কখনও সেনা সরকার আবার কখনও জাতিগত বিদ্রোহীদের সমর্থন দিয়ে মিয়ানমারকে নিয়ে ‘ভয়ানক এক খেলায়’ মেতেছে চীন। এতে পরাশক্তি হিসেবে দায়িত্বশীল আচরণ না করে বেইজিং এই অঞ্চলে এবং এর বাইরেও লাখ লাখ মানুষের জীবন ঝুঁকিতে ফেলছে। এমনটাই অভিযোগ করা হয়েছে প্রভাবশালী ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানের সাময়িকী অবজারভারের এক সম্পাদকীয়তে।
মিয়ানমারে সাম্প্রতিক সংঘাতের মধ্যে রোববার গার্ডিয়ানের সাপ্তাহিক প্রকাশনায় এই সম্পাদকীয় প্রতাশিত হয়। এই সংঘাতের আঁচ বাংলাদেশেও লাগছে, উড়ে আসছে গোলা-বুলেট, তাতে দুজন প্রাণও হারিয়েছে।
অবজার্ভারের সম্পাদকীয়তে বলা হয়, সামরিক অভ্যুত্থান ও স্বৈরাচার সাধারণত খুব কমই কোনও দেশের উপকারে আসে। তবে, ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সেনা অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমারে যে বিপর্যয় নেমে এসেছে তার নজির মেলা ভার। এতে অবশ্য দেশটির সেনাবাহিনীও ১৯৬২ সালে ক্ষমতা দখলের পর এই প্রথম সবচেয়ে তীব্র প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়েছে।
গত বছরের অক্টোবরের শেষদিক থেকে জাতিগত সশস্ত্র বিদ্রোহীদের জোট থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স ও বেসামরিক নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্য সরকারের (এনডিএ) সামরিক বাহিনী পিপলস ডিফেন্স ফোর্স (পিডিএফ) মিয়ানমারজুড়ে সেনা সরকারের বিরুদ্ধে একযোগে হামলা শুরু করে। এতে সরকারি বাহিনীর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সেনা আত্মসমর্পণ করে কিংবা যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়।
এসব ধাক্কা সেনাবাহিনীর আত্মবিশ্বাসকে নাড়িয়ে দিয়েছে। সেনা সরকারের মনোবল উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে বলেও জানা যাচ্ছে। জান্তার সমর্থকদের মধ্যেও অনেকে প্রকাশ্যে তাদের সমালোচনা করছে।
তবে জেনারেলরা তাতে হাল ছাড়ছেন না। পশ্চিমাদের নতুন নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেই জান্তা সরকার গত সপ্তাহে দেশটিতে জরুরি অবস্থার মেয়াদ আরও ছয় মাস বাড়ায়। জান্তা বেসামরিক নাগরিকদের উপর নির্বিচারে বিমান এবং গোলা হামলাও বাড়িয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। এতে তাদের যুদ্ধাপরাধের তালিকাটি আরও বড় হচ্ছে।
জাতিসংঘের হিসাবে, বর্তমানে মিয়ানমারের দুই-তৃতীয়াংশজুড়ে যুদ্ধ চলছে। এতে প্রায় ২৬ লাখ মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। নিহত হয়েছে প্রায় সাড়ে চার হাজার মানুষ। বন্দি প্রায় ২০ হাজার। এ ছাড়া দেশটির জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ, প্রায় ১ কোটি ৮৬ লাখ মানুষের এখন মানবিক সহায়তার প্রয়োজন, ২০২০ সালের চেয়ে যা ১৯ গুণ বেশি। এর সঙ্গে রয়েছে আরও প্রায় ৭ লাখ ৫০ হাজার রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু, যারা ২০১৭ সালে সেনাবাহিনীর গণহত্যা, ধর্ষণ ও গ্রামে আগুনের মুখে নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিল।
মিয়ানমারের এই সীমাহীন যন্ত্রণার জন্য জাতিসংঘ সনদগুলো এবং মৌলিক মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ব্যাপক ব্যর্থতাও দেখছে গার্ডিয়ান।
“প্রয়োজন মতো মিয়ানমারের জনগণের পাশে না দাঁড়ানোয় যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও অন্যান্য পশ্চিমা গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর সমালোচনা করা যেতেই পারে। তবে তাদের হস্তক্ষেপের সুযোগ খুবই সীমিত। অ্যাসোসিয়েশন অব সাউথইস্ট এশিয়ান নেশনস বা দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট আসিয়ানও এক্ষেত্রে কার্যকর কোনও পদক্ষেপ নিতে পারেনি। এতে তাদের বিশেষ আগ্রহ আছে বলেও মনে হচ্ছে না। জোটটির কিছু দেশ এমনকি উল্টো মিয়ানমারের জান্তা সরকারকেই সহযোগিতা করছে। তাদের এই অক্ষমতা বা অনীহা আরও লজ্জাজনক।”
