ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফৌজদারহাট বক্ষব্যাধি হাসপাতাল ফেলে কিছুদূর এগুতেই বন্দর টোল রোডের সামনে ছিল বিস্তীর্ণ সরকারি জমি। সড়ক সংলগ্ন এই ১৯৪ একর জায়গার মধ্যে রয়েছে দুটি বড় জলাশয়। জলাশয়ের পশ্চিম প্রান্তে ম্যানগ্রোভ বন, আর এই বনের অন্য প্রান্তে বঙ্গোপসাগর।
সরকারি এই জমি একটা দীর্ঘসময় ছিল দখলদারদের কবলে। সেখানে কেউ রেস্তোরাঁ নির্মাণ করে দিব্যি ব্যবসা করে যাচ্ছিল, কেউ জলাশয় দখল করে করছিল মাছের চাষ। সেইসঙ্গে চলত অবাধে মাদক সেবন ও বেচাকেনা। কয়েক বছর আগেও সন্ধ্যার পর এই এলাকার পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে ভয়ের অনুভূতি জেঁকে বসত।
এখন সেই দৃশ্য বদলে গেছে। পরিত্যক্ত ওই জমিতে গড়ে উঠেছে দৃষ্টিনন্দন পর্যটন কেন্দ্র চট্টগ্রাম ডিসি পার্ক, যা ঝলমল করছে ১২২ জাতের ফুলের সমারোহে।
চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে সরকারি এই জমি দখলমুক্ত করার উদ্যোগ নেন আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান। এর একমাস পরই তিনি সেখানে বিশেষ ধরনের বাগান গড়ে তোলার এক ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নেন। সেই বাগানই আজকের ডিসি পার্ক।
প্রথম বছর ১২০ প্রজাতির ফুলের গাছ লাগিয়ে আয়োজন করা হয় ১০ দিনের ফুল উৎসব। সেই আয়োজন দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন চট্টগ্রামের মানুষ। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল নানা জাতের ফুল। দেশি-বিদেশি সব ধরনের ফুলই স্থান পেয়েছিল উৎসবে। ছিল ছবি তোলার জন্য সেলফি জোন, বিনোদনের নানা ব্যবস্থা।
চট্টগ্রাম শহর থেকে ফৌজদারহাটে যাওয়ার জন্য চালু হয়েছিল বাস সার্ভিস। ফলে নানা বয়সের, শ্রেণি-পেশার মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয় জেলা প্রশাসনের সেই আয়োজন। সেই বছর ফুল মেলায় প্রবেশ করেছিল অন্তত ৫০ হাজার দর্শনার্থী।
সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এবার আরও জাঁকজমকভাবে আয়োজন করা হয়েছে ফুল উৎসবের। ১৯৪ একরের পুরোটাই ফুলে ফুলে রঙিন হয়েছে।
‘দেশের সবচেয়ে বড় ফুলের বাগান’
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের দাবি, আয়তন, ফুলের প্রজাতি ও সংখ্যা বিবেচনায় এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ফুলের বাগান। বাগানে ১২৭ প্রজাতির এক লাখের বেশি ফুলের গাছ লাগানো হয়েছে।
ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, ম্যাগনোলিয়া, শিউলি, হাসনাহেনা, অপরাজিতা যেমন আছে তেমনি আছে চেরি, জারবেরা, উইলো, উইস্টেরিয়া। আছে কনকাম্বরী, হাইব্রিড জবা, চিলিজবা, হিজল, কৃষ্ণচূড়া, বকুল, পলাশ, শিমুল, করবী, ধানলিলি, নীল পারুল, নীলকণ্ঠ, রেইনলিলি, গন্ধরাজ, কাঠমল্লিকা, বাসন্তী, লিলিয়াম, জিনিয়া, ইনকা মেরী গোল্ড, ডালিয়া, কামিনী, বেলী, দোলনচাঁপা, মাধবীলতাসহ দেশি–বিদেশি লাখো ফুলের সমারোহ।
ধরনভেদে প্রতিটি গাছের পাশে লেখা আছে ফুলের নাম ও সাধারণ পরিচিতি।
আছে টিউলিপও
টিউলিপ মূলত শীতপ্রধান দেশের ফুল। নেদরল্যান্ডসহ বিশ্বের অনেক দেশেই টিউলিপ ফুলের বাগান পর্যটকদের জন্য বিশেষ আকর্ষণের বিষয়। প্রতিবেশী ভারতের কাশ্মীরের শ্রীনগরের ডাললেকের পাশেও দেখা মেলে দৃষ্টিনন্দন টিউলিপ ফুলের বাগান।
