ঘটনা-১
গত ২০ সেপ্টেম্বর সুনামগঞ্জের আদালতে হাজির করা হয় গ্রেপ্তার সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানকে। আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয়। এরপর ৯ অক্টোবর তার জামিন আবেদনের শুনানিতে আদালতে ব্যাপক হট্টগোল হয় আওয়ামী লীগ-বিএনপি সমর্থক আইনজীবীদের মধ্যে। সুনামগঞ্জ জেলা দায়রা জজ আদালতের বিচারক হেমায়েত উদ্দিনের সামনেই তা ঘটে। এক পর্যায়ে এজলাস ছেড়ে যান তিনি।
ঘটনা-২
গত ৮ অক্টোবর ঢাকার দুটি হাকিম আদালত সাবেক পরিবেশমন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরীর জামিনের আবেদন মঞ্জুর করে। সঙ্গে সঙ্গেই আদালতে উপস্থিত বিএনপি সমর্থক আইনজীবীরা চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করে। তাতে তড়িঘড়ি করে এজলাস ছাড়েন বিচারক। কয়েকজন আইনজীবী এজলাসে রাখা টেবিলও উল্টে দেন।
ঘটনা-৩
গত ৭ অক্টোবর নওগাঁয় আদালতে হট্টগোল করে বিচারকের আদেশকে প্রভাবিত করার চেষ্টার অভিযোগ ওঠে বিএনপি সমর্থক আইনজীবীদের বিরুদ্ধে। জেলা বিএনপির কার্যালয়ে হামলা ও ভাঙচুরের মামলার আসামি শিক্ষক ফজলুল হকের জামিন শুনানিতে ঘটে এই ঘটনা। এজাহারে ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নেই বলে উপস্থাপন করেন তার আইনজীবী। তখনই এজলাসে উপস্থিত বিএনপির আইনজীবীরা ওই শিক্ষককে কারাগারে পাঠাতে চাপ দিতে থাকেন।
ঘটনা-৪
গত ৬ অক্টোবর যুবদল নেতা শামীম মোল্লা হত্যার মামলায় গ্রেপ্তার সাবেক মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ এবং ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ হুমায়ুন কবিরের রিমান্ড শুনানিতে বিএনপির আইনজীবীরা হট্টগোল করেন। তা দেখে বিরক্ত হয়ে ঢাকার অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম জিয়াদুর রহমান আইনজীবীদের উদ্দেশে বলেছিলেন, বিষয়টা এমন যেন না হয় যে কোর্টকে আপনারা ‘প্রেশার’ দিচ্ছেন।
ঘটনা-৫
গত ২৬ সেপ্টেম্বর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হামলার মামলায় এক আওয়ামী লীগ নেতার জামিন দেওয়াকে কেন্দ্র করে হট্টগোল ঘটে হবিগঞ্জের আদালতে। ওই সময় বিচারক এজলাস থেকে নেমে গেলে আরেক বিচারক এসে পরিস্থিতি শান্ত করেন। প্রথম বিচারক আসামির জামিন মঞ্জুর করলে হট্টগোল শুরু হয়। পরে ওই আসামির জামিন বাতিল করা হয়।
ঘটনা-৬
গত ২৯ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার বোন শেখ রেহানা, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালসহ ৪২৫ জনের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামে একটি মামলা করা হয়। এই মামলা নিয়ে হট্টগোল হয়, উত্তপ্ত হয় আদালত কক্ষ। বিচারক মামলাটি সরাসরি গ্রহণ না করে পিবিআইকে দিয়ে তদন্তের আদেশ দিয়েছিলেন। তারপর চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু হলে বিচারক বিব্রত হয়ে এজলাস থেকে নেমে খাস কামরায় চলে যান। এর কিছুক্ষণ পর সরাসরি থানায় মামলা নেওয়ার আদেশ দেন তিনি।
