ফরেনসিক বিজ্ঞান ও আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে ৫০০ বছরের পুরনো একটি বিতর্কের অবসান ঘটতে চলেছে। দুই দশকের বেশি সময় ধরে গবেষণা শেষে বিজ্ঞানীরা উপসংহারে পৌঁছেছেন ১৫ শতকের বিখ্যাত সমুদ্র অভিযাত্রী ক্রিস্টোফার কলম্বাস সম্ভবত স্প্যানিশ ইহুদি ছিলেন।
প্রায় ২২ বছর ধরে কলম্বাসের দেহাবশেষের জেনেটিক অনুসন্ধানের পর এই উপসংহার প্রচলিত ঐতিহাসিক জ্ঞানকে ঘুরিয়ে দিয়েছে।
আগে ধারণা করা হতো, কলম্বাস ইতালির জেনোয়ার বাসিন্দা এবং ক্যাথলিক খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী ছিলেন। এখন বিজ্ঞানীদের দৃঢ় বিশ্বাস, কলম্বাস স্পেনের ভ্যালেন্সিয়া শহরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
এখন বিজ্ঞানীরা বলছেন, যার দুঃসাহসিক অভিযাত্রা বৈশ্বিক ইতিহাসের গতিপথ বদলে দিয়েছিল, তিনি ইতালির জেনোয়ার সন্তান নন, বরং একজন স্প্যানিশ ইহুদি।
এই দাবিটি যথেষ্ট কৌতূহলের উদ্রেক ঘটায় এই কারণে যে আমেরিকায় স্পেনের শক্তিশালী সাম্রাজ্য সৃষ্টিতে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালনকারী কলম্বাস সেই সম্প্রদায়ের লোক ছিলেন, যাদের তার পৃষ্ঠপোষক রাজা ফার্দিনান্দ ও রানি ইসাবেলা স্পেন থেকে বহিষ্কার করেছিলেন।
১৪৯২ সালে ইহুদিদের স্পেন থেকে বহিষ্কার করা হয়, আর সেই একই বছরে কলম্বাসও আমেরিকা আবিষ্কার করেন।
গবেষণার ফলাফলটি গত ১২ অক্টোবর রাতে স্পেনের জাতীয় সম্প্রচারক আরটিভিই-তে প্রচার করা হয়। সেদিন ছিল স্পেনের জাতীয় দিবস। ১৪৯২ সালের এই দিনেই কলম্বাস আমেরিকায় পা রাখেন। ‘কলম্বাস ডিএনএ : হিজ ট্রু অরিজিন’ নামের একটি তথ্যচিত্রে বিষয়টি তুলে ধরা হয়।
গবেষণার নেতৃত্ব দেওয়া গ্রানাডা ইউনিভার্সিটির ফরেনসিক চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ হোসে আন্তোনিও লরেন্তে বলেন, বিশ্লেষণে তারা দেখতে পেয়েছেন যে কলম্বাসের ডিএনএ ইহুদি উৎসের সঙ্গে ‘সামঞ্জস্যপূর্ণ’।
তিনি বলেন, “আমাদের কাছে ক্রিস্টোফার কলম্বাসের সামান্য, তবে পর্যাপ্ত পরিমাণে ডিএনএ আছে। আমাদের কাছে তার ছেলে ফার্নান্দো কোলনের ডিএনএও আছে। আর ফার্নান্দোর ওয়াই [পুরুষ] ক্রোমোজোম এবং মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ [মা থেকে আসা] উভয়েরই ইহুদি উৎসের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে।”
তবে লরেন্তে স্বীকার করেছেন যে, তিনি কলম্বাসের জন্মস্থান পুরোপুরি নিশ্চিতভাবে চিহ্নিত করতে সক্ষম হননি। তার ধারণা, কলম্বাস সম্ভবত স্প্যানিশ ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল থেকে এসেছেন।
