তাইওয়ানের নতুন প্রেসিডেন্ট লাই চিং-তে শপথ গ্রহণের তিন দিনের মধ্যেই অঞ্চলটিকে ঘিরে চীন বিশাল সামরিক মহড়া শুরু করেছে। দুদিনের এই সামরিক মহড়ায় অংশ নিয়েছে চীনের সেনা, নৌ, বিমান ও রকেট বাহিনীগুলো।
আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলো একে তাইওয়ানকে ঘিরে হওয়া চীনের সবচেয়ে বড় সামরিক মহড়া হিসেবে দেখছে। আর চীন এই মহড়াকে ‘স্বাধীনতার নামে তাইওয়ানের বিচ্ছিন্নতাবাদী কর্মকাণ্ডের’ বিপরীতে ‘শাস্তি’ হিসেবে দেখছে।
তাইওয়ানের নতুন প্রেসিডেন্ট গত ২০ মে আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এরপর উদ্বোধনী ভাষণে তিনি চীনের প্রতি তাইওয়ানকে ‘ভয় দেখানো’ বন্ধের আহ্বান জানান। প্রতিক্রিয়ায় বেইজিং লাইয়ের ওই উদ্বোধনী ভাষণের নিন্দা জানায়।
ওই আহ্বানের তিন দিন পার হতে না হতেই গত বৃহস্পতিবার সকাল থেকে চীন দেশটিকে ঘিরে এই সামরিক মহড়া শুরু করেছে। ক্ষমতাসীন ডেমোক্রেটিক প্রগ্রেসিভ পার্টির নেতা লাই চিং-তেকে চীন ‘বিপজ্জনক বিচ্ছিন্নতাবাদী’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।
লাইয়ের প্রেসিডেন্ট হওয়ার মধ্য দিয়ে তাইওয়ানে প্রথমবারের মতো ডেমোক্রেটিক প্রগ্রেসিভ পার্টি (ডিপিপি) টানা তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসলো। ১৯৯৬ সালে সরাসরি প্রেসিডেন্ট নির্বাচন শুরুর পর থেকে দেশটিতে ডেমোক্রেটিক প্রগ্রেসিভ পার্টি ও চীনের প্রতি নমনীয় কুওমিনতাং পার্টি দুই মেয়াদ করে ক্ষমতায় থাকতো। কিন্তু এবারই প্রথম কট্টর চীন বিরোধীরা টানা তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসলো। এ কারণেই চীন এবার একটু বেশিই চটেছে।
জানুয়ারিতে তাইওয়ানের নির্বাচনের আগেও বেইজিং সতর্ক করেছিল। বলেছিল, লাই চেং-তে বিজয়ী হলে উত্তেজনা বাড়তে ও সংঘর্ষ হতে পারে। চীন বারবার তাইওয়ানের এবারের নির্বাচনকে শান্তি বা যুদ্ধের মধ্যে যে কোনও একটিকে বেছে নেওয়ার নির্বাচন হিসেবে অভিহিত করছিল।
তবে তাইওয়ানের ভোটাররা সেই সতর্কতা প্রত্যাখ্যান করে ডিপিপিকে ফের ক্ষমতায় এনেছে। যদিও চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের পক্ষে থাকা দুটি বিরোধী দলই এখন দেশটির পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠ।
চীনের সরকার ও রাষ্ট্রীয় মিডিয়া নিয়মিতভাবে লাইকে তিরস্কার করে। তাকে একজন বিপজ্জনক বিচ্ছিন্নতাবাদী, সমস্যা সৃষ্টিকারী এবং যুদ্ধের মদদদাতা হিসেবে অভিহিত করে। একই সঙ্গে তার বারবার আলোচনার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে চীন।
তার রাজনৈতিক অতীতের জন্যই লাইকে চীনের এতোটা অপছন্দ। ৬৪ বছর বয়সী এই প্রাক্তন ডাক্তার এবং প্রবীণ রাজনীতিবিদ একসময় তাইওয়ানের স্বাধীনতার প্রকাশ্য সমর্থক ছিলেন।
তার সেই রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এখন আরও দৃঢ় হয়েছে। লাই এখন বলছেন যে, তিনি বর্তমান স্থিতাবস্থার পক্ষে। তার মতে, তাইওয়ান এরই মধ্যে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হওয়ায় আনুষ্ঠানিকভাবে আর স্বাধীনতা ঘোষণা করারও কোনও পরিকল্পনা বা প্রয়োজন নেই।
তবে বেইজিং তাকে তার অতীত রাজনৈতিক অবস্থানের জন্য কখনও ক্ষমা করেনি। বৃহস্পতিবার সামরিক মহড়া শুরু করে তারা সেটাই স্পষ্ট করেছে।
