত্যাগের সাম্প্রতিক নজিরবিহীন ঘটনা।
অবশ্য তৃণমূল ব্যবসায়ীরা সতর্ক করে বলেছেন, নির্বাচনের আগে বিদ্যমান ভোটার তালিকা যাচাই করতে হবে। প্রকৃত ব্যবসায়ীদের সদস্য করতে হবে। নইলে বিগত আওয়ামী সরকারের আমলে কমিটি দখল করে রাখা ব্যক্তি বা স্বজনদেরই আবার নির্বাচিত হয়ে আসার সুযোগ তৈরি হবে। আর তেমনটা হলে নির্বাচন কোনোভাবেই অর্থবহ হবে না।
খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন
ভোগ্যপণ্যে দেশের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ। এই এলাকার ব্যবসায়ীদের স্বার্থরক্ষায় ২০০৭ সালে সাড়ে ৫শ’ সদস্য নিয়ে খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন যাত্রা শুরু করলেও এরপর এর সদস্যসংখ্যা আর বাড়েনি। একবারও সেখানে নির্বাচন হয়নি।
একই নেতৃত্ব গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করে রাখায় বিকল্প নেতৃত্ব তৈরি হয়নি। নতুন নেতৃত্ব উঠে আসারও সুযোগ তৈরি হয়নি। একপর্যায়ে সাধারণ ব্যবসায়ীরা এই সংগঠনের সদস্য হওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন।
খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যাসোসিয়েশনের অকার্যকর ভূমিকার কারণে পরে চাক্তাই, আছদগঞ্জ, খাতুনগঞ্জ এলাকা ঘিরে ২৩টি ব্যবসায়িক সংগঠন গড়ে ওঠে। ব্যবসায়ীদের দাবি আদায়ে তারা সোচ্চার থাকতে চেয়েছেন। কিন্তু সংগঠনগুলোর শীর্ষপদে ঘুরেফিরে একই নেতৃত্ব আসায় সুফল পাওয়া যায়নি।
২০০৭-২০০৯ সাল পর্যন্ত খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন মোস্তফা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক হেফাজতুর রহমান। সৈয়দ ছগীর আহমদ ছিলেন এর সাধারণ সম্পাদক।
এরপর ২০০৯ সালে এই সংগঠনের সভাপতি মনোনীত করা হয় মাহবুবুল আলমকে। সৈয়দ ছগীর আহমদ সাধারণ সম্পাদকই থেকে যান।
২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত টানা ১৫ বছর সংগঠনটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে কোনও পরিবর্তন আসেনি নির্বাচন না হওয়ায়। ৪১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটির প্রায় সবাই ঘুরেফিরে বিভিন্ন পদে ছিলেন।
জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এখন খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনে নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
২৬ আগস্ট সংগঠনের সদস্য ও নির্বাহী কমিটির বেশ কয়েকজন সদস্য নির্বাচন আয়োজনের লক্ষ্যে বৈঠকে বসেন।
এরপর মঙ্গলবার সংগঠনের উপদেষ্টা মো. তৈয়বুর রহমানকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও সাংগঠনিক সম্পাদক মুহাম্মদ জামাল হোসেন ও বন্দর বিষয়ক সম্পাদক স ম বখতিয়ারকে সহকারী নির্বাচন কমিশনার করে তিন সদস্যের নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি হওয়ার আগে মাহবুবুল আলম ২০১৩ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম চেম্বারে টানা পাঁচ মেয়াদে সভাপতি ছিলেন।
একই সঙ্গে ২০০৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনেরও সভাপতি ছিলেন তিনি।
২০২৩ সালের আগস্টে এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি হওয়ার পর সেই পদ দুটি পদ ছাড়েন মাহবুবুল আলম। তখন তিনি খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্বে আবুল বশর চৌধুরীকে বসান।
এই সংগঠনের নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরুর বিষয়টি স্বীকার করে এর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “গঠনতন্ত্র অনুযায়ী নির্বাচনের মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচনের পদ্ধতিতে আমরা ফিরে যেতে চাই।
“নানা কারণে আগে নির্বাচন করা যায়নি। সদস্যদের পরামর্শে তিন সদস্যের নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে। তারাই একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে যোগ্য নেতৃত্ব নির্বাচনের সুযোগ তৈরি করবেন বলে আমরা আশা করছি।”
চট্টগ্রাম চাল ব্যবসায়ী সমিতি
স্বাধীনতার আগে জন্ম নেওয়া চট্টগ্রাম চাল ব্যবসায়ী সমিতিতে সর্বশেষ নির্বাচন হয়েছিল ২০০৯ সালে। সেই নির্বাচনে এনামুল হক সভাপতি এবং ওমর আজম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
সমিতিতে আর কখনও নির্বাচন না হওয়ায় এখন পর্যন্ত একই পদে আছেন এনামুল হক ও ওমর আজম।
এনামুল হক চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন। এস আলম গ্রুপের গাড়ি সরানোর ঘটনায় সম্প্রতি তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
এই সংগঠনেও নির্বাচনের মাধ্যমে নেতৃত্ব পরিবর্তনের দাবি উঠেছে।
চাক্তাই শিল্প ব্যবসায়ী সমিতি
চাক্তাই শিল্প ব্যবসায়ী সমিতিতে গত ২০ বছরে কোনও নির্বাচন হয়নি। নির্বাচন হয়নি চট্টগ্রাম কাঁচাপণ্য আড়তদার সমিতিসহ ওই এলাকার অসংখ্য সংগঠনেও।
খাতুনগঞ্জের এক শীর্ষ ব্যবসায়ী সকাল সন্ধ্যাকে নাম প্রকাশ না করে বলেছেন, “বড় বড় পাঁচটি ব্যবসায়ী সংগঠনে অন্তত ৬/৭ জন ব্যবসায়ী শীর্ষপদ দখল করে রেখেছেন।
“এনামুল হকের কথাই যদি ধরি, তিনি একাই চট্টগ্রাম চাল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি, খাতুনগঞ্জ শিল্প ব্যবসায়ী সমিতির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন চেম্বারের পরিচালক ও চাক্তাই এলাকার বিভিন্ন সংগঠনের উপদেষ্টা। তিনি সরাসরি দলীয় রাজনীতির সঙ্গেও জড়িত। এসব না ভাঙলে সত্যিকার পরিবর্তন আসবে না।”
খাতুনগঞ্জের এই শীর্ষ ব্যবসায়ীর মতো তৃণমূল ব্যবসায়ীরা ব্যবস্থায় যেনতেন পরিবর্তন নয়, গুণগত পরিবর্তন চাইছেন।
তারা মনে করছেন, বিদ্যমান ভোটার তালিকার সঠিকতা যাচাই না করে এবং প্রকৃত ব্যবসায়ীদের সদস্য না করলে নির্বাচন অর্থবহ হবে না। একই ব্যক্তির পরিবার-পরিজন তো বটেই, অফিস কর্মচারীরাও সংগঠনের সদস্যপদ পেয়েছেন, এমন নজির যেহেতু আছে তাই ভোটার তালিকা যাচাই গুরুত্বপূর্ণ।
এ বিষয়ে খাতুনগঞ্জ আড়তদার কল্যাণ সমিতির সাবেক সভাপতি সোলায়মান বাদশা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বড় সংগঠনগুলোর ব্যর্থতার কারণে খাতুনগঞ্জ থেকে ব্যবসা অন্য এলাকায় চলে গেছে। একই ব্যক্তি খাতুনগঞ্জ ট্রেডের সভাপতি ছিলেন, চট্টগ্রাম চেম্বার সভাপতি ছিলেন আবার এফবিসিসিআই সভাপতিও হয়েছেন।
“কিন্তু চট্টগ্রাম-ঢাকা মহাসড়কে পণ্যবাহী গাড়ি চলাচলে ওজন স্কেলের বৈষম্য দূর হয়নি। তারা কেবল বিগত সরকারের সঙ্গে খাতির রেখে নিজেদের ব্যবসা বাড়িয়েছেন। নিজেদের স্বার্থই দেখেছেন। তৃণমূল ব্যবসায়ীদের অধিকার নিয়ে কথা বলেননি।
“তাদের এসব ভূমিকার কারণে আমরা সংগঠনের সদস্য হলেও নেতৃত্বে যাইনি। এখন যদি প্রকৃত ব্যবসায়ীদের ভোটার করে একটি সুষ্ঠু ভোট নিশ্চিত করা হয়, তাহলে নতুনদের অনেকেই নেতৃত্বে আসবেন। গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরে আসলে ব্যবসায়ীরা ঐক্যবদ্ধ থাকবেন। বড় সংগঠনগুলো আমাদের অধিকার আদায়ে ভূমিকা পালন করতে পারবে।”