চট্টগ্রাম বন্দরের পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনাল (পিসিটি) পরিচালনা শুরু করেছে সৌদি আরবভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘রেড সি গেইটওয়ে’। এর মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম কোনও বিদেশি প্রতিষ্ঠান টার্মিনাল পরিচালনার কাজ শুরু করল।
চট্টগ্রাম বন্দর, মোঙলা বন্দর, পায়রা সমুদ্রবন্দরে কেবল দেশি প্রতিষ্ঠানই পণ্য উঠানামা বা পরিচালনা কাজ এতদিন করে আসছিল। এই প্রথম আর্ন্তজাতিক কোনও অপারেটর এই কাজে যুক্ত হলো।
একে মাইলফলক হিসাবে দেখছেন বন্দর ব্যবহারকারীরা। তারা বলছেন, এরমধ্য দিয়ে দেশি অপারেটর প্রতিষ্ঠানের পরিচালন কাজের সাথে বিদেশি বা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের তুলনা করার সুযোগ তৈরি হবে। দেশি অপারেটররা নিজেদের সক্ষমতা বাড়ানোর চাপে পড়বে।
‘মায়ার্সক ডাভাও’ নামের কন্টেইনার জাহাজ সোমবার বিকালে ভিড়েছে কর্ণফুলী নদীর তীরঘেঁষে চট্টগ্রাম বোট ক্লাব সংলগ্ন এলাকায় গড়ে উঠা এই পিসিটি টার্মিনালে।
সিঙ্গাপুরের পতাকাবাহী জাহাজটি নিয়মিত মালয়েশিয়ার পোর্ট কেলাং থেকে চট্টগ্রাম বন্দর রুটে পণ্য পরিবহন করছিল। এই প্রথম সেটি পিসিটিতে ভিড়ল এবং ইতিহাসের অংশ হলো। জাহাজটির দৈর্ঘ্য প্রায় ১৮৮ মিটার ও গভীরতা বা ড্রাফট সাড়ে ৯ মিটার।
কিন্তু পিসিটিতে এরচেয়ে বড় জাহাজ ভেড়ার সক্ষমতা আছে। এই টার্মিনালের তিনটি জেটিতে ২শ মিটার দীর্ঘ এবং ১০ মিটার গভীরতার জাহাজ ভিড়তে পারবে। অর্থাৎ চট্টগ্রাম বন্দরে বর্তমানে যত টার্মিনাল-জেটি আছে, তার চেয়ে বড় জাহাজ পিসিটিতে ভিড়তে সক্ষম।
বন্দর কর্মকর্তারা জানান, প্রথম দিনে পিসিটিতে ভেড়া ‘মায়ার্সক ডাভাও’ জাহাজে শুধু রপ্তানি কন্টেইনার জাহাজীকরণ করা হবে। সেই সঙ্গে নেওয়া হবে কিছু খালি কন্টেইনার। পিসিটিতে যেহেতু এখনও কী গ্যান্ট্রি ক্রেন বসেনি, সেজন্য জাহাজে থাকা ক্রেন দিয়েই কন্টেইনার উঠানামা করা হবে।
পিসিটিতে জাহাজ থেকে আমদানি কন্টেইনার নামানো হয়নি। মুলত বেশ কিছু কারিগরি বিষয় চালু না হওয়া এবং স্ক্যানার মেশিন স্থাপন না করায় আপাতত জাহাজ থেকে আমদানি কন্টেইনার নামানো হচ্ছে না। ফলে রপ্তানি কন্টেইনার জাহাজীকরণ করেই পিসিটির কার্যক্রম শুরু হবে।
কবে নাগাদ আমদানি কন্টেইনার নামানো সম্ভব হবে তা নিয়ে রেড সি গেইটওয়ে এর কর্মকর্তারা সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ বলতে পারেননি। আবার বন্দর কর্তৃপক্ষ এবিষয়ে কোনও মন্তব্য করেনি।
ড্যানিশভিত্তিক বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ শিপিং কোম্পানি মায়ার্সক লাইনের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “মায়ার্সক ডাভাও জাহাজটি ৯ জুন প্রথমে বন্দরের জিসিবি-৯ নম্বর জেটিতে ভিড়ে। সেখানে আমদানি কন্টেইনার নামিয়ে ১০ জুন পিসিটিতে ভিড়ে। আমরা আশা করছি রপ্তানি এবং খালি কন্টেইনার সবমিলিয়ে ১৪শ একক (প্রতিটি ২০ ফুট দীর্ঘ হিসেবে) কন্টেইনার জাহাজীকরণ করতে পারব।”
তিনি বলেন, “প্রথমবার চট্টগ্রামে বিদেশি অপারেটরের সাথে কাজ করতে কিছু সিনক্রোনাইজিংয়ের বিষয় আছে। তাদের সাথে আমাদের বোঝাপড়া তৈরি হতে কিছুটা সময় লাগবেই। এরপর আমরা টার্গেট অনুযায়ী কাজ করতে পারব। সেটি সম্ভব হলে চট্টগ্রাম বন্দরের মুল জেটি-টার্মিনাল থেকে কমপক্ষে রপ্তানির চাপটা আমরা কমিয়ে আনতে পারব।”
রেড সি’র এক কর্মকর্তা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “১৪শ একক কন্টেইনার জাহাজীকরণ করতে মঙ্গলবার পর্যন্ত আমরা সময় রেখেছি। জাহাজের ক্রেন দিয়ে সব কন্টেইনার বোঝাই করতে হবে বিধায় সময় কিছুটা বেশি লাগবে। আর কন্টেইনার বোঝাই শেষ হয়ার পর কর্ণফুলী নদীতে জোয়ার থাকলেই কেবল কালকে আমরা জাহাজ পিসিটি ছাড়তে পারব। তা না হলে বুধবার সকালেই জাহাজটি বন্দর ছাড়বে।”
