বিকাল হলেই বাসার সামনের খোলা জায়গাটিতে খেলতে যেত ৭ বছরের রবিউল ইসলাম। কিন্তু গত তিন দিন ধরে তার খেলতে যাওয়া বন্ধ। ফেইসবুকে একের পর এক শিশু নিখোঁজের বিজ্ঞপ্তি দেখে নিজের সন্তানকে বাসা থেকে বের হতে দিতে ভয় পাচ্ছেন অনিক মৃধা। তবে বাবার সেই উৎকণ্ঠা বোঝার বয়স হয়নি ছোট্ট রবিউলের। তাই খেলতে যেতে না পেরে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে সে।
বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা অনিক মৃধা ঢাকার যাত্রাবাড়ির দয়াগঞ্জ এলাকায় একটি বাসায় ভাড়া থাকেন।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এখন ফেইসবুকে স্ক্রল করলেই বিভিন্ন স্থানে শিশু হারানোর ঘটনা চোখে পড়ছে। তাই ছেলে কান্নাকাটি করলেও তাকে বাসার বাইরে যেতে দিতে পারছি না। এই জন্য সে ঠিকমতো খাওয়া দাওয়াও করছে না।”
ফেইসবুক দেখে অনিকের মতো আরও অনেক অভিভাবকই উদ্বিগ্ন এখন।
তবে পুলিশের দাবি এই উদ্বেগ অমূলক। কোনও শিশু সামান্য সময়ের জন্য চোখের আড়াল হলেই অনেক অভিভাবক ফেইসবুকে নিখোঁজ পোস্ট দিচ্ছেন। সেসব পোস্ট আবার ব্যাপক শেয়ার হচ্ছে। পরবর্তীকালে শিশুটি বাড়ি ফিরে এলেও হারানোর পোস্ট আর সরানো হচ্ছে না। এই সুযোগে একটি চক্র আবার বিষয়টি নিয়ে গুজব ছড়ানোর চেষ্টাও করছে।
নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তিতে সয়লাব ফেইসবুক
‘গত ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ঢাকাসহ চট্টগ্রামে ৪৮ বাচ্চা নিখোঁজ’, ‘গত ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ঢাকাসহ চট্টগ্রামে ৩৫ বাচ্চা নিখোঁজ’, কিংবা ‘একটি হারানো বিজ্ঞপ্তি’- ফেইসবুকে এমন অসংখ্য পোস্ট ঘুরছে।
রবিবার দুপুর ২টার দিকে ‘ভ্যারাইটিজ নিউজ’ নামে একটি ফেইসবুক আইডি থেকে পোস্ট দিয়ে ঢাকার বিমানবন্দর এলাকা থেকে একটি শিশু হারানোর কথা বলা হয়েছে। শিশুটির ছবি দিয়ে ওই পোস্টে বলা হয়েছে, “ছেলেটি’র মা প্রায় পাগল হয়ে গেছে ছেলে কে খুঁজে না পেয়ে আজ দুই দিন ধরে!! ছেলেটি আমার খালাতো ভাই হয়।
“বাসা: বিমান বন্দর আবাসিক এলাকা, পড়াশোনা: হিফজ পড়ে (১৭ পারা মুখস্থ করেছে)। গায়ের রং: উজ্জ্বল, পরনে সাদা যুব্বা ছিলো। আমার ফ্রেন্ড লিস্টে অনেক মানুষ এড আছেন, যদি আপনারা প্রত্যেকজনেই শেয়ার / পোস্ট করেন ইনশাআল্লাহ বাংলাদেশের প্রত্যেক ফেসবুক ব্যবহারকারী কাছে পৌঁছাবে। তাই একটা শেয়ার/পোস্ট দিয়ে আপনার মায়ের মতো একজন সন্তান হারানোর মায়ের স্বস্তির সহায়ক হতে পারে।”
এই হারানো বিজ্ঞপ্তিটি হাজার হাজার শেয়ার হয়েছে। ওই বিজ্ঞপ্তির সূত্র ধরে পোস্টে দেওয়া মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ করে সকাল সন্ধ্যা। শিশুটির খালাতো ভাই পরিচয় দিয়ে আসিফ ইকবাল প্রিন্স নামে একজন ফোন ধরে বলেন, শিশুটি গত শুক্রবারই বাসায় ফিরে এসেছে।
অথচ তার দুদিন পরও নিখোঁজের বিজ্ঞপ্তি পোস্ট করা হচ্ছে ফেইসবুকে।
আসিফ ইকবাল বলেন, গত মঙ্গলবার বিকাল থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না তার খালাত ভাইকে। পরে শুক্রবার সকাল ১০টার দিকে একাই বাড়ি ফিরে আসে সে। সে জানিয়েছে, বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে গিয়েছিল।
শিশুটি হারানোর পর তিন দিনেও পুলিশকে জানানো হয়নি। কারণ হিসাবে আসিফ বলেন, “আমরা ভেবেছিলাম শুক্রবারের মধ্যে তাকে না পাওয়া গেলে পুলিশকে জানাব।”
