Beta
রবিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৫
Beta
রবিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৫

ড. ইউনূসের প্রিয় ‘খাইস্যা’ রান্নার রেসিপি

ছবি: ‘লিজাস কুকিং’ ইউটিউব চ্যানেল থেকে নেওয়া
ছবি: ‘লিজাস কুকিং’ ইউটিউব চ্যানেল থেকে নেওয়া
[publishpress_authors_box]

শীতের বাজারে আস্ত শিমের আশেপাশে দেখা যায় এক থালা তাজা শিমের বিচি স্তূপ হয়ে আছে। বাজার থেকে শিমের বিচি কিনে বাড়িতে মাছ, মাংস, সবজি মিশিয়ে রান্না করলেও অনেকের হয়তো জানা নেই চট্টগ্রামের ভাষায় শিমের বিচিকে খাইস্যা বলে। একেবারে চাটগাঁইয়া উচ্চারণে এর নাম ‘হাইস্যা’।

আসলে চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী ব্যঞ্জন হচ্ছে খাইস্যা। কুমিল্লা, নোয়াখালী জেলারও জনপ্রিয় রান্না খাইস্যা।  সিলেটে আবার শিমের বিচিকে ‘ফরাস শিম’ বলে। ‘কাঠুয়া শিম‘ বা  ‘ঝাড় শিম’ নামেও  আঞ্চলিক পরিচিতি আছে।

ইউনূসের প্রিয় খাবার খাইস্যা  

সোশাল মিডিয়াতে ছড়িয়ে পড়া এক ভিডিওতে দেখা যায় এক তরুণ ড. ইউনূসের কাছে জানতে চাইলেন, “চট্টগ্রামের কোন খাবার  মিস করেন?”

হেসে উঠে প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস বলেন, “শুটকি … শিমের বিচি দিয়ে শুটকি… শিমের বিচি বেগুন দিয়ে শুটকি।“   

এসব পদের মধ্যে কোনটি বেশি প্রিয়?

নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের হাটহাজারী এলাকায়।

এই কারণেই হয়তো প্রশ্নের উত্তরে কোনো পদের স্বাদ বাতিল করতে না পেরে তিনি বলেন, “সবগুলোই।”

খাইস্যা রান্না করবেন কীভাবে?

ছুরি বা লইট্যা শুটকি, জিওল, শোল, মাগুর মাছের সঙ্গে শিমের বিচি দিয়ে হাইস্যা হয়। আসলে শিমের বিচি দিয়ে তরকারি রান্না হবে তাই হাইস্যা। চিংড়ি মাছ রান্নায় এই শিমের বিচি যোগ করলে স্বাদ বেড়ে যাবে বহু গুণ। আবার অনেকে বলেন, শিমের বিচি দিয়ে মুরগি রান্না করলে স্বাদ লেগে থাকবে মুখে।

চট্টগ্রামে অনেকে এই রান্নায় সব উপকরণ এক সঙ্গে হাতে মেখে তারপর রান্নায় চাপিয়ে দেয়। আবার চট্টগ্রামেই অন্য এলাকার দিকে রান্নার ধরন খানিক পাল্টে যায়।

বেগুন- ছুরি শুটকি দিয়ে খাইস্যা

১টি বেগুন বড় টুকরা করে কেটে নিতে হবে। ১টি পেঁয়াজ ঝিরি ঝিরি কেটে রাখতে হবে। বেশি করে রসুন কুচি করে রাখতে হবে। ১টি ’হরো বাইউন‘ অর্থাৎ টমেটো টুকরা করে কেটে রাখতে হবে।  

এবার তেল গরম করে রসুন কুচি দিয়ে দিন। রসুন লাল করে ভাজতে হবে না; সুগন্ধ ছড়ানো পর্যন্ত ভাজতে হবে। পেঁয়াজ দিন কড়াইতে। হাটহাজারীর লাল মরিচ গুঁড়া ৩ চামচ, দেড় চামচ হলুদ গুঁড়া দিয়ে এবং এরপর হালকা পানি ছিটিয়ে মশলা ভুনা করে নিতে হবে। এ সময় লবণ দিতে হবে সামান্য।  টমেটো দিতে হবে মশলায়। মশলা ভুনা হলে আগে থেকে ধুয়ে কেটে রাখা ছুরি শুটকি দিয়ে দিতে হবে।

