ঘূর্ণিঝড় রেমাল এখণ স্থল নিম্নচাপ, নামিয়ে ফেলা হয়েছে মহাবিপদ সংকেত। কিন্তু সাগর এখন ফুঁসছে। সেই কারণে বহির্নোঙর থেকে পণ্যবাহী জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরের মুল জেটিতে ভিড়তে পারছে না।
রেমালের উপকূল অতিক্রমে বিপদ সংকেত নেমে যাওয়ায় সোমবার সকাল থেকে জাহাজ চলাচল শুরুর কথা ছিল। সে অনুযায়ী বন্দরের পাইলটরা বন্দর থেকে রওনা দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন, কিন্তু কর্ণফুলী নদীর মোহনায় সাগরের উত্তাল অবস্থা দেখে ফেরত আসেন।
ফলে সোমবার ১৯টি জাহাজ বন্দর জেটিতে আসার কথা থাকলে কোনও জাহাজই ভেড়েনি বলে জানান চট্টগ্রাম বন্দরের ডেপুটি কনজারভেটর ক্যাপ্টেন ফরিদুল আলম।
ঘূর্ণিঝড় রেমালের ব্যতিক্রমী আচরণের কথা আবহাওয়াবিদদের নজরেও এসেছে। তারা বলছেন, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব ৪০ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে স্থায়ী হওয়াটা আগে দেখা যায়নি।
মঙ্গলবার সকালেও জাহাজ আনার প্রস্তুতি নেন চট্টগ্রাম বন্দরের পাইলটরা। উত্তাল সাগরের সঙ্গে লড়াই করে দুপুর ১২টা পর্যন্ত মাত্র ৬টি কন্টেইনার জাহাজ জেটিতে আনতে পেরেছেন তারা।
কেন এমন হচ্ছে- জানতে চাইলে ক্যাপ্টেন ফরিদুল আলম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “সাগর এতটাই উত্তাল ছিল যে কোনওভাবেই সামনে আগানো যাচ্ছিল না।
“ফলে সোমবার ১৯টি জাহাজ জেটিতে আনার কথা থাকলে একটি ভেড়েনি। আজ (মঙ্গলবার) যথারীতি বহির্নোঙরে ঝুঁকি নিয়ে যান পাইলটরা। কিন্তু সাগরে রোলিংয়ের কারণে মাত্র ৫টি জাহাজ জেটিতে আনতে পেরেছেন। আরও একটি জাহাজ আসার পথে আছে। অর্থ্যাৎ ৬টি জাহাজ জেটিতে ভিড়তে পারবে।”
বিদেশ থেকে পণ্যবাহী যেসব জাহাজ বহির্নোঙরে পৌঁছে, সেগুলো সরাসরি চট্টগ্রাম বন্দরের মুল জেটিতে আসতে পারে না। জাহাজগুলোতে থাকা বিদেশি ক্যাপ্টেনের বদলে চট্টগ্রাম বন্দরের নিজস্ব পাইলটরা সেইসব জাহাজ বহির্নাঙর থেকে চালিয়ে বন্দর জেটিতে আনেন।
কোনদিন কোন জাহাজ জেটিতে ভিড়বে, তা নির্ধারিত হয় বার্থিং মিটিংয়ে। সেই মিটিংয়ে অনুমোদন পাওয়া জাহাজগুলোই কেবল জেটিতে ভিড়তে পারে। আর বন্দর পাইলটরা না আনা পর্যন্ত জাহাজগুলোকে বহির্নোঙরেই অপেক্ষায় থাকতে হয়।
প্রবল ঘুর্ণিঝড় রেমাল আঘাত হানার আগে আবহাওয়া অধিদপ্তর বিপদ সংকেত দেখাতে বললে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ সতর্কতা হিসেবে নিজস্ব অ্যালার্ট-৪ জারি করে।