শনিবার রাত সোয়া ৮টার দিকে পিয়ারপুর নামের একটি পেইজ থেকে একটি শিশু হারানোর পোস্ট দেওয়া হয়। সেখানে বলা হয়, “৬ জুলাই সকাল ৭টা থেকে শিশুটির খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।”
ওই পোস্টেও বিজ্ঞপ্তিটি শেয়ার করে ছেলেটির সন্ধান পেতে সহযোগিতার অনুরোধ জানানো হয়।
ওই বিজ্ঞপ্তিতে দেওয়া মোবাইল নম্বরে সকাল সন্ধ্যা যোগাযোগ করে জানতে পারে, শিশুটি শনিবার সকালেই বাড়িতে ফিরে এসেছে।
মিতুল নামে এক যুবক ফোন ধরে বলেন, শিশুটির খোঁজ না পাওয়ার পর পোস্টটি দেওয়া হয়েছিল, সেটাই এখনও শেয়ার হচ্ছে।
শনিবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে ‘হামার বাড়ি জলঢাকা নামের’ একটি ফেইসবুক পেইজে একসঙ্গে এক পরিবারের তিনটি শিশু হারানোর বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে দেওয়া নম্বরে ফোন দেওয়া হলে নজরুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি বলেন, তার ভাগ্নে ও দুই ভাতিজা শুক্রবার বিকালে মাদ্রাসা থেকে বেরিয়ে আর বাড়ি ফেরেনি। তাদের সবারই বয়স ১২-১৩ বছরের মধ্যে। সম্ভাব্য সব জায়গায় খুঁজেও তাদের পাওয়া যায়নি।
তবে এখনও থানায় কোনও অভিযোগ করা হয়নি বলেও জানান তিনি; কারণ হিসাবে বলেন, ওদের খোঁজে ফেইসবুকে পোস্ট দিয়েছি, তাই পুলিশকে জানানো হয়নি।
আরেকটি শিশু হারানোর বিজ্ঞপ্তি শেয়ার করা হয়েছে মামুন হোসেন নিলয় নামের একটি ফেইসবুক আইডি থেকে। এই পোস্টটি শেয়ার হয়েছে ৫৩ হাজারেরও বেশি।
ওই বিজ্ঞপ্তিতে দেওয়া মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ করা হলে শিশুটির বাবা জানান, তার ছেলেকে গত ২ জুলাই থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। পরদিনই তিনি চট্টগ্রাম ইপিজেড থানায় জিডি করেন। কিন্তু পুলিশ এখনও সন্ধান বের করতে পারেনি।
“এছাড়া আমি নিজেও ছেলের সন্ধান চেয়ে ফেইসবুকে পোস্ট দিয়েছিলাম। সেই পোস্টটি হাজার হাজার মানুষ শেয়ার করলেও আমার ছেলের কোনও সন্ধান এখনও পাইনি।”
শিশুটির বাবার করা জিডির তদন্ত কর্মকর্তা চট্টগ্রাম ইপিজেড থানার এসআই কামাল হোসেন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, তারা তদন্ত শুরু করেছেন। তাদের ধারণা, শিশুটি রাগ করে বাসা ছেড়ে গেছে।
“আমরা জানতে পেরেছি, শিশুটি বাসার রান্নাঘর ময়লা করায় তার বাবা তাকে বকা দেন। পরে শিশুটি ময়লার ব্যাগ নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যায়। বাসার সামনের একটি দোকানের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে শিশুটি ময়লার ব্যাগ ডাস্টবিনে ফেলে হাঁটতে হাঁটতে সামনের দিকে চলে যাচ্ছে।”
এই প্রসঙ্গ ধরে এসআই কামাল বলেন, গত বৃহস্পতিবার থানার অদূরে ৪ ও ৫ বছর দুই শিশুকে দেখে এক যুবক পুলিশকে খবর দিেয়ছিেলন। শিশু দুটি নিজেদের বাসা থেকে বের হয়ে হাঁটতে হাঁটতে ৩ কিলোমিটার দূরে চলে আসে। এরপর আর বাসায় ফিরতে পারছিল না।
অভিভাবকরা আতঙ্কে
ফেইসবুকে শিশু নিখোঁজের শত শত বিজ্ঞপ্তি দেখে অনিক মৃধার মতো অনেক অভিভাবকই আতঙ্কিত সময় পার করছেন। তাদেরই একজন ঢাকার মোহাম্মদপুরের বছিলার বাসিন্দা মো, ইউসুফ। রবিবার নিজের সন্তানকে স্কুলেও পাঠাননি তিনি।
ইউসুফ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমার বাড়ি নওগাঁয়। সেখানকার একটি স্কুলের শিক্ষক আমার বড় বোন। তিনি ফেইসবুকে শিশু হারানোর পোস্ট দেখে খুবই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। নিজের সন্তানকে ঘরের বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। শুধু তাই নয় আমাকেও ফোন করে সাবধান করলেন আমি যে আমার ছেলের খোঁজ রাখি।
