চট্টগ্রাম শহরের সঞ্চালন লাইনে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। কক্সবাজারের মহেশখালীতে একটি এলএনজি টার্মিনালে কারিগরি ত্রুটি দেখা দেওয়ায় বৃহস্পতিবার রাত থেকে নগরীর বাসা-বাড়ি ও বাণিজ্যিক এলাকায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। শুক্রবার সকালে গ্যাস না থাকার বিষয়টি টের পায় নগরবাসী।
হঠাৎ এভাবে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকায় চরম ভোগান্তিতে পড়েন নগরবাসী। আবার গ্যাস সংকটে কমে গেছে বিদ্যুৎ উৎপাদনও, যদিও তার প্রভাব তেমনভাবে পড়তে দেখা যায়নি।
সমস্যা সমাধানে এলএনজি টার্মিনালটি মেরামতের কাজ চলছে বলে জানিয়েছে বিতরণ কতৃর্পক্ষ গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড (জিটিসিএল)। রাত ৯টা নাগাদ আবার গ্যাস সরবরাহ চালুর আশা করছে তারা।
ছুটির দিন শুক্রবার সকালে ঘুম থেকে উঠে গ্যাস না পেয়ে সবাই ছোটেন নগরীর হোটেলগুলোতে। কিন্তু চাহিদা বেশি থাকায় ৯টার মধ্যেই হোটেলের খাবার শেষ হওয়ায় অনেকেই ফিরেন খালি হাতে। এরপর ক্ষুধা নিবারণ করতে হয় শুকনা খাবার খেয়ে। কেউ কেউ রান্না সারেন ইন্ডাকশন কুকারে।
অন্যদিকে সিএনজি স্টেশনে গ্যাস না পেয়ে গ্যাস নির্ভরশীল গাড়ি ফেরত যাচ্ছে। ফলে নগরীতে কমে গেছে গণপরিবহনও।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জিটিসিএলের এক কর্মকর্তা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন,“মহেশখালীতে দুটি এলএনজি টার্মিনাল দিয়ে জাতীয় গ্রিডে গ্যাস সরবরাহ করা হয়। এর মধ্যে ‘এক্সিলারেট এনার্জি’ নামের একটি টার্মিনাল সিঙ্গাপুরে রক্ষণাবেক্ষণ শেষে গত ১৭ জানুয়ারি মহেশখালী পৌঁছেছে। আরেক টার্মিনাল ‘সামিট এনার্জি’ মেরামতের জন্য ২১ জানুয়ারি মহেশখালী থেকে সিঙ্গাপুর নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। এ কারণে সামিট টার্মিনাল থেকে সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়।”
ওই কর্মকর্তা বলেন, “রক্ষণাবেক্ষণ শেষে আসা ‘এক্সিলারেট এনার্জি’ টার্মিনালটি গত দুদিন ধরে সংযুক্ত করে গ্যাস সরবরাহের কাজ চলছিল। বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৯টা নাগাদ সেটি বন্ধ হয়ে যায়। তাই রাতে অনেক স্থানে গ্যাস বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু নগরবাসী বিষয়টি টের পান পরদিন সকালে। শুক্রবার সকাল থেকে এলএনজি সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। মেরামত করে আবার গ্যাস সরবরাহের প্রক্রিয়া চলছে।”
বিপর্যয়ের শুরু
মহেশখালীর দুটি টার্মিনাল থেকে দিনে গড়ে সাড়ে তিনশ মিলিয়ন ঘনফুট সরবরাহ সক্ষমতা চালুর পর পুরোপুরি এলএনজি নির্ভর হয়ে পড়ে চট্টগ্রাম। এলএনজি আসা কমবেশি হলে প্রথমেই সঙ্কটে পড়ে চট্টগ্রাম। এলএনজি আসার পর জাতীয় গ্রিড থেকে চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহ দেওয়া হয় না।
সর্বশেষ ২০২৩ সালের অক্টোবরের শেষদিকে এক্সিলারেট এনার্জি নামের ভাসমান টার্মিনালটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সিঙ্গাপুর নেওয়া হয়। এরপর থেকে দেশীয় সামিট এনার্জি টার্মিনালের মাধ্যমে চাহিদার চেয়ে অন্তত ৮০-৯০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস কম সরবরাহ দেওয়া হচ্ছিল। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম হওয়ায় চট্টগ্রামে গ্যাস সঙ্কট শুরু হয়। এ অবস্থায় দিনে বা রাতের একটা সময়ে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রেখে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হয়।
মেরামত শেষে বুধবার এক্সিলারেট এনার্জি টার্মিনাল চালু হয়। কিন্তু বৃহস্পতিবারই তাতে ত্রুটি দেখা দেয়। এতে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়।
সামিট এনার্জি টার্মিনালের কী অবস্থা
জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ নতুনভাবে দায়িত্ব নেওয়ার পর সংবাদকর্মীদের বলেছিলেন, ‘এক্সিলারেট এনার্জি’ চালু হলে সামিট এনার্জি টার্মিনালটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সিঙ্গাপুর নেওয়া হবে। আগামী মার্চের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত এই ইউনিটটির সংস্কারকাজ চলবে। এরপর আগামী রমজান ও বোরো সেচ মৌসুমকে সামনে রেখে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। ফলে গ্যাস সঙ্কটের পুরোপুরি সমাধান হতে সময় লাগবে মার্চ পর্যন্ত।
রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সিঙ্গাপুরে নেওয়ার অংশ হিসেবে দুদিন ধরে সামিটের ভাসমান টার্মিনালটি খোলার প্রক্রিয়া চলছিল। এই অবস্থায় সেই টার্মিনাল থেকে গ্যাস সরবরাহ ধীরে ধীরে কমানো হচ্ছিল। এরমধ্যেই এক্সিলারেট এনার্জি টার্মিনালে ত্রুটি দেখা দেওয়ায় চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে।
জিটিসিএলের ওই কর্মকর্তা বলেন, মাঝে সিদ্ধান্ত হয়েছিল- সামিটের টার্মিনালটি আরও পরে রক্ষণাবেক্ষণে নেওয়া হবে। কিন্তু দুদিন আগে সেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে সামিটের টার্মিনালটি রক্ষণাবেক্ষণে সিঙ্গাপুরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। সেটি চালু থাকলে বিপর্যয় হতো না। এখন সাময়িক সময়ের জন্য জাতীয় গ্রিড থেকে গ্যাস সরবরাহ দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যায়।
কী বলছে কর্ণফুলী গ্যাস বিতরণ কর্তৃপক্ষ
চট্টগ্রামে বাণিজ্যিক ও আবাসিকে গ্যাস সংযোগ ও সরবরাহ দেওয়ার কাজটি করে কর্ণফুলী গ্যাস বিতরণ কর্তৃপক্ষ (কেজিডিসিএল)। চট্টগ্রামে কেজিডিসিএলের মোট গ্রাহক সংযোগ ৬ লাখ ১ হাজার ৯১৪টি। এর মধ্যে গৃহস্থালি বা আবাসিক সংযোগ ৫ লাখ ৯৭ হাজার ৫৬১টি, বাকিগুলো শিল্প-বাণিজ্যসহ অন্য খাতে। এসব খাতে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা প্রায় ৩২৫ মিলিয়ন ঘনফুট।
প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. আবু সাকলায়েন শুক্রবার বিকালে সকাল সন্ধ্যাকে জানান, সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বেলা ৩টায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে জরুরি বৈঠক হয়েছে। শুক্রবার রাত ৯টা নাগাদ গ্যাস সরবরাহ চালু হতে পারে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
বিদ্যুৎ উৎপাদন কমলেও প্রভাব কম
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামে দৈনিক ১ হাজার ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে। কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে ৮০০ মেগাওয়াট। চট্টগ্রামের রাউজান ও শিকলবাহা বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র দুটি গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল। গ্যাস সঙ্কটে দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রই বন্ধ রয়েছে। ফলে উৎপাদনও কমে গেছে।
তবে উৎপাদন কমলেও তার তেমন প্রভাব এখনও পড়েনি বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড চট্টগ্রামের প্রধান প্রকৌশলী মো. রেজাউল করিম।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বৃহস্পতিবার রাতে ঘণ্টা দেড়েকের মতো বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটেছিল। শুক্রবার এমনিতেই চাহিদা কম থাকে, তার ওপর হচ্ছে শীতকাল। সে জন্য শুক্রবার সারাদিন লোডশেডিং করতে হয়নি। তবে শনিবার যদি এই অবস্থা থাকে তাহলে হয়তো কিছুটা লোডশেডিং হতে পারে।”
তিনি বলেন, এলএনজি নির্ভর দুটি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র বন্ধ থাকলেও মহেশখালীসহ অন্য এলাকায় উৎপাদিত বিদ্যুৎ দিয়ে সেটি সামাল দেওয়া যাচ্ছে। তেমন সমস্যা হয়নি।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য
চট্টগ্রামের গ্যাস সংকট নিয়ে পাঠানো মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, কক্সবাজারের মহেশখালীতে এলএনজি রূপান্তরের একটি ভাসমান টার্মিনালে (এলএনজি এফএসআরইউ) কারিগরি ত্রুটির কারণে চট্টগ্রাম এলাকায় সকাল থেকে গ্যাস সরবরাহ সাময়িকভাবে বন্ধ রয়েছে। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে অতি দ্রুত মেরামতের কাজ করছে মন্ত্রণালয়।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, শীতের কারণে দেশের অন্যান্য এলাকাতেও গ্যাসের স্বল্প চাপ রয়েছে। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ, পেট্রোবাংলা ও কোম্পানিগুলো এ বিষয়ে সার্বক্ষণিক তদারক করছে। দেশীয় গ্যাস উৎপাদন ও সরবরাহ অব্যাহত রয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে গ্রাহকদের সাময়িক অসুবিধার জন্য আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করেছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়।