সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের একটি বক্তব্য নিয়ে সরগরম চট্টগ্রামের রাজনৈতিক অঙ্গন। ওই বক্তব্যে তিনি নিজের সংসদীয় এলাকায় ‘দ্বৈত শাসন’ থাকবে না বলে হুঁশিয়ারি দেন। একইসঙ্গে সেই এলাকায় নিজের দল কিংবা অন্য দলের কাউকে সমাবেশ করতে হলে এক সপ্তাহ আগে অনুমতির নিয়ম চালু করতে নির্দেশ দেন তিনি।
আনোয়ারা ও কর্ণফুলী উপজেলা নিয়ে গঠিত চট্টগ্রাম-১৩ আসনে এনিয়ে চতুর্থ বার সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামান, যার বাবা আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুও ছিলেন একই এলাকার সংসদ সদস্য।
শেখ হাসিনার দুটি সরকারে প্রতিমন্ত্রী ও মন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের পর এবার বাদ পড়েন সাইফুজ্জামান। বিপরীতে এবার অর্থ প্রতিমন্ত্রী হয়েছেন একই এলাকার ওয়াসিকা আয়শা খান। আওয়ামী লীগেরই আরেক নেতা আতাউর রহমান খান কায়সারের মেয়ে ওয়াসিকা নারী আসনের সংসদ সদস্য।
সরাসরি নাম না বললেও সাইফুজ্জামানের বক্তব্য ওয়াসিকাকে ঘিরেই বলে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা চলছে। সেই বক্তব্যে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণের ইঙ্গিতও পাচ্ছেন অনেকে।
ওয়াসিকা এনিয়ে তিনবার নারী আসন থেকে সংসদে গেলেও এবারই প্রথম মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পেলেন। তিনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে অর্থ ও পরিকল্পনা বিষয়ক সম্পাদকের পদে রয়েছেন।
ওয়াসিকার বাবা প্রয়াত আতাউর রহমান খান কায়সারও এক সময় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় অর্থ সম্পাদক ছিলেন। পরে সভাপতিমণ্ডলীরও সদস্য হন। চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগেও এক সময় সাধারণ সম্পাদক ছিলেন কায়সার।
আখতারুজ্জামান বাবু স্বাধীনতার পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। কেন্দ্রীয় সভাপতিমণ্ডলীতেও ছিলেন তিনি। সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বরাবর তিনিই পেতেন। তিন বার সংসদ সদস্যও হন তিনি।কায়সার ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচন করলেও কখনও সংসদে প্রতিনিধিত্ব করা হয়নি।
কী বলেছিলেন সাইফুজ্জামান
আনোয়ারা উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে শুক্রবার এক সভায় সাইফুজ্জামান বলেন, “আমাদের দল বা অন্য দলের কেউ যদি এখানে সমাবেশ করতে চায়, তাদের অন্তত এক সপ্তাহ আগে অনুমতি নিতে হবে। আপনি আগামীকাল সমাবেশ করবেন আর আজকে অনুমতি নেবেন, এটা হবে না। আজ থেকে আমার এই নির্দেশ কার্যকর হবে।”
মঞ্চে থাকা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইশতিয়াক ইমনের দিকে ফিরে সাবেক মন্ত্রী সাইফুজ্জামানকে বলতে শোনা যায়, “ইউএনও সাহেব, আপনি আমার ক্লিয়ার মেসেজ পেয়েছেন?”
পরে বক্তব্যে ফিরে তিনি বলেন, “এটা আমার নির্বাচনী এলাকা এবং আমি এই আসনের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। এখানে কোনও দ্বৈত শাসন থাকবে না।”
কারও নাম উল্লেখ না করে সাইফুজ্জামান বলেন, “কে কী হয়েছে, কে বড় কী হয়েছে, সেটা আমার দেখার বিষয় নয়। এই নির্বাচনী এলাকা আমার। আমি এলাকার নির্বাচিত সংসদ সদস্য। কেউ যদি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চায়, আমি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বলবো কঠোর হস্তে দমন করতে। আর আমি খুব ভালো করেই জানি কীভাবে পরিস্থিতি ট্যাকল (সামাল) দিতে হয়।”
সাইফুজ্জামানের বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে আনোয়ারার ইউএনও ইশতিয়াক ইমন বলেন, “সমাবেশ নগরীতে হলে চট্টগ্রাম পুলিশ কমিশনারের অনুমতি নিতে হয় এবং নগরীর বাইরে হলে জেলা পুলিশ সুপারের অনুমতি নিতে হয়।
“উপজেলা প্রশাসন থেকে কোনও অনুমতি দেওয়া হয় না। আর সভা-সমাবেশের অনুমতির বিষয়ে এমপি স্যার বলেছেন। কেন বলেছেন, তা তো আমি বলতে পারবে না।”
আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা, এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ২০১২ সালে মারা যাওয়ার পর উপনির্বাচনে নৌকার প্রার্থী হয়ে রাজনীতিতে আসেন সাইফুজ্জামান। তার আগপর্যন্ত তিনি পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী ছিলেন।