লাইও তার উদ্বোধনী বক্তৃতায় চীনকে মোকাবেলায় তার কৌশল কী হবে সেই ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি ঘোষণা করেছেন, “তাইওয়ানের গণতন্ত্রের একটি গৌরবময় যুগ এসেছে”। সেসময় তিনি দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার দৃঢ় সংকল্পও পুনর্ব্যক্ত করেন।
অন্যদিকে চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টি বলছে, তাইওয়ান তাদের ভূখণ্ডের অংশ, যদিও তারা দ্বীপটিকে কখনও নিয়ন্ত্রণ করেনি। তবে প্রয়োজনে বলপ্রয়োগ করে দ্বীপটি দখল করার কথা একাধিকবার বলেছে চীনের কর্তাব্যক্তিরা।
১৯৪৯ সালে চীনে কমিউনিস্ট বিপ্লবের পর দেশটির পুঁজিতান্ত্রিক ও গণতন্ত্রপন্থীরা মূল ভূখণ্ড থেকে পালিয়ে তাইওয়ান দ্বীপে গিয়ে আলাদা সরকার গঠন করে। তারা এর নাম দেয় রিপাবলিক অব চায়না বা প্রজাতন্ত্রী চীন।
দ্বীপটির নিজস্ব সংবিধান, গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত নেতা এবং এর সশস্ত্র বাহিনীতে প্রায় ৩ লাখ সক্রিয় সৈন্য রয়েছে। কিন্তু চীনের কমিউনিস্ট সরকার তাইওয়ানকে তাদের দেশের অংশ মনে করে।
বিশ্বের হাতে গোনা কয়েকটি দেশ তাইওয়ানকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তবে তাইওয়ানের সবচেয়ে বড় মিত্র যুক্তরাষ্ট্র এখনো অঞ্চলটিকে স্বীকৃতি দেয়নি এবং উভয়ের মধ্যে কোনও আনুষ্ঠানিক সম্পর্কও নেই। অবশ্য তাইওয়ানকে আত্মরক্ষায় সহায়তার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের একটি আইন রয়েছে। ওই আইনের অধীনেই যুক্তরাষ্ট্র দেশটিকে সামরিক সহায়তা দেয়।
তাইওয়ানের ওপর পূর্ণ মাত্রার সামরিক হামলার প্রথম মহড়া
চীনের রাষ্ট্রীয় টিভি চ্যানেল সিসিটিভিতে বলা হয়েছে, গোলাবারুদ বহনকারী কয়েক ডজন যুদ্ধ বিমান, যুদ্ধ জাহাজ, ফ্রিগেট ও মিসাইল স্পিডবোট নিয়ে চীনা সেনারা শত্রুর সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলার প্রস্তুতিমূলক মহড়া চালাচ্ছে।
সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই মহড়া তাইওয়ানের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট লাই চিং-তের জন্য প্রথম বাস্তব পরীক্ষা। কারণ এই প্রথম চীন তাইওয়ানের ওপর পূর্ণ মাত্রার সামরিক হামলার অনুশীলনমূলক মহড়া চালাচ্ছে।
চীনের নৌবাহিনীর মুখপাত্র কর্নেল লি শি এই মহড়াকে “তাইওয়ানের স্বাধীনতা বাহিনীগুলোর বিচ্ছিন্নতাবাদী কাজের জন্য একটি কঠোর শাস্তি এবং বহিরাগত শক্তির হস্তক্ষেপ ও উস্কানির বিরুদ্ধে একটি গুরুতর সতর্কতা” বলে অভিহিত করেছেন।
তাইওয়ানের এক জ্যেষ্ঠ নিরাপত্তা কর্মকর্তা সিএনএনকে বলেছেন, বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত প্রায় ৩০টি চীনা বিমান তাইওয়ানের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে।
তিনি জানান, চীনা সামরিক বাহিনী তাইওয়ানের আশেপাশে প্রায় এক ডজন চীনা যুদ্ধজাহাজ এবং সেইসঙ্গে তাইওয়ানের বিচ্ছিন্ন দ্বীপগুলোর পাশে এক ডজন কোস্টগার্ড জাহাজ মোতায়েন করেছে। তবে চীন কোনও বিমানবাহী রণতরী মহড়ায় আনেনি।
পরিস্থিতি নিরীক্ষণের জন্য তাইওয়ানও তাদের নিজস্ব যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করেছে বলে জানান তাইওয়ানের ওই কর্মকর্তা।
তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এই মহড়াকে ‘অযৌক্তিক উস্কানি’ বলে অভিহিত করেছে। আর দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চীনকে ‘যৌক্তিক’ আচরণ করতে বলেছে।
বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে, তারা মহড়ার জবাবে সমুদ্র, বিমান ও স্থল বাহিনী পাঠিয়েছে।
এতে বলা হয়, “আমরা দৃঢ় ইচ্ছা ও সংযম নিয়ে তাইওয়ানের জনগণের পাশে আছি। আমরা কোনও সংঘর্ষ চাই না, তবে আমরা ভীত নই। জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষা করার আত্মবিশ্বাস আমাদের রয়েছে।”
তাইওয়ানের বিরোধী দল কুওমিনতাং পার্টি (কেএমটি) চীনকে ‘সংযম’ দেখানোর আহ্বান জানিয়েছে। এটি একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা, কারণ কেএমটি তাইওয়ানের চীনপন্থী দল হিসেবে পরিচিত।
দলটি বৃহস্পতিবার বেইজিংয়ের কাছে ‘অপ্রয়োজনীয় ব্যবস্থা’ বন্ধ করতে এবং তাইওয়ান প্রণালী জুড়ে সংঘর্ষ এড়ানোর আহ্বান জানায়। তাইওয়ানের নতুন সরকারের প্রতিও দেশের জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিতের আহ্বান জানিয়েছে দলটি।
তাইওয়ানের প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র কারেন কুও এক বিবৃতিতে বলেছেন, “চীন একতরফা সামরিক উস্কানির মাধ্যমে তাইওয়ানের গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা এবং আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলছে, যা দুঃখজনক।”
কুও বলেন, “বাহ্যিক চ্যালেঞ্জ ও হুমকির মুখে আমরা আমাদের গণতন্ত্র রক্ষা করতে থাকব। আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষা করার আত্মবিশ্বাস ও সক্ষমতা আমরাও রাখি।”
চীনের এমন সামরিক মহড়ায় অভ্যস্ত তাইওয়ানের ২ কোটি ৩০ লাখ মানুষ। ফরে বৃহস্পতিবার যখন মহড়া শুরু হয় তখন তাইপে থেকে শুরু করে গোটা দ্বীপের জীবনযাত্রা স্বাভাবিকই ছিল।
তাইওয়ানের আকাশসীমায় চীন গত কয়েক বছর ধরে অসংখ্যবার যুদ্ধ বিমান উড়িয়েছে এবং যুদ্ধ জাহাজগুলোকে নিয়মিতভাবে দ্বীপটির জলসীমায় পাঠিয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, তাইওয়ানের মিত্রদের সতর্ক করাও চীনের এই সামরিক মহড়ার একটি উদ্দেশ্য। তাইওয়ানের জাতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অফিসিয়াল থিঙ্ক ট্যাঙ্ক, জাতীয় প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা গবেষণা ইনস্টিটিউটের উইলিয়াম চুংও তেমনটাই জানান।
তিনি বলেন, “ফিলিপাইনে যুক্তরাষ্ট্রের সদ্য স্থাপিত সামরিক ঘাঁটিগুলোর কাছাকাছি তাইওয়ানের দক্ষিণ-পূর্ব জলসীমায়ও এবার চীন মহড়া চালাচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে চীন স্পষ্টভাবেই দেশ দুটিকে সতর্ক করছে।
“এমনকি তাইওয়ানকে আরও বেশি ভয় দেখাতে চীন অঞ্চলটির বিচ্ছিন্ন দ্বীপগুলোতেও ছোট আকারের সামরিক হামলা চালাতে পারে।”
তিনি বলেন, “এটা স্পষ্ট যে,তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম লাই চেং-তেকে চীন শান্তিতে থাকতে দেবে না। অন্যদিকে, তাইওয়ানেও আইনসভায় পরিবর্তন নিয়ে নতুন সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে।”
তথসূত্র: বিবিসি, রয়টার্স, সিএনএন