“বোনের কথা শুনে ফেইসবুকে স্ক্রল করে আমিও বিষয়টি দেখলাম। সেজন্য ছেলেকে আর বাইরে পাঠানোর সাহস পাচ্ছি না।”
কদর উদ্দিন শিশির নামে একজন ফেইসবুকে লিখেছেন, “বাচ্চারা হারিয়ে যাচ্ছে- এই ধরনের একটি আতঙ্ক ফেইসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে।
“আমি নিজে কয়েকটি হারানো বাচ্চার ভাইরাল হওয়া পোস্ট থেকে নম্বর নিয়ে যাচাই করেছি। ফোন যারা ধরেছেন, তাদের কেউ জানিয়েছেন তাদের বাচ্চা হারিয়েছিল তবে এখন পেয়ে গেছেন। আবার কয়েকজন বলেছেন এখনও পাননি। অর্থাৎ, ফেইসবুকে যাদের হারিয়ে যাওয়ার খবর ছড়াচ্ছে, সেই খবরগুলো অসত্য নয়।”
“এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই হারানোর ঘটনাগুলো দৈনন্দিন আমাদের চারপাশে বাচ্চা হারানোর যেসব ঘটনা ঘটে, তেমন বিচ্ছিন্ন ঘটনা, না কি অস্বাভাবিক বা পরিকল্পিত কিছু?” জানতে চান শিশির।
গুজব ছড়াচ্ছে, দাবি পুলিশের
শিশু হারানোর বিষয়গুলোকে ‘গুজব’ বলছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন্স) খ মহিদ উদ্দিন খান।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমরা বিষয়গুলো অ্যানালাইসিসি করে দেখেছি যে এটা ‘অ্যাবসুলেটলি গুজব’। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের পক্ষ থেকে আমরা নগরবাসীকে আশ্বস্ত করছি যে এই বিষয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। যারা গুজব ছড়াচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
কিছু শিশুর হারিয়ে যাওয়ার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে জানানো হলে মহিদ উদ্দিন বলেন, “গত তিন দিনে আমার ডিএমপির আওতাধীন থানাগুলোতে ৩২টি নিখোঁজ ডায়েরি পেয়েছি, যা অন্যান্য স্বাভাবিক সময়ের মতোই।
“এই ধরনের ঘটনায় ৭ দিনের মধ্যে ৮০ শতাংশের খোঁজ পাওয়া যায়। এসব ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বেশিরভাগ শিশু রাগ করে বাড়ি ছাড়ে, কিছু শিশু থাকে অপ্রকৃতিস্থ, যারা বাসা থেকে বের হয়ে আর ফিরতে পারে না।”
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের (সিএমপি) কমিশনার মো. সাইফুল ইসলামও বলেন, “আমি সকাল থেকেই বিষয়টি নিয়ে কাজ শুরু করেছি। সব থানায় করা নিখোঁজ ডায়েরিগুলোও যাচাই করে দেখা হয়েছে। আমরা মাত্র এমন ২টি নিখোঁজের জিডি পেয়েছি, তারাও ঘরে ফিরে এসেছে।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা এখন খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি, কারা এই গুজবগুলো ছড়াচ্ছে? তাদের উদ্দেশ্য কী? যেসব আইডি বা পেইজ থেকে এসব হত্যা শেয়ার হচ্ছে, সেগুলোর ব্যবহারকারীদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনতে কাজ করছি আমরা।”
শিশুরা কোনও কারণে মনঃক্ষুণ্ন না হয়ে বাড়ি ছাড়ার কথা ভাববে- এমন কিছু না করতে অভিভাবকদের পরামর্শ দিয়েছেন চট্টগ্রাম ইপিজেড থানার এসআই কামাল হোসেন।
তিনি বলেন, “শিশুদের শাসন করার ক্ষেত্রে অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। এছাড়া সবসময় তাদের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে।”
কোনও শিশুর খোঁজ না পেলে পুলিশে জানানোর অনুরোধ রেখে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মহিদ উদ্দিন।
তিনি বলেন, “সাধারণ মানুষের প্রতি আমাদের অনুরোধ, কেউ নিখোঁজ হলে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে জানান। আর নিশ্চিত না হয়ে কোনও তথ্য ফেইসবুকে শেয়ার করা ঠিক নয়।”