কারফিউ শিথিলের পর চট্টগ্রাম সমু্দ্র বন্দর সচল হয়েছে। এতে দেশের প্রধান বন্দরের ভিতর আটকে পড়া আমদানি পণ্য যেমন ছাড় হচ্ছে, তেমনি রপ্তানি পণ্য জাহাজীকরণেও গতি এসেছে।
ইন্টারনেটের কাঙিক্ষত গতি না থাকায় বুধবারও পণ্য ছাড়ের লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে পুরোদমে সচল হয়েছে এ বন্দর।
সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী, মঙ্গলবার থেকে চট্টগ্রামের কিছু পোশাক কারখানা উৎপাদনে এসেছে।
বুধবার কারফিউ শিথিল হলে সেদিন থেকে ইস্পাত শিল্প, তৈরি পোশাক শিল্প, রপ্তানিমুখী শিল্প, সিমেন্ট কারখানাসহ প্রায় সব কারখানা উৎপাদন শুরু করেছে।
তবে বেশিরভাগ শিল্প কারখানাই কারখানা কাঁচামাল সংকটে পড়েছে। ফলে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী উৎপাদনে যেতে পারেনি কারখানাগুলো।
কারফিউ জারি ও ইন্টারনেট সংযোগ না থাকায় কারখানাগুলো কাঁচামাল সংকটে পড়ে। পণ্য আমদানি করে জাহাজ থেকে নেমেছে ঠিকই, কিন্তু ইন্টারনেট না থাকায় সেটি শুল্কায়ন করা যায়নি। আর শুল্কায়ন না করতে পারায় বন্দর থেকে পণ্যছাড়ের অনুমতি মেলেনি।
এই ধকল কাটাতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ম্যানুয়ালি, অর্থাৎ ইন্টারনেট নির্ভর অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেম বাদ দিয়ে বিভিন্ন পোশাক শিল্পের কাঁচামাল, পঁচনশীল পণ্যছাড়ের নির্দেশনা দেয়। কিন্তু তাতে খুব একটা সুফল মেলেনি।
কারণ, মঙ্গলবার বন্দর ব্যবহারকারী শিপিং এজেন্ট, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট, ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার অফিসগুলো চালু হয়নি। আর কারফিউ জারির কারণে মহাসড়কে কোনও যান চলেনি। ফলে মঙ্গলবার পর্যন্ত আমদানি পণ্যছাড় কার্যত বন্ধই ছিল।
বুধবার থেকে কারফিউ শিথিলে সংশ্লিষ্ট অফিসগুলো খুলেছে, এতে পণছাড়ে গতি আসে। তবে ইন্টারনেটের গতি কম থাকায় কাঙিক্ষত সুফল মেলেনি। বৃহস্পতিবার পুরোদমে বন্দর সচল হলে কার্যক্রমে গতি আসে।
চট্টগ্রামভিত্তিক এশিয়ান গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ সালাম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “তৈরি পোশাক শিল্পের পণ্য উৎপাদনের সাথে কাঁচামালের জোগান এবং পণ্য জাহাজীকরণ একটি সমন্বিত পরিকল্পনা। এখানে কোনও এক স্থানে ব্যাঘাত ঘটলে পুরো প্রক্রিয়া এবং পরিকল্পনা হোঁচট খায়। শুক্রবার থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত এক ধরনের স্থবিরতা ছিল। প্রধানমন্ত্রীর সুষ্পষ্ট নির্দেশনা পেয়ে এখন আমরা সেই ধকল কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করছি।
“এই ক’দিন ইন্টারনেট না থাকায় আমরা বিদেশি ক্রেতাকে হালনাগাদ তথ্য দিতে পারিনি। তবে টেক্সট-ফোনে আমরা সার্বিক চিত্র জানিয়ে রেখেছিলাম। এখন আমরা সার্বিক বিষয় ইমেইলে অফিসিয়ালি জানিয়ে তাদের সহায়তা চাইছি। অনেক রপ্তানি পণ্য জাহাজীকরণে সময় বাড়ানোর আবেদন করেছি। আবার কিছু পণ্য এয়ারশিপমেন্ট বা বিমানের পাঠানোর প্রয়োজন হতে পারে। বিদেশি ক্রেতা সাড়া দিলে সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নেব।”
দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা চট্টগ্রাম ইপিজেড খুলেছে মঙ্গলবার। সেদিন অবশ্য শ্রমিক উপস্থিতি কম ছিল। বুধবার থেকে পুরোদমে কাজ শুরু হয়, শ্রমিক উপস্থিতি ছিল শতভাগ। একইসঙ্গে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী ইপিজেডে বুধবার থেকে পুরোদমে উৎপাদন শুরু হয়। এদিন কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড়ে অবস্থিত কোরিয়ান ইপিজেডে পুরোদমে উৎপাদন শুরু হয়।