বাংলাদেশের দর্শকদের জন্যও টিউলিপের বাগান উপহার দিতে চায় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। এজন্য ২০২৩ সালের ফুল উৎসবে ছিল ১০ প্রজাতির টিউলিপ ফুলের চারা। যার ফুল ফুটেছিল এই বাগানেই।
এবার টিউলিপ ফুলের জন্য বিশেষায়িত স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। আয়োজকদের প্রত্যাশা, এবারের মেলার মূল আকর্ষণ হবে টিউলিপ। এজন্য মেলায় প্রবেশের পর বাঁ পাশেই একটি নির্দিষ্ট অংশে রাখা হয়েছে টিউলিপের বাগান।
সেখানে একটি অংশে ছায়াঘেরা শেডে ফুটতে শুরু করেছে বিদেশি এই ফুল। লাল, হলুদ, সাদা, গোলাপি ছাড়াও লাল-হলুদ মিশ্রণের টিউলিপের সমাহার চট্টগ্রামে এই প্রথম। এবার ১৫ জাতেরে টিউলিপ মেলায় সৌন্দর্যের পেখম মেলবে, প্রত্যাশা সংশ্লিষ্টদের।
দুই সারিতে এসব টিউলিপ গাছের মূল দায়িত্বে রয়েছেন গাজীপুরের শ্রীপুরের দেলোয়ার হোসেন। ব্যক্তি উদ্যোগে তিনিই দেশে প্রথম টিউলিপ বাগান গড়ে তোলেন।
দেলোয়ার হোসেন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “নেদারল্যান্ডস থেকে আনা টিউলিপের বীজ থেকে গাছ হয়ে ফুল ফুটতে ২৫ থেকে ৩০ দিন সময় প্রয়োজন। এই সময় তাপমাত্রাও সহনীয় পর্যায়ে থাকতে হয়। তাপমাত্রা বেড়ে গেলে এই ফুল ফুটবে না। সে হিসেবে ফেব্রুয়ারির পর আর তা ফোটার সুযোগ নেই।”
দুবাইয়ের মিরাকল গার্ডেনের ছোঁয়া
মরুর বুকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ফুলের বাগান দুবাইয়ের ‘মিরাকল গার্ডেন’ এর আদলে কিছু অংশ সাজানোর চেষ্টা হয়েছে ডিসি পার্কে। মিরাকল গার্ডেনে যেমন এমিরেটসের বিশাল উড়োজাহাজের পুরোটাই ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে, ডিসি পার্কেও গিটার, নৌকাসহ বেশ কিছু স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে। সেগুলো ঢেকে যাবে ফুলে।
চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাশার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমরা পুরো এলাকা ফুল ও জলাশয়ের সমন্বয়ে একটি দৃষ্টিনন্দন স্থায়ী পার্ক হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। ফুল উৎসব তার প্রাথমিক ধাপ। ধাপে ধাপে দুটি জলাশয়কে বিনোদনের জন্য কাজে লাগানোর আয়োজন থাকবে। এখন ১২৭ প্রজাতির ফুলের গাছ লাগানো হয়েছে এবং ভবিষ্যতে মৌসুমী ফুলের বাইরে শোভা বর্ধন করে এমন ফুল গাছ লাগানো হবে।”
পুরো এলাকা নিয়ে জেলা প্রশাসন পরিকল্পনা করছে জানিয়ে সীতাকুণ্ডের সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোহাম্মদ আশরাফুল আলম বলেন, “আমরা দুই জলাশয়ের মাঝখানে একটি ওয়াকওয়ে (হাঁটার পথ) করব। এছাড়া জলাশয় ঘিরে ওয়াকওয়ে ও লাইটিং থাকবে। জলাশয়ের পশ্চিম প্রান্তে (সাগরের দিকে) বিনোদনের জন্য কটেজ নির্মাণ করা হবে। অর্থাৎ পুরো এলাকা নিয়ে একটি মাস্টারপ্ল্যান করা হবে। সেই আলোকে গড়ে তোলা হবে পার্ক।”
বৃহস্পতিবার (২৫ জানুয়ারি) নানা আয়োজনে শুরু হচ্ছে ফুল উৎসব। রয়েছে ১০০ চিত্রশিল্পীর শিল্পকর্ম প্রদর্শনী, নৌকা প্রদর্শনী, বইমেলা, ভায়োলিন শো, ঘুড়ি উৎসব, পিঠা উৎসব, সাম্পান বাইচ, পুতুল নাচসহ প্রতি সন্ধ্যায় মনোমুগ্ধকর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
থাকবে শিশুদের রাইড, ওয়াকওয়ে, সানসেট ভিউ পয়েন্ট, কবুতর শেড, কিডস জোন ও বিশেষ সেলফি কর্নার। এছাড়া প্রতিদিন বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার শিল্পীদের পরিবেশনায় থাকবে সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা।