তাইওয়ানের জনগণ চায় না তাদের নেতা চীনের কাছে মাথা নত করুক। তাই টানা তৃতীয়বার স্বাধীনতাপন্থী একটি পার্টিকে ক্ষমতায় আনল তারা। গত শনিবারের নির্বাচনে তাইওয়ানের নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন লাই চিং তে। তিনি ডেমোক্রেটিক প্রোগ্রেসিভ পার্টির (ডিপিপি) নেতা।
এখন বেইজিংয়ের প্রতিক্রিয়ার পালা।
লাইয়ের জয় নিঃসন্দেহে বেইজিংয়ের জন্য পরাজয়। তাইওয়ানকে নিয়ন্ত্রণে আনার তাদের দীর্ঘ অভিলাষ আরও দূরে সরে গেছে। চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির অনেকদিনের চাওয়া তাইপের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া। কিন্তু অঞ্চলটির ক্ষমতাসীন ডিপিপি তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসায় চীনের সেই চাওয়া অপূর্ণই রয়ে গেল।
তাইপের সুচৌ ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক চেন ফাং-ইউর মতে, “লাইয়ের জয় মানে শি জিনপিংয়ের মুখ থুবড়ে পড়া। তার তাইওয়ান নীতি ব্যর্থ হয়েছে। এখন তাকে তার ক্ষমতা প্রদর্শন করতে কিছু করতে হবে।”
আগামী মাসগুলোতে বেইজিং তাইওয়ানকে ভয় দেখানোর চেষ্টা আরও বাড়াবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর মধ্যে সামরিক হস্তক্ষেপ এবং অর্থনৈতিক চাপের মতো কৌশল প্রয়োগের বিষয়গুলো সামনে আসছে।
যদিও তাইওয়ান ও যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তা ও বিশ্লেষকরা মনে করেন, অন্তত এখনই বেইজিং সশস্ত্র সংঘাত বা আক্রমণ করবে না। কারণ হিসেবে তারা চীনের যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক স্থিতিশীল রাখার সাম্প্রতিক আগ্রহকে আমলে নিচ্ছেন।
তাইওয়ানে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের অধীন আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব তাইওয়ান গতকাল সোমবার এক বিবৃতি দেয়। সেখানে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা স্টিফেন হ্যাডলি ও সাবেক পররাষ্ট্র উপমন্ত্রী জেমস স্টেইনবেইনের নেতৃত্বে ওয়াশিংটনের একটি প্রতিনিধি দলের গত রবিবার তাইওয়ানে পৌঁছানোর কথা ছিল।
লাইয়ের জয়ে বেইজিংয়ের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া অনুমেয় ছিল। তাইপের নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর ওয়াশিংটনের বক্তব্যের বিরুদ্ধে রবিবার বেইজিংয়ের কর্মকর্তারা কঠোর ভাষা প্রয়োগ করেন। লন্ডনে চীনা দূতাবাস বলেছে, “তাইওয়ানের পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, তাইওয়ান চীনের অংশ। এই মৌলিক সত্যটি পরিবর্তিত হবে না।”
বেইজিংয়ের প্রতিক্রিয়া
তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় রোববার সকালে জানিয়েছে, দ্বীপের কাছে চারটি সামরিক জাহাজ শনাক্ত করা হয়েছে। এরই মধ্যে রাজধানীর কাছে উত্তর-পশ্চিম উপকূলে একটি চীনা বেলুনও দেখা গেছে। জাহাজগুলোর মধ্যে দুটি ছিল যুদ্ধজাহাজ, একটি ফ্রিগেট এবং একটি টর্পেডো বোট। তারা তাইওয়ানের দক্ষিণাঞ্চলীয় দ্বীপ কেলিং থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে ছিল। আর বেলুনটি ১০ কিলোমিটার উঁচুতে প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে আকাশে ভাসছিল।
গত আট বছর ধরে, ডিপিপি ক্ষমতায় আসার পর, বেইজিং প্রেসিডেন্ট সাই ইং-ওয়েনের সঙ্গে সব আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। লাইয়ের সঙ্গে আলোচনার সম্ভাবনা আরও কম। কারণ তিনি আগে থেকেই স্বাধীনতার জন্য বেইজিংকে চাপ দিয়ে আসছেন।