ঘটনা-৭
গত ২০ আগস্ট ঢাকার মোহাম্মদপুরে আবু সায়েদ নামে এক দোকানদার হত্যার মামলায় গ্রেপ্তার আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মন্ত্রী দীপু মনি এবং সাবেক ক্রীড়া উপমন্ত্রী আরিফ খান জয়ের রিমান্ডের আদেশ হয় ঢাকার হাকিম আদালতে। তবে শুনানিতে অসন্তুষ্ট বিএনপির আইনজীবীরা নানা স্লোগান দিতে থাকেন। এরই মাঝে এজলাস ছাড়েন বিচারক। এরপর দীপু মনি ও আরিফ খান জয়কে নিচে নামানো হলে তাদের কিল, ঘুষি মারেন কয়েকজন আইনজীবী। ধাক্কাধাক্কিতে সিঁড়ি থেকে পড়ে যান দীপু মনি।
এই সাতটি ঘটনায়ই শেষ নয়, রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর এমন ঘটনা ঘটেই চলছে দেশের বিভিন্ন আদালতে। আর এই হট্টগোলের লক্ষ্যবস্তু ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-এমপি ও দলটির নেতারা। সেই হট্টগোলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিচারকরাও রেহাই পাচ্ছে না।
দেড় দশকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়। তারপর শেখ হাসিনাসহ তার দলের নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা হতে থাকে। গ্রেপ্তারও হন অনেকে।
অধিকাংশ মামলায় রিমান্ড কিংবা জামিন শুনানিতে আসামিদের পক্ষে কোনও আইনজীবী না থাকলেও বিএনপি সমর্থক আইনজীবীরা মামলা পরিচালনা করতে রাষ্ট্রপক্ষকে সহায়তা করছে। তবে শুনানিতে প্রত্যাশিত আদেশ না পেলেই হৈ চৈয়ের পাশাপাশি বিচারকদের উদ্দেশ করে কটূ মন্তব্য, ফাইল নিক্ষেপ, টেবিল ধাক্কাসহ নানা ঘটনা ঘটছে। এর পাশাপাশি একদিন আবার আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীরা মিছিলও করে আদালতে।
এদেখে অনেকেই আইনজীবীদের পেশাগত আচরণ নিয়ে সমালোচনা করছেন। ন্যায়বিচার নিশ্চিতে যাদের কাজ করার কথা, তারা এমন কাজ করতে পারেন কি না, সেই প্রশ্নও উঠেছে।
আইনে কী আছে?
আইনজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ সংবিধান ও প্রচলিত আইন অনুযায়ী কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়।
বাংলাদেশ সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে েলখা আছে, সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।
সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র- ১৯৪৮ এর ৭ নং অনুচ্ছেদে কোনও ধরনের বৈষম্য ছাড়া আইনি প্রতিকার পাওয়ার ক্ষেত্রে সমান অধিকারের স্বীকৃতি রয়েছে।
সেই সব বিবেচনায় নিলে আইনজীবীদের চলমান আচরণ বিচার ব্যবস্থার প্রতি অশ্রদ্ধার প্রকাশ।
আইনজ্ঞরাা বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে আইন পেশার ওপর মানুষের আস্থা ও শ্রদ্ধা নষ্ট হয়ে যাবে। তাই আইন পেশার দেখভালে কার্যরত বিধিবদ্ধ সংস্থা বার কাউন্সিলকে তৎপর হতে হবে।
আইনজীবীর পেশাগত অসদাচরণ কী?