চীনের ভূমিকা নিয়ে এই সম্পাদকীয়তে বলা হয়, “সবচেয়ে হতাশাজনক হলো চীনের স্বার্থপর অবস্থান। অবশ্য মিয়ানমার বিষয়ে চীন যে আইন ও ন্যায়বিচারের চেয়ে জাতীয় স্বার্থকে প্রাধ্যান্য দিচ্ছে, তা খুব একটা আশ্চর্যজনক কিছু নয়। বেইজিং দীর্ঘদিন ধরেই মিয়ানমারে দ্বৈত খেলা খেলছে। কখনও জান্তা সরকারকে সমর্থন দিচ্ছে, কখনও জাতিগত বিদ্রোহীদের পাশে দাঁড়াচ্ছে।
“মিয়ানমারে বর্তমানে চীনের প্রধান লক্ষ্যগুলো হলো- তার বিশাল বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) প্রকল্পের বিনিয়োগগুলো বাঁচানো, আন্তঃসীমান্ত অপরাধ দমন এবং চীনে মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধের কোনো প্রভাব পড়তে না দেওয়া “
গার্ডিয়ান লিখেছে, “চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের জন্য এই পদ্ধতিটি স্বাভাবিক। তিনি প্রায়ই অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার জন্য পশ্চিমাদের বলেন। কিন্তু নিজেই তা মানেন না। চীন ও তার ঘনিষ্ঠ মিত্র রাশিয়া একেচেটিয়াভাবে মিয়ানমারে প্রভাব বিস্তার করেছে এবং স্বার্থপর বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে দেশটিতে নিয়মিতভাবেই হস্তক্ষেপ করে।
“তারা দেশটির সবচেয়ে বড় অস্ত্রের জোগানদাতাও। চীনের এই ভণ্ডামি শীর্ষ আঞ্চলিক খেলোয়াড় এবং হবু বৈশ্বিক পরাশক্তি হিসেবে দেশটির যে দায়িত্ব আছে, তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।”
উত্তর কোরিয়াকে নিয়েও চীন একই খেলা খেলছে বলে এই সম্পাদকীয়তে দাবি করা হয়। এতে বলা হয়, একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে চীন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বৈশ্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা থেকে অপরিমেয়ভাবে উপকৃত হয়েছে। এবার চীনের পালা। তাকেও এবার বৈশ্বিক নিরাপত্তা রক্ষায় পদক্ষেপ নিতে হবে। ক্ষমতার সঙ্গে সঙ্গে কিছু দায়-দায়িত্বও আসে।
চীনের একহাতে জান্তা অন্য হাতে বিদ্রোহীরা
কালের পর কাল সামরিক শাসনে থাকা মিয়ানমারের সেনা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরেই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক চীনের। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সেনাবাহিনী ফের ক্ষমতা দখলকেও চীন শুধু ‘মন্ত্রিসভায় বড় রদবদল’ বলে আখ্যা দিয়েছিল। এরপর দেশটিতে রক্তক্ষয়ী আন্দোলন এবং গৃহযুদ্ধ শুরু হলেও চীন সামরিক শাসকদের পাশেই থাকে। তবে গত বছরের অক্টোবরের শেষের দিকে জান্তার বিরুদ্ধে থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের সফল অভিযানের পর থেকে চীন সুর কিছুটা বদল করে।
যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের এক লেখায় বলা হয়, নিজের স্বার্থরক্ষায় যুদ্ধবিধ্বস্ত প্রতিবেশীর বিষয়ে চীন নিজের অবস্থান পুনর্বিবেচনা করতে শুরু করে। থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের সঙ্গে চীনের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর সম্পর্ক রয়েছে বলেও শোনা যায়। বলা হচ্ছে, এই বিদ্রোহী জোটকে চীন প্রচ্ছন্নভাবে প্রশ্রয় দিচ্ছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বেইজিং তাদের সাহায্য করছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
এতে গত বছরের নভেম্বরে এসে অনেকেই ধারণা করেন, চীন মিয়ানমারে মিত্রপক্ষ বদলেছে এবং জান্তার সময়ও ফুরিয়ে আসছে। জান্তাও এতে মনোক্ষুণ্ন হয় এবং বিষয়টি গোপনও করেনি। নভেম্বরেই জান্তা তার সমর্থকদের দিয়ে চীনবিরোধী বিক্ষোভ করায়।
এতে মিয়ানমারের সেনা সরকারকে আশ্বস্ত করতে ফের উদ্যোগ নেয় চীন। জান্তার সঙ্গে যৌথ নৌ-মহড়া চালায় চীনের নৌবাহিনী। চীনের শীর্ষ কূটনীতিক ওয়াং ই’র সঙ্গে ডিসেম্বরের শুরুতে সাক্ষাৎ হয় মিয়ানমারের উপপ্রধানমন্ত্রী থান সুয়ের।
গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও জাতিগত মিলিশিয়াদের মধ্যে একটি অস্থায়ী যুদ্ধবিরতির মধ্যস্থতাও করে চীন। এরপর এবছরের ১২ জানুয়ারি চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, তাদের মধ্যস্থতায় মিয়ানমারের জাতিগত বিদ্রোহীদের জোট ত্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স ও জান্তার প্রতিনিধিদের মধ্যে আলোচনার পর উভয়পক্ষই স্থায়ী যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে।
কিন্তু কয়েকদিন পরই জোটের ওপর জান্তা বাহিনী গুলি চালায়। এতে বিরোধীরা পাল্টা হামলা শুরু করে। শান প্রদেশে উভয়পক্ষই যুদ্ধবিরতি চুক্তি ভঙ্গ করে একাধিক স্থানে হামলা চালায়। ফলে ভেস্তে যায় যুদ্ধবিরতি ও শান্তি আলোচনা।
এদিকে, রাখাইন প্রদেশেও আরাকান আর্মি হামলার তীব্রতা বাড়িয়েছে। বিবিসির বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, চীনের সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের শান প্রদেশে অস্ত্র-বিরতির জন্য চীন চেষ্টা করলেও রাখাইনে অস্ত্র বিরতি নিয়ে তাদের তেমন তৎপরতা নেই। আরাকান আর্মি যতদিন পর্যন্ত রাখাইনে চীনের স্বার্থের উপর আঘাত করবে না, ততদিন পর্যন্ত চীন কিছু বলবে বলে মনে হয় না।
বিবিসি লিখেছে, মিয়ানমারের যুদ্ধবিরতি চীনের চাওয়ার উপর এখন আর খুব বেশি নির্ভর করে না। কারণ, ঐতিহাসিকভাবে দেখা গেছে মিয়ানমারে যারা ক্ষমতায় থাকে, তাদের সঙ্গে চীনের ভালো সম্পর্ক থাকে। এর আগে অং সান সুচির সরকারের সঙ্গেও তাদের ভালো সম্পর্ক ছিল।
বেইজিংয়ের ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ পলিসি
দ্য ইকোনমিস্ট লিখছে, মিয়ানমারের জান্তা সরকারের প্রতি চীনের অসন্তোষের বড় কারণ সীমান্ত এলাকায় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে তাদের ব্যর্থতা। তারা চীনের সঙ্গে দেশটির জঙ্গলময় সীমান্ত অঞ্চল নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে। সীমান্তে এই নিরাপত্তহীনতার কারণে দেশটিতে চীনের অবকাঠামোগত বিনিয়োগ প্রকল্পগুলোও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়া মিয়ানমার থেকে শরণার্থী, মাদক ও অন্যান্য অপরাধমূলক উপাদানও চীনে ঢুকে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
সর্বশেষ সংযোজন অনলাইন প্রতারণা কেলেঙ্কারি। মিয়ানমার ও চীনের একটি অপরাধী চক্র হাজার হাজার চীনা নারী-পুরুষকে পাচার করেছে। তাদেরকে মিয়ানমারের সীমান্ত এলাকার জঙ্গলে আটকে রেখে অনলাইন প্রতারণার কাজে ব্যবহার করছে। প্রেমের সম্পর্কের ফাঁদে ফেলে বা মুনাফার লোভ দেখিয়ে অনলাইনে ভুয়া বিনিয়োগে প্রলুব্ধ করানো হয় তাদের দিয়ে। একাজে রাজি না হলে তাদের নির্যাতন বা হত্যা করা হয়।
বিষয়টি নিয়ে চীন মিয়ানমারের জান্তা সরকারের সঙ্গে বেশ কয়েকবার কথা বলেছে। ২০২২ সালে মে মাসেও চীনের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিন গ্যাং অনলাইন কেলেঙ্কারিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি নিয়ে মিয়ানমারে আসেন। কিন্তু এরপরও মিয়ানমারের সেনাবাহিনী অপরাধী চক্রগুলোকে ধরতে তেমন কোনও পদক্ষেপই নেয়নি বা নিতে ব্যর্থ হয়েছে । অভিযোগ রয়েছে, এই প্রতারক চক্রের কাছ থেকে বিশাল পরিমাণ অর্থও পান সামরিক সরকারের কর্তব্যক্তিরা।
দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, এ কারণেই হয়ত সীমান্তবর্তী বিদ্রোহীদের জোটকে প্রশ্রয় দিচ্ছে চীন। কারণ থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স ঘোষণা দিয়েছে, তারা সীমান্ত এলাকার অপরাধী চক্রগুলোকে নির্মূল করবে।
অন্যদিকে, মিয়ানমারের জান্তার সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে চলেছে চীন। দেশটির বেশির ভাগ ব্যাংক, বিমানবন্দর, বড় শহর ও শিল্প এলাকা এখনও সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ফলে চীন কখনও কখনও মিয়ানমারের বিদ্রোহীদের সমর্থন দিলেও সামরিক শাসকদের পাশেই বেশি দাঁড়াবে। দ্য ইকোনমিস্টের বিশ্লেষণ, চীনের এই ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’নীতি মিয়ানমারের পরিস্থিতি আরও খারাপ করে তুলতে পারে।