২০১৪ সালের সরকারে ভূমি প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান তিনি। ২০১৮ সালের সরকারে পদোন্নতি পেয়ে একই দপ্তরের মন্ত্রী হন। ভূমি বিভাগের ডিজিটালাইজেশন এবং বড় ধরনের সংস্কার করে সাইফুজ্জামান সুনাম কুড়ালেও এবার নির্বাচনের আগে বিদেশে তার বিপুল সম্পদ গড়ার অভিযোগ ওঠে। ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রায় ২০০ মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের ৩৫০টিরও বেশি সম্পত্তি তার রয়েেছ যুক্তরাজ্যে।
এমন অভিযোগের পর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে বিজয়ী হলেও মন্ত্রিসভায় তার ঠাঁই হয়নি। ভূমি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি করা হয়েছে তাকে।
অন্যদিকে আনোয়ারা এলাকারই বাসিন্দা নারী সংসদ সদস্য ওয়াসিকা আয়শা খান অর্থ মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্ব মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পর পর আনোয়ারায় তাকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের আরেকটি বলয় তৈরি হয়, যাতে সাইফুজ্জামানের একচ্ছত্র আধিপত্য খর্ব হতে থাকে।
নেপথ্যে কী
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাইফুজ্জামান চৌধুরীর ক্ষুব্ধ হওয়ার মুল কারণ আনোয়ারায় ওয়াসিকা আয়শা খানের দুটি জনসভায় অংশগ্রহণ।
ওয়াসিকা প্রতিমন্ত্রী নির্বাচিত হলে ৯ মার্চ কর্ণফুলী উপজেলা এবং একই দিন বিকালে আনোয়ারা উপজেলায় দুটি সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়। সেখানে দুটি উপজেলার দলীয় শীর্ষ নেতারা উপস্থিত না থাকলে বেশ জনসমাগম হয়।
সাইফুজ্জামান এই দুই সমাবেেশ যোগ না দিলেও পাশের পটিয়া আসনের সংসদ সদস্য মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন।
এরপর ২৩ মার্চ আনোয়ারা উপকূলীয় এলাকার বেড়িবাঁধ নির্মাণকাজ পরিদর্শনে গিয়ে সেখানে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ তোলেন ওয়াসিকা।
সেখানে তিনি বলেছিলেন, “চট্টগ্রামে অনেক অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে। ঢাকার সাথে তাল মিলিয়ে চট্টগ্রামেও উন্নয়ন হচ্ছে। সবাই জননেত্রী শেখ হাসিনার জন্য দোয়া করবেন।
“এখানে যারা আছেন সকলেই আপনাদের লোক। আপনাদের নেতা। মনে কষ্ট থাকতে পারে, কিন্তু রাজনীতিতে শেষ বলে কিছু নেই। আমাদের সবাইকে কাজ করতে হবে। আমার পিতা কখনও আনোয়ারা-কর্ণফুলীকে আলাদাভাবে দেখেননি। আমিও আপনাদের আলাদা করব না। আমি আনোয়ারা-কর্ণফুলীর বঞ্চিত নেতা-কর্মীদের নিয়েই এগিয়ে যাব।”
সেই জনসভার পর থেকেই চট্টগ্রাম-১৩ (আনোয়ারা-কর্ণফুলী) আসনে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে বিভাজনে রেখা দেখা যেতে শুরু করে। এরপর ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন পালন ঘিরে স্পষ্ট হয় বিভাজন।
সেদিন সাইফুজ্জামান চৌধুরী সমর্থকরা মইজ্জারটেক আখতারুজ্জামান বাবু চত্বরে দোয়া মাহফিল আয়োজন করে। আবার শিকলবাহার আলাদা কর্মসূচি আয়োজন করে ওয়াসিকা আয়শা খানের সমর্থকরা।
দুটি আয়োজন একেবারে কাছাকাছি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ঝামেলা এড়াতে একটি অনুষ্ঠানের স্থান পরিবর্তন করে দেয় উপজেলা প্রশাসন। ওয়াসিকা ও সাইফুজ্জামান দুজনের কেউই কোনও অনুষ্ঠানে ছিলেন না। তবে বিভাজন প্রকাশ্যে আসার পর ২৯ মার্চ নিজ এলাকায় আসেন সাইফুজ্জামান। এরপর তার বক্তব্য ঘিরেই এখন চলছে আলোচনা।
এবিষয়ে কথা বলতে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। সাড়া মেলেনি ওয়াসিকা আয়শা খানেরও।
দুই নেতার আচরণ দলে প্রভাব ফেলবেই বলে মনে করেন কর্ণফুলী উপজেলার বাসিন্দা নুরুল কাইয়ুম খান, যিনি এর আগে দুবার এমপি পদে দলীয় মনোনয়ন চেয়ে পাননি।
ব্যবসায়ী কাইয়ুম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “দুজনই শ্রদ্ধাভাজন নেতার পুত্র-কন্যা। ফলে তাদের কাছ থেকে এমন আচরণ দলীয় রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবেই। বিশৃঙ্খলা তৈরি করবে।”
“সেরকম কিছু হোক, আমরা চাই না। সবাই বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কর্মী। সবাইকে মিলেমিলে কাজ করতে হবে। নিশ্চয়ই দলের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে নির্দেশনা আসবে। আমরা সেটা মেনে চলবে,” বলেন দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের এই সদস্য।