আইনজীবীদের পেশার সনদ প্রদান ও নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা হলো বাংলাদেশ বার কাউন্সিল। নতুন আইনজীবীদের তালিকাভুক্তের জন্য পরীক্ষা গ্রহণ, আইনজীবীদের পেশাগত আচরণের জন্য নীতিমালা নির্ধারণ, সব আইনজীবীর কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ, আইন পেশার মান রক্ষা এবং আইনজীবীদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের বিচার করে থাকে এই প্রতিষ্ঠানটি।
১৯৭২ সালের বাংলাদেশ লিগ্যাল প্র্যাকটিশনার্স ও বার কাউন্সিলের আদেশ দ্বারা বার কাউন্সিলের গঠন, নির্বাচন ও পরিচালনা পদ্ধতি নিয়ন্ত্রিত হয়। আইনজীবীদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে দ্য বাংলাদেশ লিগ্যাল প্রাকটিশনারস অ্যান্ড বার কাউন্সিল অর্ডার অ্যান্ড রুলস, ১৯৭২ এবং ক্যাননস অব প্রফেশনাল কনডাক্টে উল্লেখ রয়েছে।
বাংলাদেশ বার কাউন্সিল আইন অনুযায়ী, যদি কোনও আইনজীবী দায়িত্ব পালনে গাফিলতি, বিচারকের সঙ্গে খারাপ আচরণ, জামিনের বা বিভিন্ন জায়গায় ঘুষ দেওয়ার নাম করে টাকা গ্রহণ, বিপক্ষের সঙ্গে লেনদেন করা কিংবা নিজ মক্কেলের সঙ্গে প্রতারণা করে, তাহলে অসদাচরণের আওতায় পড়বে।
এই অবস্থার শিকার যে কেউই বাংলাদেশ বার কাউন্সিলে আবেদনের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট আইনজীবীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করে প্রতিকার পেতে পারেন।
আইনজীবীর জন্য ট্রাইব্যুনাল ও শাস্তি
কোনও আইনজীবীর অসদাচরণের কারণে কোনও ব্যক্তি সংক্ষুব্ধ হলে তিনি বার কাউন্সিলের সচিব বরাবর লিখিত অভিযোগ দিতে পারেন। বার কাউন্সিল সাধারণত সংক্ষিপ্ত শুনানিতে অভিযোগ নিষ্পত্তি করে থাকে।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ছোটখাটো ভুল বোঝাবুঝির মতো বিষয়গুলো উভয় পক্ষের উপস্থিতিতে সমঝোতার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করতে হয়। তবে অভিযোগ গুরুতর হলে বা সমাধান না করা গেলে বার কাউন্সিল তা বার কাউন্সিল ট্রাইব্যুনালে পাঠিয়ে দেয়।
অভিযোগ পাওয়ার পর ট্রাইব্যুনাল অভিযোগ তদন্ত করে এবং তদন্তে অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত না হলে তা নিষ্পত্তি করে দেয়। আর সত্যতা প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট আইনজীবীকে তিরস্কার করা, সদস্যপদ স্থগিত বা সমিতি থেকে বহিষ্কার করতে পারে ট্রাইব্যুনাল।
তবে কেউ যদি মিথ্যা বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে অভিযোগ করে এবং তা প্রমাণিত হয়, তবে তাকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে সংশ্লিষ্ট আইনজীবীকে ৫০০ টাকা দিতে হয়।
সংশ্লিষ্ট পক্ষ ট্রাইব্যুনালের রায়ের রিভিউ আবেদন করতে পারে। এছাড়া যেকোনও পক্ষ ট্রাইব্যুনালের রায়ের ৯০ দিনের মধ্যে হাইকোর্ট বিভাগে আপিল করতে পারবে।
এখনকার আচরণ কি অসদাচরণ?
