ক্লাব কাপ হকিতে দুই দিনের বিরতি থাকায় স্টেডিয়ামে কোলাহল নেই। জনশূন্য মওলানা ভাসানী স্টেডিয়ামে রবিবার বিকেলে একমনে অনুশীলন করছিলেন রাসেল মাহমুদ জিমি। মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব লিমিটেডের স্ট্রাইকার জিমির সঙ্গে পেনাল্টি কর্ণারসহ ফিটনেস ট্রেনিংয়ে ব্যস্ত থাকতে দেখা গেল সতীর্থদের।
প্রায় ২৭ মাস পর ২২ ফেব্রুয়ারি ক্লাব কাপ দিয়ে মাঠে গড়িয়েছে হকির ঘরোয়া প্রতিযোগিতা। প্রতি বছর নিয়মিত খেলা না হওয়াটাই যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে হকি ফেডারেশনে! গত ১০ বছরে যে প্রিমিয়ার লিগ হয়েছে মাত্র ৫ বার।
২ মার্চ এ টুর্নামেন্ট শেষে শুরু হবে হকির আসল উত্তাপ- প্রিমিয়ার লিগ। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা ঘরোয়া হকির দরজা খুললেও খেলোয়াড়দের মুক্তির আনন্দ যেমন আছে, তেমনি আছে শঙ্কাও। আসলে এখানকার প্রেক্ষাপটে খেলাটা শুরুই হয় যেন বন্ধ হওয়ার জন্য। হকির যাত্রা যেন শুভ হতে নেই -এটাই বলে অতীত অভিজ্ঞতা।
এমনিতেই মাঠ ও মাঠের বাইরে প্রায় নেতিবাচক ঘটনায় শিরোনামে আসে হকি। লিগ আয়োজনে গড়িমসি, খেলায় রেফারির সিদ্ধান্ত নিয়ে হাতাহাতি-মারামারির আড়ালে পড়ে থাকে দেশের তৃতীয় জনপ্রিয় এই খেলাটি।
হকিতে মারামারি নিত্য ঘটনা
হকি মাঠে মারামারি, আম্পায়ার লাঞ্ছনা, খেলোয়াড়-কর্মকর্তা নিষিদ্ধ হওয়ার ঘটনা ঘটে আকছার। আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত অমান্য করা, মাঝপথে খেলা বন্ধ হওয়াই হকির নিয়তি। যেমন সর্বশেষ ২০২১ সালেও ক্লাব কাপ হকির গ্রুপ পর্বে তুমুল মারামারি করে এক ম্যাচ নিষিদ্ধ হয়েছিলেন মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের স্ট্রাইকার রাসেল মাহমুদ জিমি। এজন্য তাকে ৫০ হাজার টাকা আর্থিক জরিমানা করা হয়েছিল।
২০১৮ সালের লিগে লঙ্কাকাণ্ড হয়েছিল মোহামেডান-মেরিনার্সের ম্যাচে। মারামারি ও বিশৃঙ্খলার দায়ে মেরিনার্সের সাধারণ সম্পাদক হাসান উল্লাহ খান রানা, কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম মৃধা এবং মোহামেডানের আরিফুল হক প্রিন্স ও কোচ আসাদুজ্জামান চন্দনকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল নির্দিষ্ট সময়ের জন্য।
২০১৬ সালেও ঘরোয়া হকিতে মারামারি হয়েছিল। সেবার বাংলাদেশ স্পোর্টিং ক্লাবের দুই খেলোয়াড়কে মারধর করার অপরাধে দুই ম্যাচের জন্য নিষিদ্ধ করা হয় মোহামেডানের ডিফেন্ডার আসাদুজ্জামান চন্দনকে। এই কাণ্ডে আরও তিন খেলোয়াড়কে সতর্ক করে দেয় প্রিমিয়ার ডিভিশন হকি লিগ কমিটি।
এদেশের ঘরোয়া হকিতে হট্টগোল, মারামারি আর মাঝপথে লিগ বন্ধ হওয়ার অঘটন আছে অনেক। এমনকি ২০১৩ সালে জাতীয় হকি দলের কোচ নাভিদ আলমকে লাঞ্ছিত করে নিষিদ্ধ হয়েছিলেন এদেশের জাতীয় খেলোয়াড়রা।
ধারা বদলের চিন্তা