চট্টগ্রামের সব সিমেন্ট কারখানা কর্ণফুলী নদীর পাড়ে অবস্থিত। তুলনামূলক শান্ত থাকায় মঙ্গলবার থেকে এসব কারখানা উৎপাদনে ফিরেছে। কিন্তু কারখানাগুলোয় শ্রমিক সংকট ছিল। আবার কাঁচামাল ঘাটতিতে উৎপাদন ব্যাহত হয়।
এক সিমেন্ট কারখানার মালিক সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “কাস্টমস এবং বন্দর চালু না থাকায় আমরা পণ্য ছাড় নিতে পারিনি। ফলে গুদামে থাকা কাঁচামাল দিয়েই উৎপাদন সচল রাখা হয়েছে। এখন বন্দর থেকে কখন কাঁচামাল ছাড় করে কারখানায় আনব বুঝতে পারছি না। এই অবস্থায় সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করেই উৎপাদন কমিয়েই কারখানা সচল রেখেছি।”
এদিকে কারফিউতে অচলাবস্থার কারণে দেশের ভোগ্যপণ্যের বড় পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে পণ্য সরবরাহ প্রায় বন্ধ ছিল। নিজেদের গুদামে থাকা পণ্য দিয়েই মঙ্গলবার পর্যন্ত তারা সামাল দেন। বুধবার থেকে ভোগ্যপণ্যবাহী জাহাজ থেকে পণ্য নামিয়ে কণফুলী নদীর বিভিন্ন ঘাট হয়ে খাতুনগঞ্জ, আছদগঞ্জে আসতে শুরু করে। চট্টগ্রাম বন্দরে কন্টেইনারভর্তি হয়ে আসা ভোগ্যপণ্য ট্রাকে করে খাতুনগঞ্জ এবং দেশের বিভিন্নস্থানে পরিবহন শুরু হয়। ফলে পণ্য সরবরাহ চ্যানেল সচল হতে শুরু করে।
এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে বৈঠকে আমরা যেকোনো মূল্যে পণ্য সরবরাহ এবং কাঁচামাল পরিবহন সচল রাখতে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলাম। দ্রুততার সাথে প্রধানমন্ত্রী তাতে সাড়া দেওয়ায় পাইকারি বাজারগুলোতে ভোগ্যপণ্য সংকটের আগেই আসতে শুরু করেছে।
“বন্দর থেকে পাইকারি বাজারে এবং কারখানা থেকে পাইকারি-খুচরা বাজারে সরবরাহ বেড়েছে। আমরা আশা করছি, আগামী সপ্তাহের শুরুতেই পণ্য সরবরাহ পুরোপুরি সচল হয়ে যাবে।”
চট্টগ্রাম বন্দর পুরোপুরি সচল
স্বাভাবিক সমযে চট্টগ্রাম বন্দরের টার্মিনাল-ইয়ার্ড মিলিয়ে ৫৩ হাজার একক কন্টেইনার রাখা যায়। কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে সহিংসতায় বন্দরের ভিতর পণ্য উঠানামা স্বাভাবিক থাকলেও পণ্য ডেলিভারিতে ধস নামে।
গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে পণ্য আমদানি ও রপ্তানিতে অচলাবস্থা তৈরি হয়। এরপর কারফিউ জারির কারণে টানা সোমবার পর্যন্ত পণ্য ডেলিভারি শূন্যে নামে।
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকের পর মঙ্গলবার থেকে পণ্যছাড় শুরু হয়। মঙ্গলবার পর্যন্ত বন্দরে পণ্য রাখার কন্টেইনার জমে প্রায় ৪২ হাজারে উন্নীত হয়। বেশ কিছু পদক্ষেপের কারণে বুধবার থেকে পরিস্থিতির উন্নতি হতে থাকে।
চট্টগ্রাম বন্দর সচিব ওমর ফারুক সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “৫৩ হাজার একক কন্টেইনার রাখার ধারণ ক্ষমতার বিপরীতে আমরা ৪৭ হাজার পর্যন্ত রাখতে পারি। কিন্তু সেই অবস্থায় পৌঁছেনি পরিস্থিতি। তার আগেই সরকারি পদক্ষেপে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করে। এখন আমরা অত্যন্ত দ্রুততার এবং সর্বোচ্চ সতর্কতার সাথে জাহাজ থেকে পণ্য খালাস এবং জাহাজীকরণ করছি।
“বুধবার একদিনে কন্টেইনার ছাড় হয়েছে ৩৬০০ একক, বৃহস্পতিবার আশা করছি সেটি সাড়ে ৪ হাজারে উন্নীত হবে। স্বাভাবিক সময়ে আমরা গড়ে সাড়ে ৩ হাজার একক কন্টেইনার ছাড় দিই।”
তবে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টরা বলছেন, যে পরিমাণ কন্টেইনার জমেছে তাতে জট তৈরি হয়নি ঠিক, কিন্তু এসব কন্টেইনার ছাড় দিয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় পৌঁছতে আগামী সপ্তাহের পুরোটা সময় লাগবে।