এক বাটি সবুজ শিমের বিচি দিতে হবে মশলা ভুনাতে। নাড়াচাড়া করে তারপর বেগুনের টুকরোগুলো মিশিয়ে দিতে হবে। স্বাদ অনুসারে লবণ মিশিয়ে নিন এবার। ঢাকনা দিয়ে কিছুক্ষণ জ্বাল দিতে হবে যেন বেগুন ও শিমের বিচি নরম হয়ে আসে। সিদ্ধ হয়ে এলে মাঝে চিরে দেওয়া কাঁচা মরিচ, ধনিয়া পাতা কুচি ছড়িয়ে দিতে হবে তরকারিতে।  

ছুরি শুটকি, বেগুন দিয়ে এই রান্নাকে চাটগাঁইয়া ভাষায় বলে ‘ছুরি উনি দি বাইউন দি টমেটো দি হাইস্যে’।

বেগুন আর শুটকি দিয়ে খাইস্যা রান্না প্রিয় পদ ড. ইউনূসের

লইট্টা দিয়ে খাইস্যা

লইট্টা শুটকি কেটে-ধুয়ে রাখতে হবে আগে।  চুলায় কড়াইতে তেল দিয়ে রসুন-পেঁয়াজ দিয়ে নেড়েচেড়ে তারপর শুটকি দিয়ে দিন।লাল মরিচ- হলুদ-ধনিয়া গুঁড়া এবং লবণ দিতে হবে। আদা-রসুন বাটা দিন। মশলা ও শুটকি কষিয়ে নিতে হবে মাঝে মাঝে পানি যোগ করে। শুটকি কষানো হলে কাঁচা শিমের বিচি দিতে হবে। বেগুন টুকরা দিন। তরকারি কষিয়ে নিতে হবে; যেন সব সিদ্ধ হয় কিন্তু গলে না যায়। সিদ্ধ হলে ঝোলের পানি দিতে হবে। কাঁচা মরিচ ফালি ছড়িয়ে ঢাকনা দিয়ে রাখতে হবে। মিনিট দশেক পর ঢাকনা তুলে হালকা হাতে নাড়তে হবে। এখন টমেটো টুকরা দিয়ে আরও মিনিট পাঁচেক রান্না করতে হবে। সবশেষে ধনিয়া পাতা ছড়িয়ে দিতে হবে।      

শিমের বিচি দিয়ে রুই মাছের মাথাও রান্না করা হয়।  আবার মাছ না দিয়েও কাঁচা শিমের বিচি ভুনা করা যায়। অনেকে একে শিমের বিচির ডাল বলে।

আগে সিদ্ধ না করে কাঁচা শিমের বিচির খোসা ছাড়িয়ে তারপর ডাল রান্না করলে স্বাদ বেশি হয়। খোসা ছাড়ানো শিমের বিচি ধুয়ে নিয়ে প্যানে দিতে হবে। তিন কাপ পানি দিতে হবে। ৪-৫টি কাঁচা মরিচ কুচি, ১টি পেঁয়াজ কুচি, ১টি রসুন কুচি, ১ চা চামচ হলুদ গুঁড়া, স্বাদমতো লবণ দিতে হবে। ঢাকনা দিয়ে মাঝারি আঁচে শিমের বিচি সিদ্ধ করতে হবে।  তারপর ডাল ঘুটনি দিয়ে ঘুঁটে দিতে হবে।

আলাদা এক প্যানে ডালের বাগাড় তৈরি করতে হবে। তেলে ২টি আস্ত শুকনা মরিচ. ১ চা চামচ আস্ত জিরা, রসুন কুচি, পেঁয়াজ কুচি দিয়ে নাড়তে হবে বাদামি রঙ আসা পর্যন্ত। এই ফোঁড়ন ডালে ঢেলে দিতে হবে। বাগাড় ঢেলে দেওয়ার পর ডাল নেড়েচেড়ে নিতে হবে। এবার ধনিয়া পাতা মিশিয়ে চুলার আঁচ বন্ধ করে দিতে হবে।  