যদিও এবারের মৌসুমে কোনও নেতিবাচক ঘটনার শিরোনাম যেন না হয় হকিতে, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখছেন কর্মকর্তারা। খেলা চলাকালে কোনওরকম বিতর্ক যাতে না হয় এ জন্য এবার ক্লাব কাপ থেকেই ভিডিও রেফারেল পদ্ধতি চালু রাখা হয়েছে, যা আগে দেখা যায়নি। এছাড়া প্রিমিয়ার লিগ শুরু হলে আনা হবে দুজন বিদেশি আম্পায়ার।
এই মৌসুমে কোনও বিশৃঙ্খল ঘটনা যেন না ঘটে সেটাই চাওয়া প্রিমিয়ার লিগ কমিটির সম্পাদক খাজা তাহের লতিফ মুন্নার, “ক্লাব কাপ শেষ হবে ২ মার্চ। এরপর ৫ বা ৭ মার্চ লিগ শুরু হতে পারে। এবার আশা করি হকিতে নেতিবাচক শিরোনাম হবে না। আমরা ক্লাব কাপে নতুন নিয়মে খেলা চালাচ্ছি। প্রতিটি ম্যাচ ভিডিও রেফারেলের মাধ্যমে চালাচ্ছি। গতকালও ভিডিও রেফারেলের কারণে মসৃণভাবে ম্যাচ শেষ হয়েছে। যদিও এটা ব্যয়বহুল। কিন্তু চেষ্টা করব লিগেও এই ধারা অব্যাহত রাখতে। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ সরাসরি সম্প্রচার করা হবে। ”
এছাড়া ডাগ আউট থেকে কেউ গিয়ে মাঠে ঢুকে আম্পায়ার বা প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়দের হুমকি দিতে না পারে, শারিরীকভাবে লাঞ্ছিত না হয়, এ নিয়েও তৎপর থাকার কথা বলেছেন লিগ কমিটির সম্পাদক, “আমরা আরেকজন আম্পায়ার বেশি রাখতে চাই। টেন্টের বাইরে যাতে কেউ না যেতে পারে। ভেতরেই সবাইকে থাকতে হবে। ওগুলোর ব্যবস্থা করেছি আমরা। আশা করি এবার লিগ মাঝ পথে বন্ধ হবে না।”
খেলোয়াড় ও ক্লাব কর্তারা কী বলছেন
সর্বশেষ মৌসুমে ২০২১ সালের ক্লাব কাপ হকির গ্রুপ পর্বের ম্যাচে মারামারি করে এক ম্যাচ নিষিদ্ধ হয়েছিলেন রাসেল মাহমুদ জিমি। পাশাপাশি তাকে ৫০ হাজার টাকা আর্থিক জরিমানাও করা হয়। এবার জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক নিজেকে শান্ত রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়ে একটি প্রশ্নও তুলেছেন,“খেলায় উত্তেজনা থাকবেই। কিন্তু একটা ম্যাচ ভালোভাবে পরিচালনা করার জন্য ভিডিও রেফারেল যেন থাকে। এবার যদিও সেটা আছে কিন্তু রেফারেলের রিপ্লে টেলিভিশনে দেখানো হচ্ছে না। সেটা টেলিভিশনে দেখালে কারও মধ্যে কোনও সংশয় থাকে না। কোনও অভিযোগও থাকবে না। আমি নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করবো। আশা রাখি এবার কোনও বিশৃঙ্খল ঘটনা ঘটবে না। অনেকে আমার কথা বেশি বলে, আমি বেশি উত্তেজিত থাকি মাঠে। কিন্তু দলের প্রয়োজনে কখনও এমনটা করতেই হয়।”
৮ বছর পর আবারও প্রিমিয়ার হকি লিগে ফিরেছে অন্যতম ঐতিহ্যবাহী ক্লাব ঊষা ক্রীড়াচক্র। আবাহনী, মোহামেডান, মেরিনার্সের পাশাপাশি ঊষাও চ্যাম্পিয়নশিপের জন্য লড়াই করবে। মাঠের খেলায় যেমন প্রতিদ্বন্দ্বিতা চাইবে তারা, তেমনি মাঠের মধ্যে কোনও নেতিবাচক ঘটনা দেখতে চান না ক্লাবটির সাধারণ সম্পাদক রশিদ শিকদার, “আসলে হকি মাঠে মারামারি এখন কেউই আর পছন্দ করে না। তবে এটা তো আমি আপনি চাইলে থামাতে পারব না। এর জন্য যার যার জায়গা থেকে সচেতন থাকতে হবে। স্ব স্ব ক্লাব কর্মকর্তা, সমর্থকদের সহযোগিতা লাগবে। আমরা চাই হকি মৌসুম যেন বিতর্ক ছাড়াই শেষ হয় এবার।”
এটা অনেকের চাওয়া। তবে হকির ঘরোয়া মৌসুম নিষ্কলুষভাবে শেষ হলে নিশ্চিত একটা রেকর্ড হবে।