সারা বিশ্বে আবহাওয়ার কোনও ঠিক-ঠিকানা নেই। গ্রীষ্মের সময় একটার পর একটা তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। আবার বৃষ্টি নামলে থামার নাম নেই। এমনকি মরুভূমির মতো জায়গায় তুমুল বৃষ্টিতে সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। শীত কালে তীব্র হচ্ছে হাড় কাঁপানো ঠান্ডা। বাড়ছে ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের তাণ্ডব।
বিশ্ব জলবায়ুর এই পরিবর্তনের জন্য মোটাদাগে দায়ী করা হয় কার্বন নিঃসরণকে। যে দেশটি সবচেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণ করে পৃথিবীকে ক্রমাগত উষ্ণ করে তুলছে, সেটি হলো চীন।
কয়েক দশক ধরে দেদারছে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করে পৃথিবীকে যেন বসবাসের অযোগ্য করে তোলায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে দেশটি।
অথচ একই সঙ্গে তারা নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকেও ঝুঁকছে। চীনের এই দ্বৈত নীতি এক কথায় বিস্ময়-জাগানিয়া।
যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা অন্যান্য দেশের মতো চীন বছরের পর বছর ধরে কার্বন নিঃসরণ কমানোর মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাচ্ছে না। বরং নীরবে-নিভৃতে নিজেদের নিয়ে যাচ্ছে গ্রিন এনার্জির দিকে। এবং তা বেশ দ্রুতগতিতে।
সিএনএন বলছে, চীনের উত্তর-পশ্চিমে কুবুকি মরুভূমিতে গেলে চোখে পড়বে সারিবদ্ধভাবে রাখা প্রায় দুই লাখ সোলার প্যানেল।
দেশটি যে গতিতে বায়ু ও সূর্যের আলো ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকে এগুচ্ছে, তা অন্য কোনও দেশ পারছে না। বলা ভালো, করছে না।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আগামী জানুয়ারিতে ক্ষমতা গ্রহণের পর দেশটিকে বৈশ্বিক জলবায়ুর নেতৃত্বের জায়গা থেকে সরিয়ে নিতে পারেন। সেক্ষেত্রে চীনকেই নেতৃত্বের আসনে বসতে হবে।
সৌর ও বায়ুশক্তির ওপর জোর
সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বব্যাপী কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে ফেলার ক্ষমতা এ মুহূর্তে চীন ছাড়া আর কোনও দেশের নেই।
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে বিশ্বব্যাপী কার্বন নিঃসরণে খুব সামান্যই অবদান ছিল চীনের। তবে দ্রুত বিশ্বের কারখানা ও সাম্প্রতিক সময়ে শক্তিশালী প্রযুক্তি উদ্ভাবক দেশে পরিণত হওয়ায় দেশটি কার্বন নির্গমনের হার বাড়িয়ে দেয়।
চীন এ মুহূর্তে বিশ্বের সর্ববৃহৎ কার্বন নিঃসরণকারী দেশ। মোট কার্বন নিঃসরণের প্রায় এক তৃতীয়াংশ তাদের হাত দিয়েই হচ্ছে।
বিশ্বে যে হারে কার্বন নিঃসরণ হচ্ছে, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন বিশেষজ্ঞরা। তবে আশার বিষয় হচ্ছে, চীনে এই নিঃসরণ ধীরে ধীরে কমছে।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞদের একাংশ ও যুক্তরাষ্ট্রের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের ধারণা, চীনের নিঃসরণ দ্রুতই শিখরে পৌঁছে যাবে এবং তারপর তা কমতে শুরু করবে।
তবে চীন যে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার থেকে একদম সরে আসছে, তা নয়। বরং আগের চেয়ে তারা এই জ্বালানি বেশি ব্যবহার করছে। একই সঙ্গে দেশটি সৌর ও বায়ু শক্তিকে বিস্ময়কর গতিতে বিদ্যুৎ খাতে ব্যবহার করছে।
চীনের এই উদ্যোগ সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক জলবায়ু কূটনীতিক জোনাথন পারশিং বলেন, “এটি অসাধারণ। এটাই আমরা গোটা বিশ্বে চাই।”