এই গবেষক বলেন, “ডিএনএ নির্দেশ করে যে ক্রিস্টোফার কলম্বাসের জন্মস্থান পশ্চিম ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে ছিল। ১৫ শতকে জেনোয়াতে যদি ইহুদি না থাকে, তাহলে তার সেখান থেকে আসার সম্ভাবনা খুবই কম। ইতালীয় উপদ্বীপের বাকি অংশেও ইহুদিদের বড় কোনও উপস্থিতি ছিল না। ফলে তার ইতালি থেকে আসার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।”
লরেন্তে বলেন, কলম্বাস ফরাসি হতে পারেন সে ব্যাপারেও কোনও দৃঢ় তত্ত্ব বা স্পষ্ট ইঙ্গিত নেই, ফলে অনুসন্ধানের ক্ষেত্রটি আরও সংকুচিত হয়ে আসে।
“ফলে বাকি থাকে স্প্যানিশ ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল, বালিয়ারিক দ্বীপপুঞ্জ এবং সিসিলি। তবে তার জন্মস্থান সিসিলি হওয়ার সম্ভাবনাও নেই। কারণ তাহলে তার লেখায় ইতালীয় বা সিসিলিয়ান ভাষার কিছু প্রভাব থাকত। এর মানে হল যে, তার সম্ভাব্য জন্মস্থান স্প্যানিশ ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে বা সেই সময়ে আরাগন রাজতন্ত্রের অন্তর্গত বালিয়ারিক দ্বীপপুঞ্জে।”
আরটিভিই-র মতে, লরেন্তের অনুসন্ধান কলম্বাসের জন্মস্থান এবং জাতীয়তা নিয়ে প্রায় ৫০০ বছরের জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়েছে।
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ধারণা করা হয়ে আসছে, এই সমুদ্র অভিযাত্রী, জেনোয়ান, বাস্ক, কাতালান, গ্যালিসিয়ান, গ্রিক, পর্তুগিজ বা স্কটিশ হতে পারেন। ২৫টি সম্ভাব্য স্থান বিশ্লেষণ করার পর ৮টির একটি সংক্ষিপ্ত তালিকায় ফোকাস করে লরেন্তে অবেশেষে পশ্চিম ইউরোপে এসে থামলেন।
তবে লরেন্তের এই ইতিহাস-পরিবর্তন করা উপসংহারকে তার কিছু সহকর্মী স্বাগত জানিয়েছেন সতর্কতার সঙ্গে।
স্পেনের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ টক্সিকোলজি অ্যান্ড ফরেনসিক সায়েন্সেস-এর একজন জিনতত্ত্ববিদ এবং সাবেক পরিচালক আন্তোনিও আলোনসো বলেন, “দুর্ভাগ্যবশত, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে ডকুমেন্টারিটিতে কী ছিল, তা আমরা সত্যিই মূল্যায়ন করতে পারি না। কারণ এতে তারা বিশ্লেষণ থেকে কোনও তথ্য দেননি।”
তিনি বলেন, “আমার উপসংহার হল যে, ডকুমেন্টারিটিতে কলম্বাসের ডিএনএ দেখানো হয়নি এবং বিজ্ঞানী হিসাবে, আমরা জানি না কী বিশ্লেষণ করা হয়েছিল।”
ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর ইভোল্যুশনারি অ্যানথ্রোপলজির আর্কিওজেনেটিক্স বিশেষজ্ঞ রদ্রিগো বারকেরা বলেছেন, অন্য বিজ্ঞানীদের মাধ্যমে যাচাই-বাছাই ছাড়াই ফলাফলগুলো প্রকাশ করায় তিনি অবাক হয়েছিলেন।
তিনি বলেন, “সাধারণত, কোনও গবেষণার পর এর ফলাফল সংক্রান্ত নিবন্ধটি একটি বৈজ্ঞানিক জার্নালে পাঠাতে হয়। এরপর একজন সম্পাদককে সেটি দেখার জন্য নিয়োগ করা হয় এবং কমপক্ষে তিনজন স্বাধীন পর্যালোচক কাজটি পরীক্ষা করেন এবং সিদ্ধান্ত নেন যে সেটি বৈজ্ঞানিকভাবে ঠিক আছে কি না?