সাইয়ের ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকাকালীনই লাই অবশ্য তার কট্টর অবস্থান থেকে অনেকটা সরে এসেছেন। তিনি তাইওয়ান প্রণালীতে যুদ্ধ এড়ানোর নীতি এগিয়ে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এমনকি তিনি বেশ কয়েকবার বলেছিলেন, তিনি বেইজিংয়ের সঙ্গে ‘সমান মর্যাদায়’ আলোচনা করতে আগ্রহী।
কিন্তু বেইজিং ডিপিপির অবস্থানকে প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের মতে, তাইওয়ানকে সার্বভৌম এবং আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন ঘোষণা করে সংঘাতের ঝুঁকি নেওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই।
তাইওয়ানের ভোটাররা যারা লাইকে ভোট দিয়েছেন এবং দুই বিরোধী প্রার্থীকেও সমর্থন দিয়েছেন, তারা সামনের কঠিন চার বছরের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করছেন।
লাইকে ভোট দিয়েছেন পর্যটন শিল্পের সঙ্গে জড়িত ৬০ বছর বয়সী আকিরা চিউ। তিনি বলেন, “চীনারা নিশ্চিতভাবেই তাইওয়ানের উপর চাপ বাড়াবে। কিন্তু আমি তাদের ভয় পাই না। আমরা আমাদের দেশকে রক্ষায় প্রস্তুত।”
তাইপের প্রধান বিরোধীদল কুওমিনতাংকে ভোট দিয়েছেন হেসি সিন জুং। তিনি বলেন, “ডিপিপি তাইওয়ানকে চীনের সঙ্গে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেবে। কুওমিনতাং ঐতিহ্যগতভাবেই চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে চলার পক্ষপাতী।”
“ডিপিপির চীনের সঙ্গে মুখোমুখি হওয়ার ইতিহাস আছে। তাই আমি তাইওয়ানের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত। পরবর্তী চার বছরে চীনের ধৈর্যচ্যুতি ঘটলে এবং যুদ্ধ ঘোষণা করলে কী হবে? এটা অসম্ভব নয়।”
বিশ্লেষকরা মনে করেন, ২০ মে লাইয়ের অভিষেক হওয়ার আগে বেইজিং কোনও কঠোর পদক্ষেপ নেবে না। অভিষেকের পরই নির্ধারিত হবে তাইওয়ান, চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার সম্পর্ক কেমন হবে।
এর আগে বেইজিং তাইওয়ানকে আরও চাপে রাখতে পারে। একই সঙ্গে ওয়াশিংটন যাতে লাইকে নিয়ন্ত্রণের আনার চেষ্টা করে সেই চাপও দেবে চীন। কারণ তারা চায় না, তাদের পদক্ষেপের কারণে তাইওয়ানের জনগণ চীন থেকে আরও দূরে সরে যাক।
ওয়াশিংটন ডিসি-র স্টিমসন সেন্টারের চীন কর্মসূচির পরিচালক ইউন সান বলেছেন, “বেইজিং তাইওয়ানের নতুন প্রেসিডেন্ট লাইকে অভিষেক ভাষণে এমন কিছু বলা থেকে বিরত রাখতে সামরিক চাপ বাড়াবে যা চীনের কাছে অগ্রহণযোগ্য।”
চীনের সম্ভাব্য পদক্ষেপ
২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের তৎকালীন স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি তাইপে সফর করেন। এর প্রতিক্রিয়ায় চীনা সামরিক বাহিনী চার দিনের মহড়ায় প্রায় এক ডজন ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছিল। বেইজিং এমন শক্তিপ্রয়োগ আবার করবে বলে খুব কম মানুষই বিশ্বাস করেন। তবে এক্ষেত্রে বেইজিং অন্য পন্থাও নিতে পারে।
সম্ভাব্য পন্থাগুলোর মধ্যে, সামরিক মহড়া বাড়ানো, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ও রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতার মতো পদক্ষেপ দেখা যেতে পারে।
যদিও বিশ্লেষকরা বলছেন, এমন পদক্ষেপ তাইওয়ানিজদের মধ্যে চীনের প্রতি ক্ষোভ বাড়ানোর পাশাপাশি স্বাধীনতার আন্দোলনকে বেগবান করতে পারে। আর এই সুযোগে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা তাইওয়ানের নিরাপত্তা নিশ্চিতে পদক্ষেপ নিতে পারে।
চীন গত ডিসেম্বর থেকে তাইওয়ানের আকাশসীমায় ৩১টিরও বেশি গোয়েন্দা বেলুন পাঠিয়েছে। গত বছর এমন একটি বেলুন ভূপাতিত করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। এটি মূলত চীনের ‘গ্রে জোন’ নামক একটি কৌশল। এর উদ্দেশ্য হল তাইওয়ানকে ভয় দেখানো এবং তাদের ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতা শেষ করা।
বেলুনগুলি এত উঁচুতে উড়ে যে সেগুলোকে গুলি করে ভূপাতিত করা কঠিন। ফলে তাইওয়ানের যুদ্ধবিমানকে বারবার চক্কর দিতে হয়। এতে জ্বালানি ও ক্ষেপণাস্ত্রের ব্যবহার বাড়ে। বেলুনগুলোর অবিরাম উপস্থিতি তাইওয়ানের সামরিক বাহিনীকে তটস্থ থাকতে বাধ্য করে।
নির্বাচনের আগে বেইজিং তাইওয়ান থেকে আমদানি করা ১২ ধরনের রাসায়নিকের শুল্ক বাতিল করে। এটা গত এক দশক ধরে চলমান বাণিজ্য চুক্তির অংশ। এছাড়াও আরও শুল্ক বৃদ্ধির হুমকি দিয়েছে চীন। এই পদক্ষেপটি তাইওয়ানের অর্থনীতিতে বড় ধরনের আঘাত হানতে পারে। কারণ চীন তাইওয়ানের অন্যতম বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার।
ইউরেশিয়া গ্রুপের চীন বিভাগের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রিক ওয়াটার্স। তিনি আগে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরে চীন নীতির শীর্ষ কর্মকর্তা ছিলেন। তার মতে, “এসব পদক্ষেপের ফলে লাই নমনীয় না হয়ে কঠোর হয়ে উঠবেন।”
লাইকে চাপে রাখতে তার কিছু দুর্বলতাকে কাজে লাগাতে পারে বেইজিং। কীভাবে মাত্র ৪০ শতাংশ ভোটে লাই প্রেসিডেন্ট হলেন এবং তার দল কীভাবে আইনসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে, এনিয়ে রবিবার চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
চীনের তাইওয়ান বিষয়ক অফিস গত শনিবার রাতে এক বিবৃতিতে বলেছে, “নির্বাচনের ফল প্রমাণ করে যে, দ্বীপটিতে ডিপিপি সংখ্যাগরিষ্ঠ জনমতের প্রতিনিধিত্ব করে না।”
ক্লেরন্ট ম্যাকেনা কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মিনশিন পেইয়ের মতে, নির্বাচনী লড়াইয়ের ফলাফল চীনের জন্য ধাক্কা। কিন্তু বেইজিং এই ভেবে সান্তনা পেতে পারে যে, নতুন সরকার বিগত সরকারের চেয়ে দুর্বল। আর বিরোধী কুওমিনতাং পার্টি এখন আইনসভায় এগিয়ে আছে।
পেই বলেন, “মুখরক্ষা ছাড়া, চীন সামগ্রিকভাবে আগের তুলনায় সামান্য ভালো অবস্থানে রয়েছে।”
বেইজিং-ওয়াশিংটন সম্পর্কে নতুন মোড়
তবুও উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো, নির্বাচনের পরেও যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ বজায় রেখেছে। গত নভেম্বরে শি-বাইডেনের আলাপের ফলাফল এখনও ভেস্তে যায়নি। আর এই কারণেই চীন সম্ভবত কঠোর কোনও পদক্ষেপ নেবে না বলে মনে করেন জার্মানির মার্শাল ফাউন্ডেশনের ইন্দো-প্যাসিফিক কর্মসূচির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বনি গ্লেসার।
তিনি বলেন, “আমি মনে করি চীন বড় ধরনের কোনও পদক্ষেপ নেবে না। হয়ত তাইওয়ানের আকাশসীমায় যুদ্ধবিমান ওড়াবে তারা। কারণ কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য কিছুটা জায়গা তাদের রাখতে হবে। এছাড়া তারা যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্কের নাজুক স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে চায় না।”
তাইপের নির্বাচনের আগে আরও একবার বাইডেন প্রশাসন বলেছিল যে, তারা তাইওয়ানের স্বাধীনতাকে সমর্থন করে না। প্রণালীতে সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান চায় তারা।
ক্রাইসিস গ্রুপ থিংক ট্যাংকের চীনবিষয়ক জেষ্ঠ্য বিশ্লেষক আমান্ডা হসিয়াও মনে করেন, বেইজিংকে আশ্বস্ত করতেই বাইডেন প্রশাসন এমন বক্তব্য দিয়েছিল।
বেইজিং এবং লাইয়ের আগমী প্রশাসনের মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক আলোচনা আপাতত সম্ভব নয়। কিন্তু উত্তেজনা কমাতে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। হসিয়াও বলছেন, উভয় পক্ষ প্রকাশ্য বিবৃতি বা অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলের মাধ্যমে যোগাযোগ করলে উত্তেজনা কমতে পারে।
তথ্যসূত্র : ওয়াশিংটন পোস্ট, নিউ ইয়র্ক টাইমস, বিবিসি