চীনের সামরিক বাহিনী তাইওয়ানকে ঘিরে সোমবার নতুন করে সামরিক মহড়া চালিয়েছে। দ্বীপটি ঘিরে যুদ্ধ জাহাজ ও বিমান নিয়ে এ বছর এটি চীনের দ্বিতীয় সামরিক মহড়া।
স্ব-শাসিত গণতান্ত্রিক দ্বীপটি গত ১০ অক্টোবর তাদের জাতীয় দিবস পালন করে। এর কয়েকদিন পরই চীন তাইওয়ানকে ঘিরে নতুন এই সামরিক মহড়া শুরু করে। সেদিন তাইওয়ানের নতুন প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম লাই চিং-তে প্রথমবারের মতো জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠানে ভাষণ দেন।
ভাষণে তিনি চীন কর্তৃক তাইওয়ানের যেকোনো ‘অধিভুক্তি বা দখল’ প্রতিরোধের প্রতিশ্রুতি দেন। এসময় লাই চিং-তে বলেন, “দ্বীপের ২ কোটি ৩০ লাখ মানুষের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার কোনও অধিকার বেইজিংয়ের নেই।”
চীনা সামরিক বাহিনীর ইস্টার্ন থিয়েটার কমান্ডের মুখপাত্র ক্যাপ্টেন লি শি বলেছেন, জয়েন্ট সোর্ড-২০২৪বি শিরোনামে মহড়াটি ‘তাইওয়ান দ্বীপের উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চলে’ অনুষ্ঠিত হয়।
তিনি বলেন, “এই মহড়ায় ‘সমুদ্র-আকাশ যুদ্ধ-প্রস্তুতি টহল, মূল বন্দর ও আশেপাশের এলাকায় অবরোধ’ এবং ‘সমুদ্র ও স্থল লক্ষ্যবস্তুতে আক্রমণ’ এর অনুশীলন চালানো হয়।”
এই মহড়াকে তিনি “রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব এবং জাতীয় ঐক্য রক্ষার জন্য একটি বৈধ এবং প্রয়োজনীয় অপারেশন” বলেও উল্লেখ করেন। সোমবারই মহড়াটি শেষ হয়।
তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এই মহড়াকে চীনের ‘অযৌক্তিক এবং উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড’ আখ্যায়িত করে এর তীব্র নিন্দা জানিয়েছে।
দ্বীপটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বলেছেন, তাইওয়ান নিজের ‘স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় প্রতিক্রিয়া জানাতে উপযুক্ত বাহিনী পাঠিয়েছে।
তাইওয়ানের প্রেসিডেন্টের কার্যালয় বলেছে, চীনের উচিৎ তাইওয়ানের জনগণের স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক জীবনযাপনের পছন্দকে সম্মান করা এবং সামরিক উসকানি না দেওয়া।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন তাইওয়ানের আশেপাশে তার সামরিক তৎপরতা বাড়িয়েছে। চীনের দাবি তাইওয়ান তার অংশ।
জার্মান মার্শাল ফান্ডের ইন্দো-প্যাসিফিক প্রোগ্রামের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বনি গ্লেসার আল জাজিরাকে বলেন, “লাইয়ের জাতীয় দিবসের বক্তৃতার পরে চীন যে তাইওয়ানকে ঘিরে সামরিক মহড়া চালাবে তা প্রত্যাশিতই ছিল।”
বিশ্লেষকরা বলছেন, স্বশাসিত তাইওয়ানের উপর নিজের দাবিকে আরও জোরালো করাই চীনের এসব মহড়ার লক্ষ্য।
বেইজিং দ্বীপটিকে চীনের একটি বিচ্ছিন্ন প্রদেশ হিসাবে দেখে এবং শেষ পর্যন্ত তা চীনের অংশ হবে বলে মনে করে। আর সেটা অর্জনের জন্য প্রয়োজন হলে বলপ্রয়োগ করবে বলেও জানিয়েছে।
তবে তাইওয়ানের জনগণের একটি বিশাল অংশ নিজেদের একটি পৃথক জাতি বলে মনে করে। অবশ্য দেশটির অধিকাংশই স্থিতাবস্থা বজায় রাখার পক্ষে— যেখানে তাইওয়ান চীন থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করবে না বা এর সঙ্গে একত্রিতও হবে না।
অবশ্য নতুন প্রেসিডেন্ট লাইয়ের মতে, তাইওয়ান এরই মধ্যে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হওয়ায় আনুষ্ঠানিকভাবে আর স্বাধীনতা ঘোষণার প্রয়োজন নেই।
বেইজিং তাইওয়ানকে তার নিয়ন্ত্রণে আনতে শক্তি প্রয়োগের সম্ভাবনা বাতিল করেনি। উল্টো বলেছে যে, এই মহড়া ’তাইওয়ানের স্বাধীনতাকামী বাহিনীগুলোর বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপের’ জন্য একটি সতর্কতা।
গত জানুয়ারিতে নির্বাচিত হওয়ার পর মে মাসে দায়িত্ব গ্রহণ করা তাইওয়ানের নতুন প্রেসিডেন্ট লাই চিং-তেকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ হিসাবে আখ্যায়িত করেছে চীন। লাই ক্ষমতা গ্রহণের তিন দিন পর (২৩-২৪মে) তাইওয়ানকে ঘিরে এ বছরের প্রথম সামরিক মহড়াটি চালায় চীন। সেটির নাম ছিল জয়েন্ট সোর্ড-২০২৪এ।
তাইওয়ানের নতুন প্রেসিডেন্ট গত ২০ মে আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব গ্রহণ করার পর উদ্বোধনী ভাষণে চীনের প্রতি তাইওয়ানকে ‘ভয় দেখানো’ বন্ধের আহ্বান জানান। তার তিনদিন পরই চীন ওই সামরিক মহড়া চালায়।
লাইয়ের প্রেসিডেন্ট হওয়ার মধ্য দিয়ে তাইওয়ানে প্রথমবারের মতো ডেমোক্র্যাটিক প্রোগ্রেসিভ পার্টি (ডিপিপি) টানা তৃতীয়বার ক্ষমতায় এসেছে। ১৯৯৬ সালে সরাসরি প্রেসিডেন্ট নির্বাচন শুরুর পর থেকে সেখানে ডেমোক্র্যাটিক প্রোগ্রেসিফ পার্টি ও চীনের প্রতি নমনীয় কুওমিনতাং পার্টি দুই মেয়াদ করে ক্ষমতায় থাকতো। কিন্তু এবারই প্রথম কট্টর চীন বিরোধীরা টানা তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসলো। এ কারণেই হয়তো চীন এবার একটু বেশিই চটেছে।
নির্বাচনের আগে থেকেই বেইজিং সতর্ক করে আসছিল, লাই চেং-তে বিজয়ী হলে উত্তেজনা বাড়তে পারে এবং সংঘর্ষ হতে পারে।
গত জানুয়ারি থেকেই চীন বারবার তাইওয়ানের এবারের নির্বাচনকে শান্তি বা যুদ্ধের মধ্যে যে কোনও একটিকে বেছে নেওয়ার নির্বাচন হিসেবে অভিহিত করছিল। কিন্তু তাইওয়ানের ভোটাররা সেই সতর্কতা প্রত্যাখ্যান করে ডিপিপিকে ফের ক্ষমতায় আনে।
লাইয়ের রাজনৈতিক অতীতের জন্যই তাকে চীনের এতটা অপছন্দ। ৬৪ বছর বয়সী এই সাবেক ডাক্তার ও প্রবীণ রাজনীতিবিদ একসময় তাইওয়ানের স্বাধীনতার প্রকাশ্য সমর্থক ছিলেন।
তাইপেই ন্যাশনাল তাইওয়ান ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক লেভ নাচম্যান বলেছেন, চীনের সর্বশেষ পদক্ষেপে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।
নাচম্যান সোশাল মিডিয়া এক্স-এ লিখেছেন, “সামরিক হুমকি কোনও ছোট বিষয় নয়। তবুও আমরা সবাই জানতাম যে, জাতীয় দিবসে লাই-এর বক্তৃতার পর চীনের সামরিক বাহিনী এরকম সামরিক হুমকি দিয়েই প্রতিক্রিয়া জানাবে।
“এতে আতঙ্কিত হওয়ার বা অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখানোর দরকার নেই। আমরা সবাই জানতাম এটি আসছে। এটি দ্রুতই চলেও যাবে।”
১০ অক্টোবরের বক্তৃতায় লাই অবশ্য বেইজিংয়ের সঙ্গে সমঝোতার কথাও বলেন। লাই চীনের সঙ্গে “সুস্থ ও সুশৃঙ্খল সংলাপ এবং মতবিনিময়ের” আশা প্রকাশ করেন এবং মধ্যপ্রাচ্য ও ইউক্রেনে সংঘাত নিরসনে সহায়তার জন্য বেইজিংকে তার প্রভাব ব্যবহার করার আহ্বান জানান।
তবে চীনের গ্লোবাল টাইমসে রবিবার প্রকাশিত বিশ্লেষণে লাইয়ের বক্তব্যকে “চকোলেটের মোড়কে বিষের বড়ি” হিসাবে বর্ণনা করেছেন দেশটির বিশ্লেষকরা।
চীনের অন্য রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম লাইয়ের বিরুদ্ধে তাইওয়ান ও চীনকে আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে উল্লেখ করার অভিযোগ করেছে। গত সপ্তাহের বক্তৃতায় লাই দুই সরকারের ভিন্ন ভিন্ন বয়স উল্লেখ করেন।
লাই বলেন, “গত ১ অক্টোবর জাতীয় দিবস উদযাপন করার সময় কমিউনিস্ট সরকার শাসিত চীনের বয়স হয়েছে ৭৫ বছর। আর ১০ অক্টোবর জাতীয় দিবস উদযাপন করা তাইওয়ানের চীন প্রজাতন্ত্রের বয়স হয়েছে ১১৩ বছর।”
তাইপেই-ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ইউএস-তাইওয়ান ওয়াচের সহ-প্রতিষ্ঠাতা কুয়াং-শুন ইয়াং বলেছেন, “রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্য সংঘাত এবং উত্তর কোরিয়ার হুমকি বেড়ে চলায় যে বৈশ্বিক অস্থিরতা চলছে, এর মধ্যে চীন এই মহড়ার মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক মহলকে একটু বাজিয়ে দেখছে।”
তিনি আল জাজিরাকে বলেন, “আমরা দেখতে পাচ্ছি, বিশ্বজুড়ে অনেক আঞ্চলিক সংঘাত চলমান রয়েছে। সম্ভবত বেইজিং সময়টিকে তাদের ইচ্ছা পরীক্ষা করার এবং তাইওয়ানের প্রতি বিশ্বের সমর্থন যথেষ্ট শক্তিশালী কিনা তা যাচাইয়ের সুযোগ হিসাবে দেখছে।”
এর আগে বেইজিং আন্তর্জাতিক মঞ্চ থেকেও তাইওয়ানকে মুছে ফেলার চেষ্টা করেছে। দ্বীপটিকে বৈশ্বিক ফোরাম থেকে অবরুদ্ধ করেছে এবং কূটনৈতিকভাবে একঘরে করেছে। ফলে বর্তমানে একমাত্র যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানের প্রধান আন্তর্জাতিক সমর্থক ও অস্ত্র সরবরাহকারী হিসেবে রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, তারা তাইওয়ানকে ঘিরে চীনের সর্বশেষ এই সামরিক মহড়ায় ‘গুরুতরভাবে উদ্বিগ্ন’।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার এক বিবৃতিতে বলেছেন, “একটি নিয়মিত বার্ষিক বক্তৃতার পর সামরিক উস্কানি দিয়ে পিআরসি-র প্রতিক্রিয়া অযৌক্তিক এবং ঝুঁকি বাড়ায়।
“আমরা পিআরসিকে সংযমের সঙ্গে কাজ করার জন্য এবং তাইওয়ান প্রণালীসহ বিস্তৃত অঞ্চলজুড়ে শান্তি ও স্থিতিশীলতাকে নষ্ট করতে পারে এমন কোনো পদক্ষেপ এড়াতে আহ্বান জানাই। এটি আঞ্চলিক শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য এবং আন্তর্জাতিক উদ্বেগের বিষয়।”
তথ্যসূত্র : আল জাজিরা