ঢাকা মহানগর আদালতের সাবেক এপিপি আজাদ রহমান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, বিচারক ও আইনজীবী বিচার ব্যবস্থায় একে অন্যের পরিপূরক। এই দুটি ছাড়া দেশের বিচার ব্যবস্থা অচল।
“বিচারককে উদ্দেশ করে কটূ মন্তব্য, এজলাসে ফাইল নিক্ষেপ, টেবিল ধাক্কাসহ নানান অঙ্গভঙ্গি, হট্টগোল করা অসদাচরণের শামিল,” বলেন তিনি।
আইন পেশার সুনাম রক্ষা করতে এবং বিচার ব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থা রাখতে আইনজীবীদের এই ধরনের আচরণ থেকে বিরত থাকা উচিৎ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
আজাদ রহমান বলেন, একজন বিচারকও চাইলে অসদারণের জন্য আইনি পদক্ষেপ নিতে পারেন।
“যদি কোনও আইনজীবীর দ্বারা বিচারকের সাথে অসদাচরণের ঘটনা ঘটে, তবে ওই বিচারক বার কাউন্সিলে লিখিত অভিযোগসহ প্রধান বিচারপতি ও হাইকোর্টের রেজিস্ট্রার বরাবর অভিযোগ করতে পারেন। আইনানুযায়ী অভিযোগ প্রমাণিত হলে ওই আইনজীবীকে শাস্তি স্বরূপ তিরস্কার, বহিষ্কার ও সদস্যপদ স্থগিত করতে পারেন। এছাড়া আরও গুরুতর অপরাধ হলে দণ্ডবিধির আইনেই শাস্তি হতে পারে।”
গত ৫ আগস্টের পরে আওয়ামী লীগ নেতাদের পক্ষে অধিকাংশ মামলা পরিচালনা করে আসছেন অ্যাডভোকেট মোরশেদ হোসেন শাহীন।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “সম্প্রতি কিছু ঘটনা ঘটেছে, সেগুলো অবশ্যই অনাকাঙ্ক্ষিত। এতে বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা, বিশ্বাস কমে যায়।
“আমরা আশা করবো, আইনজীবীরা তাদের যে দায়িত্ব কর্তব্য রয়েছে বার কাউন্সিল নিয়ম অনুযায়ী তা মেনে চলবে। এতে করে আদালতের প্রতি মানুষের বিশ্বাস আস্থা ঠিক থাকবে। এর ব্যতিক্রম কিছু ঘটলে সেটা অবশ্যই অসদাচরণের মধ্যে পড়বে।”
এই সময়ের মামলাগুলোর শুনানিতে থাকা সদ্য নিয়োগ পাওয়া ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট ওমর ফারুক ফারুকী আইনজীবীদের সাম্প্রতিক আচরণগুলো অসদাচরণ মানতে নারাজ।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আদালতের সাথে আইনজীবীরা কোনও অসদাচরণ করেননি। শুনানির সময় অনেক সময় হট্টগোল হয়ে থাকে, তবে বাইরে আসলে আবার ঠিক হয়ে যায়। এগুলো অসদাচরণের মধ্যে পড়ে না।”
“আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর আদালতে এমন কোনও ঘটনা ঘটেনি। আর যাতে না ঘটে সেদিকে নজর রাখব,” বলেন ওমর ফারুক, যিনি চার দিন আগে পিপি হিসাবে নিয়োগ পান।
আইনজীবীদের পেশাগত আচরণ নিয়ে ঢাকা বারের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী, সাবেক পিপি এহসানুল হক সমাজী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “একজন আইনজীবী হলেন কোর্টের অফিসার। আইনজীবীর কাজ হচ্ছে আদালতকে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে আইনগত সহায়তা করা।”
বিভিন্ন মামলার শুনানিতে অনেক আইনজীবীর অংশ নেওয়ার বিষয়টি নিয়ে তিনি বলেন, “একজন আইনজীবী কোনও পক্ষের নিয়োগ ছাড়াও আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে মামলার বিষয়বস্তু নিয়ে কথা বলতে পারেন। অনুমতি নিয়ে কেউ কথা বলতে চাইলে সেক্ষেত্রে আইনে কোনও বাধা আছে বলে আমি মনে করি না।”
অসাদচরণের ঘটনা ঘটলে সেক্ষেত্রে বিষয়টি দেখতে আদালতের উদ্যোগ নেওয়ার ওপর জোর দেন তিনি।
“যদি কোনও আইনজীবী কোর্টের সাথে অসদাচরণ করে থাকেন, তাহলে সেই বিষয়টি দেখার দায়িত্ব একমাত্র সংশ্লিষ্ট কোর্টের। এখানে দ্বিতীয়/তৃতীয় পক্ষের অভিযোগ করার কোনও বিষয় নেই।”