ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তাদের আমলে নিয়োগ পাওয়া উপাচার্যরাও বিদায় নিেয়ছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদটিও এখন শূন্য। সেই শূন্য পদে নিয়োগ পেতে তৎপর বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী সমর্থক শিক্ষকরা। তবে আওয়ামী লীগ আমলে তারা একজোট থাকলেও এখন নিজেদের মধ্যে বিবাদ বেঁধেছে।
বিএনপি-জামায়াত শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দল থেকে উপাচার্য পদে ড. শামীম উদ্দিন খানকে চাওয়া হয়েছে। তার প্রতিবাদ জানিয়েছে বিএনপি সমর্থক শিক্ষকদের সংগঠন জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরাম। আওয়ামী লীগ ও বাম সমর্থক শিক্ষকদের সংগঠন হলুদ দল পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এই লড়াইয়ে নেই।
১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশ অনুযায়ী স্বায়ত্তশাসিত অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ও পরিচালিত হয়। এই আইন অনুসারে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ হয় সিনেটে ভোটের মাধ্যমে। সিনেটে মনোনীত তিনজনের প্যানেল থেকে আচার্য (রাষ্ট্রপতি) একজনকে চার বছরের জন্য নিয়োগ দেন।
তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে এই নিয়মটির ব্যত্যয় বরাবরই ঘটে আসছে।
আওয়ামী লীগ সরকার আমলে পাঁচ মাস আগে একইভাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য পদে নিয়োগ পেয়েছিলেন অধ্যাপক আবু মো. তাহের। সরকার পতনের পর চাপের মুখে তিনি ১১ আগস্ট পদত্যাগ করেন।
এবার আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েরই সাবেক শিক্ষক নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হলেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পদগুলো করায়ত্ত করতে মরিয়া দেখা যাচ্ছে দেড় দশকের বেশি সময় ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির সমর্থকদের।
উপাচাযশূন্য বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে শীর্ষপদ পূরণ নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কোনও নির্দেশনা না এলেও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হতে তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন উপাচার্য থেকে শুরু করে উপ উপাচার্য, প্রক্টরিয়াল বডি, আবাসিক হলের প্রভোস্ট সব পদই ফাঁকা। অভিভাবকহীন অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয় ১৯ আগস্ট থেকে খোলার সিদ্ধান্ত থেকে বাধ্য হয়েই সরে এসেছে কর্তৃপক্ষ।
আবার এই আন্দোলনের পর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মচারীদের রাজনীতি নিষিদ্ধের ঘোষণা এলেও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তেমন কোনও ঘোষণা আসেনি। তার মধ্যেই রাজনৈতিক দলের আশীর্বাদপুষ্ট হয়েই উপাচার্য হতে তোড়জোড় শুরু হয়েছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকরা মূলত তিনটি রাজনৈতিক শিবিরে বিভক্ত। আওয়ামী লীগ ও বাম শিক্ষকদের হলুদ দল, বিএনপি ও জামায়াত সমর্থক শিক্ষকদের সাদা দল এবং শুধু বিএনপি সমর্থক শিক্ষকদের জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরাম।
সর্বশেষ ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে সিন্ডিকেট নির্বাচনে হলুদ দলের মধ্যে বিভক্তি দেখা গিয়েছিল। আবার সাদা দল ও জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরামও আলাদাভাবে নির্বাচনে অংশ নেয়। ফলে তাদের বিভক্তি আগে থেকেই ছিল। এখন তা আবার প্রকাশ্যে এল।
গত ২১ আগস্ট সাদা দল সাধারণ সভা করে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দুটি সিদ্ধান্তের কথা জানায়।