জাহাজ ভেড়ানো উপলক্ষে পিসিটি চত্বরেই চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং রেড সি গেইটওয়ে টার্মিনাল চট্টগ্রাম যৌথভাবে সংক্ষিপ্ত অনু্ষ্ঠানের আয়োজন করে সোমবার দুপুরে। একেবারে সময় মেনে শুরু হওয়া এই অনুষ্ঠানে রেড সি গেইটওয়ে টার্মিনাল ইন্টারন্যাশনাল (আরএসজিটিআই) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এরউইন হেইজ বলেন, “আমরা ক্যাপ্টেন মায়ো মিন থান এবং মায়ার্সক ডাভাওকে আরএসজিটি-চট্টগ্রামে স্বাগত জানাতে পেরে গর্বিত এবং এই নতুন কনসেশন চুক্তির অধীনে প্রথম আনুষ্ঠানিক জাহাজ আগমনের গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক উদযাপন করছি।”
তিনি বলেন, “আমরা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এবং বৈশ্বিক লজিস্টিক চেইনে চট্টগ্রাম বন্দরের ভূমিকা বাড়াতে অবদান রাখতে চাই। আমরা বাংলাদেশ সরকার, বন্দর কর্তৃপক্ষ, এনবিআর, কাস্টমস এবং আমাদের দীর্ঘসময়ের ব্যবসায়িক অংশীদার মায়েরস্ককে ধন্যবাদ ও আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই। তারা আমাদের বাংলাদেশের শিপিং কমিউনিটি এবং বৈশ্বিক বন্দর শিল্পকে বিশ্বমানের সেবা দেওয়ার সুযোগ দিয়েছে।”
চট্টগ্রাম বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল বলেন, “ল্যান্ডলর্ড প্রক্রিয়ায় বন্দর পরিচালিত হয় বিশ্বজুড়ে। আমরা পিসিটি দিয়ে সেই প্রক্রিয়া শুরু করে ইতিহাসের সাক্ষী হলাম। এ মুহূর্ত চট্টগ্রাম বন্দর ও বাংলাদেশের জন্য বিশেষভাবে স্মরণীয়। আশা করি, এভাবে বিদেশি গ্লোবাল বড় পার্টনারদের সঙ্গে আমরা কাজ করব। যাতে সার্বিকভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার অনেকগুণ বেড়ে যাবে। আমাদের অনেক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে।”
২০১৭ সালের ৮ সেপ্টেম্বর পিসিটি নির্মাণ প্রকল্পের ভিত্তি স্থাপন করা হয়। নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে। বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজস্ব তহবিল থেকে প্রায় ১ হাজার ২৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে পিসিটি নির্মাণ করে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের নকশা অনুযায়ী সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের তত্ত্বাবধানে দেশীয় প্রতিষ্ঠান সাইফ পাওয়ারটেকের সহযোগি প্রতিষ্ঠান ই-ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড এটির নির্মাণ কাজ করে।
২০২২ সালের মাঝামাঝি নির্মাণকাজ শেষ হলেও নানা কারণে চালু হয়নি এই টার্মিনাল। অবশেষে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের আওতায় সৌদি আরবের রেড সি গেটওয়ে লিমিটেডের সঙ্গে গত ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে চুক্তি সম্পাদনের পর তাদের এই টার্মিনালটি পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু কাজ শুরু করতেই ছয়মাস লাগল।
পিসিটি টার্মিনালে মোট তিনটি কন্টেইনার জাহাজ ভেড়ার জেটি আছে; যার দৈর্ঘ্য ৫৮৪ মিটার। এছাড়া ১টি ২০৪ মিটারের তেল খালাসের ডলফিন জেটি, ৮০ হাজার বর্গমিটার ইয়ার্ড নির্মিত হয়েছে। এই জেটি ২০০ মিটার দীর্ঘ এবং ১০ মিটার গভীরতার জাহাজ ভিড়ানো যাবে।সব সরঞ্জাম সংগ্রহ করে পিসিটি পূর্ণ সক্ষমতায় যেতে আরও এক বছর সময় লাগতে পারে। শর্ত অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সব ইকুইপমেন্ট সংগ্রহ করবেরেড সি গেটওয়ে লিমিটেড। আর চুক্তিমতো চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ তাদের কাছ থেকে নির্দিষ্ট হারে মাশুল পাবে।