“যদি ঠিক থাকে তখন সেটি প্রকাশিত হয় এবং বাকি বৈজ্ঞানিকরা বলতে পারেন যে, তারা এর সঙ্গে একমত কি না? কিন্তু সেই প্রক্রিয়ায় না গিয়ে সরাসরি টিভিতে প্রচার এবং এই সমস্ত মিডিয়া ফোকাসের ফলে বৈজ্ঞানিকরা এটি সম্পর্কে কিছু বলতে পারছে না।”
তবে লরেন্তে বলেন, “আমাদের টিম এবং বিশ্ববিদ্যালয় সর্বদা ক্রিস্টোফার কলম্বাস এবং তার পরিবার নিয়ে এই গবেষণাটিকে একটি একক, যুক্ত এবং অবিচ্ছেদ্য ইউনিট হিসাবে বিবেচনা করেছে এবং অনুসন্ধান প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত কিছুই প্রকাশ করা হয়নি।”
কলম্বাসের দেহাবশেষ কোথায় ছিল, তা নিয়েও ইতিহাসবিদদের মধ্যে বিতর্ক ছিল। তবে এবার সেই বিতর্কেরও অবসান ঘটেছে। তার দেহাবশেষ স্পেনের ক্যাথেড্রাল অব সেভিয়ায়ই রয়েছে। স্পেনের এই ক্যাথেড্রালেই রয়েছে ক্রিস্টোফার কলম্বাসের ভাই এবং ছেলের সমাধি।
গত বৃহস্পতিবার লরেন্তে এবং তার দল বলেছে, কলম্বাস, তার ছেলে ফার্নান্দো এবং তার ভাই দিয়েগোর দেহাবশেষের ডিএনএ বিশ্লেষণ ‘নিশ্চিতভাবে নিশ্চিত করেছে’ যে সেভিয়া ক্যাথেড্রালের একটি সমাধিতে রাখা আংশিক কঙ্কালটি বিখ্যাত অভিযাত্রী কলম্বাসেরই।
কলম্বাস ১৫০৬ সালে স্পেনীয় শহর ভ্যালাদোলিদে মারা গেলেও তিনি হিস্পানিওলা দ্বীপে সমাহিত হতে চেয়েছিলেন, যা আজ হাইতি এবং ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্রে বিভক্ত। ১৫৪২ সালে তার দেহাবশেষ সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৭৯৫ সালে তার সমাধি স্থানান্তরিত হয় কিউবায়। তবে ১৮৯৮ সালে তার দেহাবশেষ সেভিয়ায় আনা হয়, যখন আমেরিকার সঙ্গে যুদ্ধের পরে কিউবার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিল স্পেন।
কলম্বাস যদি একজন সেফার্ডিক ইহুদি হয়ে থাকেন— সেফরাড হল আইবেরিয়ান উপদ্বীপের হিব্রু নাম— তাহলে তার পরিচয় হবে একটি উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক পরিহাস, যা তিনি সমাজ ও তার রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকদের কাছ থেকে গোপন করেছেন।
১৪৯২ সালে স্পেনের রাজা-রানি সকল ইহুদি এবং মুসলিমদের ক্যাথলিক খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত হওয়া, নয়ত দেশ ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ধারণা করা হয়, এই ধর্মীয় নিপীড়ন থেকে বাঁচতে কলম্বাস তার আসল ধর্ম পরিচয় লুকিয়েছিলেন।
অথচ তার আমেরিকা আবিষ্কারের ফলেই স্পেনের চকচকে সমৃদ্ধ এবং শক্তিশালী আমেরিকান সাম্রাজ্য স্থাপনের পথ খুলে গিয়েছিল। যেই রাজা ফার্দিনান্দ ও ইসাবেলা ইহুদিদের বহিষ্কার করেছিলেন, তারাই কলম্বাসকে সমুদ্রযাত্রায় পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন।
২০১৫ সালে স্পেন ইহুদিদের সেই বহিষ্কারকে ‘একটি ঐতিহাসিক ভুল’ বলে অভিহিত করে এর জন্য প্রায়শ্চিত্ত করতে চায়। এজন্য ১৫ শতকের শেষের দিকে দেশ থেকে বিতাড়িত ইহুদিদের বংশধরদের স্পেনীয় নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্য সীমিত সময়ের জন্য একটি আইন পাস করে।
২০১৯ সালের অক্টোবরে আইনটির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে প্রায় ১ লাখ ৩২ হাজার জন সেফার্ডিক বংশোদ্ভূত ইহুদি ম্পেনে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেছিলেন। যারা আবেদন করেছিলেন তাদের অর্ধেকেরও বেশি মেক্সিকো, কলম্বিয়া, ভেনিজুয়েলা, আর্জেন্টিনা, পেরু, পানামা, চিলি ও ইকুয়েডরসহ ল্যাতিন আমেরিকার দেশগুলো থেকে এসেছে।
তথ্যসূত্র : দ্য গার্ডিয়ান