একুশের শহীদদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভ ‘শহীদ মিনার’ বাঙালির জীবনে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে। একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবসে মানুষ প্রভাতফেরির শ্রদ্ধাঞ্জলি নিয়ে শহীদ মিনারে সমবেত হয়। তেমনি আজও বাংলাদেশের মানুষ প্রতিবাদে-আন্দোলনে জড়ো হয় এই শহীদ মিনার চত্বরে। শহীদ মিনার কেবল স্মৃতিস্তম্ভ হয়েই থাকেনি হয়ে উঠেছে এক অবিনাশী চেতনার প্রতীক।
বাংলাদেশের প্রায় সব শহর-গ্রামে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গড়ে উঠেছে অগুনতি স্থায়ী শহীদ মিনার। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে এখন পৃথিবীর নানা প্রান্তে নানা দেশে বসবাসরত বাঙালিরা গড়ে তুলেছেন আরও অনেক শহীদ মিনার। ২১শে ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে বিশ্বব্যাপী উদযাপিত হওয়ায় দেশে দেশে এসব শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদনে সামিল হচ্ছেন নানা ভাষার নানা জাতির মানুষেরাও।
ভাস্কর নভেরা আহমেদ ও চিত্রকর হামিদুর রহমানের নকশায় ঢাকায় নির্মিত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সহজ-সরল অবয়বটি এখন সারা দুনিয়ার মানুষের চেনা। সারা বাংলাদেশে যে অগুনতি স্থায়ী শহীদ মিনার গড়ে উঠেছে সেসবের মূল প্রেরণা তাদের নকশা করা মিনারটিই। বলা যায় দেশের বেশিরভাগ শহীদ মিনারই ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের কাছাকাছি অনুকৃতি। বাংলাদেশের বাইরে গড়ে ওঠা শহীদ মিনারগুলোর ক্ষেত্রেও এই কথা প্রায় সমভাবেই প্রযোজ্য।
আমাদের শহীদ মিনারের সহজিয়া রূপটি অনুপমভাবে ফুটে ওঠে শিশুদের বানানো শহীদ মিনারে। একুশের প্রভাতফেরির সংস্কৃতি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ার মধ্য দিয়ে গ্রামে গ্রামে পাড়ায় মহল্লায় শিশু-কিশোরদের নিজ হাতে শহীদ মিনার গড়ার সংস্কৃতিও দেশব্যপী ছড়িয়ে গেছে। অনেকটা অলক্ষ্যেই শিশুদের শহীদ মিনার বানানোর এই শিল্পচর্চা এখনও বহমান আছে।
কি শহর কি অজপাড়াগাঁয়ে, বাড়ির আঙিনায়, মাঠে-প্রান্তরে এসব শহীদ মিনার বানায় শিশুরা। মাটি, ইট, কাগজ, কাপড়, বাঁশ, কাঠসহ নানা উপকরণ দিয়ে বানানো অস্থায়ী এসব শহীদ মিনারের আয়ু বড়জোর চার-পাঁচ দিন। ক্ষণস্থায়ী হলেও হাতের কাছে পাওয়া সহজলভ্য সব উপকরণ দিয়ে নিজ হাতে শহীদ মিনার বানানোর এই সংস্কৃতি আমাদের শিশুদের মনন তৈরি ও সৃজনশীলতার বিকাশে ভূমিকা রাখছে।
শিশুদের শহীদ মিনার বানানোর গুরুত্বপূর্ণ এই সংস্কৃতি চর্চার প্রতি বিশেষ নজর দিয়েছেন শিল্পী ও আলোকচিত্রী খুরশিদ আলম আলোক। ২০০৫ সাল থেকে প্রায় প্রতিবছরই দেশের নানা স্থানে গিয়ে তিনি শিশুদের বানানো শহীদ মিনারের আলোকচিত্র তুলে রাখছেন। শিশুদের শহীদ মিনারের ছবি নিয়ে ২০২০ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালায় অনুষ্ঠিত হয়েছে আলোকচিত্রী খুরশিদ আলম আলোকের একটি একক আলোকচিত্র প্রদর্শনী।
আবেগ-ভালোবাসায় নিজ হাতে গড়া শিশুদের একেকটি শহীদ মিনার বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতির সতত বহমান অনুপ্রেরণারই নব নব রূপায়ণ। বাঙালির আপন সৌধ শহীদ মিনারের এই অনুপম রূপের ছবি সকাল সন্ধ্যার ‘আয়না’য় পাঠক-দর্শকদের জন্য তুলে ধরা হলো খুরশিদ আলম আলোকের ক্যামেরায়। (বি.স.)