এরই অংশ হিসেবে চট্টগ্রাম বন্দরের ভিতর-বাইরে পণ্য উঠানামার সব ধরনের পরিচালন কাজ বন্ধ ঘোষণা করা হয়। বন্দরের ভেতরে জেটিতে থাকা জাহাজগুলো বহির্নোঙরে নিরাপদে চলে যায়। আর বহির্নোঙরে থাকা সব ধরনের জাহাজকে নিরাপদে থেকে ইঞ্জিন সচল রাখতে বলা হয়। আর জেটি-টার্মিনালে যেসব বড় যন্ত্রপাতি ছিল, সেগুলোকে গুটিয়ে ঝুঁকি থেকে বাঁচার পরামর্শ দেওয়া হয়।
রবিবারই বন্দরের জেটিতে থাকা ১৯টি জাহাজ বহির্নোঙরে পাঠানো হয়। সংকেত প্রত্যাহারের পর সেই জাহাজগুলোকে সোমবারই জেটিতে আনার কাজ শুরু হয়। এরমধ্যে মঙ্গলবার পর্যন্ত মাত্র ছয়টি জাহাজ জেটিতে ভিড়ার সুযোগ পায়। বাকি জাহাজগুলো সাগরেই অলস বসে আছে।
এক একটি জাহাজ বহির্নোঙরে অলস বসে থাকার জন্য আকারভেদে ১০ থেকে ১৫ হাজার মার্কিন ডলার ভাড়া বাবদ গুনতে হয়। সেই ভাড়া শেষপর্যন্ত পণ্যের দামের সঙ্গেই যোগ করে শিপিং লাইনগুলো।
ঘুর্ণিঝড়ের ঝুঁকি কেটে যাওয়ার পর চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রম শুরুর ঘোষণা দিয়েছিল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু যথাসময়ে জাহাজ না আসায় সোমবার পুরো দিনই অলস সময় কাটে বন্দরের। বন্দর কর্তৃপক্ষ সেদিন শুধু পণ্য ডেলিভারি দিয়েই সময় পার করে। জাহাজ থেকে আমদানি পণ্য জাহাজ থেকে নামানো, রপ্তানি পণ্য জাহাজীকরণ কিছুই হয়নি।
বন্দর কর্তৃপক্ষ আশা করছে, মঙ্গলবার থেকে এসব কাজ শুরু হবে। কিন্তু ভারি বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকলে বন্দরের মুল জেটিতে সাধারণ বা খোলা পণ্যবাহী জাহাজ জেটিতে ভিড়লেও পণ্য নামানো যাবে না। বৃষ্টির সময় কেবল কন্টেইনার ভর্তি পণ্য উঠানামা করা যাবে।
বন্দর কর্মকর্তারা জানান, সাগরে এই মুহূর্তে আরও ৬৯টি পণ্যবাহী জাহাজ অলস বসে আছে। সাগর শান্ত না হওয়া পর্যন্ত সেই জাহাজগুলোকে বহির্নোঙরেই অপেক্ষায় থাকতে হবে। কারণ সেসব জাহাজ থেকে পণ্য নামানোর জন্য শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটররা। উপকূল থেকে সাগরে যাওয়া সম্ভব না হওয়ায় সেসব জাহাজ থেকে পণ্য নামানো বা লাইটারিং কাজও বন্ধ আছে।
জানতে চাইলে শিপ হ্যান্ডলিং বার্থ অপারেটর টার্মিনাল অপারেটর ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মশিউল আলম স্বপন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “অন্য ঘুর্ণিঝড়ের পর সাগর একদিন পরই স্বাভাবিক হয়ে আসে। কিন্তু গত দুদিন ধরে এতটাই উত্তাল এবং এত বেশি বাতাস যে জাহাজ নিয়ে সাগরে যাওয়া অসম্ভব বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এত ঝুঁকি নিয়ে শ্রমিক এবং আমরা নিজেরাও কাজ করতে পারবো না। ফলে সাগর শান্ত না হওয়া পর্যন্ত লাইটরিং কাজ শুরু করা যাবে না।”