প্রথমত, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য-উপ উপাচার্যসহ সব শূন্য পদে নিয়োগ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক এবং প্রশাসনিক কার্যক্রম দ্রুত শুরু করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, শিক্ষাগত, প্রশাসনিক যোগ্যতার বিচারে সাদা দলের আহবায়ক সিন্ডিকেট সদস্য অধ্যাপক শামীম উদ্দিন খানকে উপাচার্য নিয়োগ করতে হবে।
প্রাণ রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আতিয়ার রহমানের স্বাক্ষরে আসা এই সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সাধারণ সভায় অনেক শিক্ষকের উপস্থিতির কথা জানানো হয়।
এর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পাল্টা বিজ্ঞপ্তি আসে জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরাম থেকে।
তাতে বলা হয়, “আমরা গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ করছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় শিক্ষক তথাকথিত স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, ধর্মীয় মুল্যবোধ জাতীয়তাবাদী আদর্শে উজ্জীবিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সাদা দলের নাম ব্যবহার করে জনৈক জামায়াতপন্থী শিক্ষককে উপাচার্য মনোনয়ন দেওয়ার দাবি সম্বলিত একটি প্রেসনোট প্রচার করছে। এ বিষয়ে আমাদের অবস্থান পরিস্কার করা জরুরি মনে করছি।”
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সাদা দল বলে কোনও মোর্চা এখন আর সক্রিয় নেই দাবি করে তারা বলেছে, “বর্তমানে সাদা দল বলতে জামায়াত সমর্থিত শিক্ষকদের দলকে বোঝায়। মতাদর্শগত কারণে জামায়াত সমর্থিত শিক্ষকদের থেকে আলাদা হয়ে জাতীয়তাবাদী আদর্শের শিক্ষকেরা ‘জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরাম’ ব্যানারে ঐক্যবদ্ধ ও সক্রিয় রয়েছে। তাই তথাকথিত সাদা দলের বর্তমান কার্যক্রমের সঙ্গে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী শিক্ষক সমাজের কোনও সম্পর্ক নেই।”
তবে শামীম উদ্দিন খান দাবি করছেন, সাদা দলে এখনও বিএনপি ও জামায়াত উভয় দলের শিক্ষকরাই সক্রিয়।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমাদের এখানে (সাদা দলে) অর্ধেক শিক্ষক বিএনপির। ফলে তাদের (জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরাম) অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল করার জন্য তারা ১০-১৫ জন শিক্ষক দল থেকে বের হয়েছিলেন। তারা চলে গেলে সাদা দল শেষ, এটা বলা যাবে না।”
অন্যদিকে জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক এস এম নছরুল কদির সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বর্তমানে সাদা দলে সলিড জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী শিক্ষক নেই। ১০ বছর আগেই আমরা সেই সংগঠন থেকে বেরিয়ে এসেছি। সর্বশেষ সিন্ডিকেট নির্বাচনে আমরা পৃথকভাবে অংশ নিয়েছি।”
সাদা দলের উপাচার্য পদে সুপারিশের প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, “সরকার কিংবা উপদেষ্টাদের পক্ষ থেকে তো এমন সুপারিশ চাওয়া হয়নি। তাহলে তারা কী উদ্দেশ্যে এটা করলেন? আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়। আমরা তো কাউকে সুপারিশ করিনি। সরকার চাইলেই কেবল আমরা উপযুক্ত ফোরামে জানাব।”
সরকারের পক্ষ থেকে এমন কোনও সুপারিশ আসেনি স্বীকার করেই শামীম উদ্দিন বলেন, “সাদা দল মনে করেছে, আমাদের একজন শিক্ষক মনোনয়ন দিয়ে উপাচার্য হিসেবে চেষ্টা করার জন্য। সেটাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
অন্যদিকে নছরুল কদির বলেন, “আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনও এক্সট্রিমিস্ট বা প্রতিক্রিয়াশীল উপাচার্য চাই না; যার দ্বারা বিশ্ববিদ্যালয় সেই আগের অবস্থায় ফিরে যাক। আমরা প্রগতিশীল, মুক্তবুদ্ধির চর্চা করে, এমন শিক্ষককে উপাচার্য চাই, যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশকে শান্ত নিরাপদ রাখবেন।”