নবায়নযোগ্য ও অনবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে কাজ করা সান ফ্রান্সিসকোভিত্তিক সংস্থা গ্লোবাল এনার্জি মনিটর বলছে, সৌর ও বায়ু শক্তিকে কাজে লাগিয়ে চীন এরই মধ্যে ৭৫৮ গিগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করেছে।
এর বাইরে দেশটি বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ সৌর ও বায়ুভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের মধ্যে আছে, যার মাধ্যমে প্রায় ৩৩৯ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন হবে। এই পরিমাণ বিদ্যুৎ দিয়ে ২৫ কোটির বেশি বসতবাড়িতে বিদ্যুৎ সরবরাহ দেওয়া সম্ভব, যা গোটা যুক্তরাষ্ট্রের মোট বাড়িঘরের প্রায় দ্বিগুণ।
যুক্তরাষ্ট্রের বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে পারে চীন
প্যারিসভিত্তিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সির তথ্যমতে, চীন যে গতিতে সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করছে, তাতে ২০৩০ সালের মধ্যে দেশটি সূর্য থেকে এত বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে যে, পুরো যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের চাহিদা পূরণ করেও উদ্বৃত্ত থাকবে।
এর পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে সোলার প্যানেল রপ্তানি করছে চীন। এক্ষেত্রেও তারা শীর্ষে। তাদের তৈরি সোলার প্যানেলের বেশিরভাগই যায় ইউরোপে। আফ্রিকা মহাদেশে তাদের সোলার প্যানেলের চাহিদা দিনদিন বাড়ছে।
হোয়াইট হাউসের আন্তর্জাতিক জলবায়ু নীতির জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা জন পোডেস্টা বলেন, অধিকাংশ পশ্চিমা দেশ যেখানে কার্বন নিঃসরণের উচ্চাকাঙ্ক্ষী লক্ষ্যই কেবল নির্ধারণ করছে, বাস্তবে কিছুই পূরণ করছে না, সে জায়গায় চীন সেরকম কোনও লক্ষ্যের ধার ধারছে না। বরং কার্বন নিঃসরণ কমাতে পশ্চিমাদের চেয়ে বেশি কাজ করছে তারা।
তিনি বলেন, “বছরে ১০০ গিগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন নবায়নযোগ্য জ্বালানিনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা ছিল চীন সরকারের। কিন্তু তারা এখন বছরে ৩০০ গিগাওয়াটের কাছাকাছি নবায়নযোগ্য জ্বালানিনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে।
“চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং একসময় ২০৩০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানি দিয়ে ১২০০ গিগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অঙ্গীকার করেছিলেন। নির্ধারিত সময়ের ছয় বছর আগেই তিনি এই লক্ষ্য পূরণ করে ফেলেছেন।”
গ্লোবাল এনার্জি মনিটরের তথ্য বলছে, চীনের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৩৭ শতাংশ এখন বায়ু ও সৌর শক্তি থেকে আসছে।
এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে, নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে গুরুত্ব দেওয়ার মধ্য দিয়ে চীন কি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সরে আসবে?
এ বিষয়ে হোয়াইট হাউসের আন্তর্জাতিক জলবায়ু নীতির জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা জন পোডেস্টা বলেন, “পুরনো কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দিচ্ছে চীন। বাকিগুলো কম ব্যবহার করছে। তবে তারা নতুন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ বন্ধ করছে না।
“আমি মনে করি, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বন্ধ করার প্রক্রিয়া শুরু করতে পরের দশকে চীনকে আরও বেশি উদ্যোগ নিতে হবে। তাদের তা করার ক্ষমতাও আছে।”