খাইস্যা খাওয়ার পুষ্টিগুণ

এক ধরনের মটরশুঁটি বীজকে হিন্দিতে রাজমা বলে। ভারতে পাঞ্জাবি-মারোয়াড়িদের মাঝে রাজমা খাওয়ার চল বেশি।মেক্সিকোতে জনপ্রিয় এই শিম জাতীয় উদ্ভিদের বিচি ইংরেজিতে কিডনি বিন নামে বেশ চেনা সবার কাছে। এই বীজটি দেখতে বৃক্ক বা কিডনি আকারের হয় বলেই এমন নাম। দেশে বিক্রেতাদের অনেকে এই কিডনি বিনকেও ’হাইস্যা ডাল’ বলে থাকেন।

মটরশুঁটি ও শিম জাতীয় বীজ মানেই হচ্ছে আঁশ ভরপুর খাবার এবং উদ্ভিজ্জ প্রোটিনের ভালো উৎস।

শিমের বিচি খাইস্যাতে আছে আয়রন যা শরীরে লোহিত কণিকার পরিমাণ বাড়ায়।

১০০ গ্রাম গরুর মাংসে প্রোটিন আছে ২২.৬ গ্রাম। সমপরিমাণ শিমের বিচিতে প্রোটিন  পাওয়া যায় আরেকটু বেশি; ২৪.৯ গ্রাম।

ভেজিটেবল প্রোটিন সমৃদ্ধ এই খাবার শরীরের মাংসপেশি পোক্ত রাখে।

ভেজিটেরিয়ান হলে অর্থ্যাৎ যারা মাছ, মাংস, ডিম, দুধ খান না তাদের প্রোটিনের চাহিদা পূরণ করবে শিমের বিচি।

বয়স বাড়লে, বিশেষ করে মেনোপজের সময় নারীর অস্টিওপোরোসিস হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যায়। শিমের বিচিতে থাকা ক্যালসিয়াম হাড়কে মজবুত করে তাই নারীর স্বাস্থ্যে খাইস্যা উপকারী।

শিমের বিচি খাওয়ার অভ্যাসে ত্বক ভালো থাকে এবং সহজে বলিরেখা দেখা দেয় না।  

ছবি: ‘শারিন ইন দ্যা কিচেন’ ইউটিউব চ্যানেল থেকে নেওয়া

সারা বছর শিমের বিচি?

শীত ছাড়া শিমের বিচি বাজারে না উঠলেও অনেকে সংরক্ষণ করে রাখেন। সারারাত শিমের বিচি ভিজিয়ে খোসা ছাড়িয়ে নিতে হয়। চুলায় পাতিলে পানিতে শিমের বিচি দিয়ে একটি বলক আসা পর্যন্ত সিদ্ধ করে নিতে হবে। শিমের বিচি পানি থেকে ছেঁকে নিয়ে ঠান্ডা পানিতে ধুয়ে নিতে হবে। শিমের বিচি স্বাভাবিক তাপমাত্রা এলে একটি এয়ার টাইট বক্স বা ব্যাগে ভরে ডিপ ফ্রিজে রেখে দিতে হবে। এরপর দরকার মতো শিমের বিচি বার করে রান্না করা যাবে। এভাবে সংরক্ষণ করলে প্রায় বছর জুড়ে শিমের বিচি খাওয়া যাবে।

কারা খাইস্যা খাবেন না

যারা এরমধ্যে কিডনির কোনো সমস্যায় ভুগছেন তাদের শিমের বিচি খাওয়া ঠিক হবে না।  এছাড়া ইউরিক অ্যাসিড বেশি থাকলেও এড়াতে হবে খাইস্যা। যাদের পিত্তথলিতে পাথর আছে তারাও শিমের বিচি খাবেন না।

আর যাদের গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা আছে, তারা শারীরিক অবস্থা বুঝে মাঝে মাঝে এবং অল্প পরিমাণে খাইস্যা খেতে পারেন।

মোট কথা এসব রোগে যারা ভুগছেন তারা সচেতন থাকবেন এবং চিকিৎসকের সঙ্গেও কথা বলে নেবেন।  

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত