টেলিভিশন পর্দায় অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, এ যেন ‘অ্যান ইভিনিং ইন প্যারিস’ শো। ১৯৬৭ সালে নির্মিত শর্মিলা ঠাকুর ও শাম্মী কাপুরের বিখ্যাত সিনেমাটি যেন প্যারিসের সেইন নদীর পাড়ে বসে মুগ্ধ হয়ে দেখছিলেন দর্শকেরা।
লেডি গাগা। জিনেদিন জিদান। গ্রেট ব্রিটেনের দুই পতাকাবাহক ডাইভার টম ডালে এবং রোয়ার হেলেন গ্লোবারের টাইটানিকের সেই বিখ্যাত পোজের স্মৃতি ফিরিয়ে আনা। ফরাসি বিপ্লবকে শ্রদ্ধা জানানো। আইফেল টাওয়ারের মনকাড়া লেজার শো। ল্যু ভর মিউজিয়াম থেকে মোনালিসাকে নামিয়ে এনে দর্শকের আসনে বসিয়ে দেওয়া। এসব দেখতে দেখতে যে কারো মনে হতে পারে, সবকিছু যেন সিনেমার মতো লাগছে।
প্যারিসে এই অলিম্পিক আয়োজন সিনেমা না হলেও, অলিম্পিক গেমস নিয়ে বড় পর্দায় এসেছে অনেক সিনেমা। অলিম্পিকের ফাঁকে এসব সিনেমাও দেখে নিতে পারেন।
অলিম্পিক গেমস নিয়ে বানানো অনেক দারুণ সিনেমার একটি হচ্ছে ‘চ্যারিওটস অব ফায়ার’। এই সিনেমার গল্প দুই ব্রিটিশ অ্যাথলেট হ্যারল্ড আব্রাহাম ও এরিক লিডেলকে নিয়ে। ধর্মপ্রাণ এরিক লিডেল ১৯২৪ সালের প্যারিস অলিম্পিকের জন্য প্রস্তুতি নিয়েও শেষ পর্যন্ত খেলতে অস্বীকৃতি জানান। ১০০ মিটার স্প্রিন্ট হওয়ার কথা ছিল রবিবার। ওই দিন খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারী লিডেল চার্চে ধর্মীয় আচার পালনের জন্য অ্যাথলেটিকস ট্র্যাকে নামতেই রাজি হননি। এমনকি তখনকার প্রিন্স অব ওয়েলস এবং ব্রিটিশ অলিম্পিক কমিটির শত অনুরোধও মন গলাতে পারেনি লিডেলের। তিনি রবিবার ব্যস্ত হয়ে পড়েন প্যারিসের একটি চার্চে ধর্মীয় বক্তৃতা দিতে। পরে অবশ্য ৪০০ মিটারে সোনা জয় করেন লিডেল। ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৮১ সালে। চারটি বিভাগে জিতেছিল অস্কার পুরস্কার।
অলিম্পিক গেমস নিয়ে ২০২৩ সালে নির্মিত হয় ‘দ্য বয়েস ইন দ্য বোট’। অলিম্পিকে সোনার পদক জেতার পেছনে একটা দেশের কতটা লড়াই-সংগ্রাম আর কত ছোট ছোট না বলা গল্প লুকিয়ে থাকে, তা এই সিনেমা না দেখলে বোঝা যাবে না।
সিনেমার শুরুটা হয় যুক্তরাষ্ট্রে রোয়িং খেলোয়াড় জোশেফ হ্যারি রানজের শেষ বয়সের একটি দৃশ্য দিয়ে । যেখানে তিনি একটি নদীর তীরে বসে আছেন। আর তার নাতি সেই নদীতে নৌকা চালানো শিখছে। আর সেটা দেখতে দেখতেই পেছনে ফিরে যান রানজ। ফিরে যান নিজের শৈশবে। যখন তার কোনও থাকার জায়গা ছিল না। একটা পরিত্যক্ত গাড়ির মধ্যে থাকতেন। ভালো জুতো কেনার টাকা ছিল না বলে জুতোর তলানির ফুটো কাগজ দিয়ে ভরে রাখতেন। কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি। হার মানেননি। এটাই জীবন ভেবে তিনি এমন কিছু করে ফেলেন যাতে তার নাম শুধু যুক্তরাষ্ট্রে নয় সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।
টাকার অভাবে যখন রানজ কলেজের ফি দিতে পারছিলেন না তখন তিনি কাজ খুঁজতে খুঁজতে ঘটনাচক্রে রোয়িং দলের ক্রুয়ের (নৌকাবাহক) কাজ নেন। কিন্তু দলটির কোচ এক সময় বুঝতে পারেন তাদের দলটা যুক্তরাষ্ট্র জাতীয় দলের চেয়েও সেরা। তাইতো সবার অমতে সেই জুনিয়র দলটিকেই ১৯৩৬ বার্লিন অলিম্পিকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন কোচ। কোচের সিদ্ধান্ত যে ভুল ছিল না সেটা শেষ পর্যন্ত প্রমাণ করেন রানজ ও তার দল অলিম্পিকে সোনা জিতে। এটা সত্যি- মাত্র কয়েক মিনিটের গল্পে এই সিনেমার মাহাত্ম্য বোঝা কঠিন। কিন্তু অলিম্পিকে সোনা জেতার জন্য রানজসহ যুক্তরাষ্ট্রের রোয়িং দলের যে চড়াই উতরাই পার হতে হয়েছে, সেটাই সিনেমার পরতে পরতে দেখানো হয়ছে।
অলিম্পিক-ভিত্তিক ২০০৪ সালের আরেক সাড়া জাগানো সিনেমা ’মিরাকেল’। এই সিনেমার পটভূমি ১৯৮০ সালের মস্কো অলিম্পিকের। তখন ছেলেদের আইস হকিতে ফেবারিট যুক্তরাষ্ট্র। সেই যুক্তরাষ্ট্রকেই কিনা ঘোল খাইয়ে ছাড়ল সোভিয়েত ইউনিয়ন; জিতে গেলো অলিম্পিকের সোনা।
এই অবিশ্বাস্য ঘটনা কীভাবে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠেছিল, সেই গল্প নিয়েই তৈরি হয় মিরাকল। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের মুখোমুখি হওয়ার আগে ওই সোভিয়েত ইউনিয়ন দলটি জিতে এসেছিল টানা ৪২টি ম্যাচ। সিনেমাটির নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন কার্ট রাসেল, দলের কোচ হার্ব ব্রুকসের চরিত্রে।
এর মধ্যে বেশ কয়েকটি উপভোগ্য সিনেমা-ইন্টারন্যাশনাল ভেলভেট, চ্যারিওটস অব ফায়ার, মিউনিখ, প্রিফন্টেইন, দ্য কাটিং এজ, ব্লেডস অব গ্লোরি, উইথআউট লিমিটস, পারসোনাল বেস্ট, কুল রানিংস ও ইট হ্যাপেনড ইন এথেন্স।
সাদাকালো যুগের সিনেমাগুলোর মধ্যে রয়েছে নাইন অ্যান্ড থ্রি ফিফথস সেকেন্ডস, মিলিয়ন ডলার লেগস, এ মিলিয়ন টু ওয়ান, জিম থর্প অল আমেরিকান।
‘ইন্টারন্যাশনাল ভেলভেট’ সিনেমায় দেখা গেছে একজন সারা ব্রাউনের অলিম্পিকে সোনা জয়ের গল্প। সড়ক দুর্ঘটনায় বাবা মা দুজনকেই হারিয়ে বড় বিপাকে পড়েছিল শিশু ব্রাউন। ঠিক তখনই ত্রাতা হয়ে আসেন খালা ভেলভেট ব্রাউন ও খালু জন। যুক্তরাষ্ট্র থেকে সারাকে ইংল্যান্ডে নিয়ে এলেন ভেলভেট। সারাকে কিনে দেন একটা ছোটখাটো ঘোড়া। দ্য পাই নামের ঘোড়াটিকে সারা ডাকতো আরিজেনো পাই বলে। তো সেই পাইকে নিয়েই সারাদিন খেলতো সারা। খেলতে খেলতেই সুযোগ পেল ব্রিটিশ অলিম্পিক দলে। স্বপ্ন দেখত একদিন অলিম্পিকে সোনা জিতবে সারা। পুরো অলিম্পিক দলে সারাই ছিল সবচেয়ে ছোট। তাই একটু বাড়তি আদরই পেত কোচ ক্যাপ্টেন জনসনের কাছে। তিন দিনের ইভেন্টে শেষ পর্যন্ত গ্রেট বৃটেনের হয়ে সোনা জিতল সারা। কিন্তু এক পর্যায়ে আমেরিকান প্রতিযোগির সঙ্গে গড়ে ওঠে ভালোবাসার সর্ম্পক। এবং তার সঙ্গেই ফিরে যায় যুক্তরাষ্ট্র। যাওয়ার আগে তার সোনার পদকটা দিয়ে যায় খালাকে। তবে যাওয়ার আগে খালার সঙ্গে ভালোবাসার মানুষটিকে এভাবে পরিচয় করে দেয়, “স্কট, আমি তোমাকে আমার মা-বাবার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়ে দিতে চাই।”
১৯৭২ সালে মিউনিখ অলিম্পিকে ইসরায়েলি অ্যাথলেটদের ওপর হামলা চালানো হয়েছিল। সেই মৃত্যুর প্রতিশোধের কাহিনী নিয়েই ২০০৫ সালের সিনেমা ‘মিউনিখ’।
একই বছরের আরেকটি ঘটনা নিয়ে ১৯৯৭ সালে মুক্তি পায় ‘প্রিফন্টেইন’ সিনেমাটি। অলিম্পিক শুরুর আগে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করা প্রিফন্টেইন ভালোবাসতেন মেয়েদের।ভালোবাসতেন পার্টি। কিন্তু এসবই কাল হয় তার, অলিম্পিকে গিয়ে হলেন চতুর্থ। তিন বছর পর অবশ্য এক গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যান ২৪ বছর বয়সী এই অলিম্পিয়ান। তাকে ঘিরেই এগিয়ে চলে কাহিনী।
এছাড়া সমকামী মহিলা অ্যাথলেটদের গল্প নিয়ে ১৯৮২ সালে বড় পর্দায় আসে ‘পারসোনাল বেস্ট’।
শুধু হলিউড নয়, বলিউডেও অলিম্পিক গেমস নিয়ে সিনেমা হয়েছে ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উঠে আসা অলিম্পিক পদকজয়ীদের গল্প নিয়ে।
এদের মধ্যে অন্যতম সিনেমা ‘গোল্ড’। ১৯৪৮ সালের অলিম্পিক গেমসে গ্রেট ব্রিটেনকে হারিয়ে স্বাধীন ভারতের প্রথম সোনার পদক জেতেন তপন দাস। তার জীবনের না বলা, অজানা গল্প বলে এই ছবি। ভারতের প্রথম জাতীয় হকি দলের সহকারী ম্যানেজার ছিলেন তিনি। এই চরিত্রে ছবিতে অভিনয় করেছিলেন অক্ষয় কুমার। রিমা কাগতি পরিচালিত এই ছবিতে অভিনয় করেছিলেন কুণাল কপূর, মৌনী রায়, সানি সিংহ প্রমুখ। সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছিল ২০১৮ সালে।
অলিম্পিক গেমস নিয়ে আরেকটি অসাধারণ সিনেমা ‘ভাগ মিলখা ভাগ’। ভারতীয়দের প্রিয় ‘ফ্লাইং শিখ’কে নিয়ে আবর্তিত গল্পটি। মিলখা সিংয়ের আত্মজীবনীমূলক এই ছবিতে নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন ফারহান আখতার। আর্থিক ও সামাজিক বাধা ও সমস্যা সত্ত্বেও মিলখা সিংয়ের বিশ্ববিখ্যাত স্প্রিন্টার ও অলিম্পিয়ান হয়ে ওঠার সফরের গল্প ঘিরেই তৈরি হয়েছে সিনেমা। রাকেশ ওমপ্রকাশ মেহরা পরিচালিত এই ছবি বিপুল সাড়া পায় দর্শকদের থেকে। ছবিতে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন সোনম কাপুর।
অলিম্পিক গেমস নিয়ে আরেকটি অসাধারণ সিনেমা ‘মেরি কম’। ওমুং কুমার পরিচালিত এই ছবির মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন প্রিয়াঙ্কা চোপড়া। মণিপুরের বাসিন্দা বক্সিং চ্যাম্পিয়ন মেরি কমের গল্প নিয়ে এই ছবি। তাঁর কুস্তিগির বাবা ও গোটা সমাজের বিরুদ্ধে গিয়ে মেরি কম জিতেছিলেন ২০১২ লন্ডন অলিম্পিকে ব্রোঞ্জ। ছবিতে অন্যতম মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন দর্শন কুমার। ২০১৪ সালে নির্মিত হয়েছিল এই সিনেমাটি।
মেরি কমের মতোই অলিম্পিক গেমস নিয়ে তৈরি সিনেমা ‘সাইনা’। এই ছবি অলিম্পিক পদকজয়ী শাটলার সাইনা নেহওয়ালের জীবনের ওপর ভিত্তি করে তৈরি। মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন অভিনেত্রী পরিণীতি চোপড়া। আমোল গুপ্তে পরিচালিত এই ছবি দেখায় প্রথম ভারতীয় ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড়ের অলিম্পিক পদক জয়ের গল্প। সাইনা ২০১২ লন্ডন অলিম্পিকে ব্রোঞ্জ জেতেন। আর সিনেমাটা তৈরি হয় ২০২১ সালে।
‘সুলতান’ যদিও সত্যি ঘটনা নিয়ে তৈরি কোনও সিনেমা না। কিন্তু কীভাবে ভারতীয় কুস্তিগিরেরা সব বাধা বিপত্তি পেরিয়ে অলিম্পিক গেমসসহ বড় বড় প্রতিযোগিতায় অংশ নেন, সেই গল্প বলে ‘সুলতান’।
আলি আব্বাস জাফর পরিচালিত এই ছবিতে নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন বলিউড তারকা সালমান খান। তার বিপরীতে ছিলেন আনুশকা শর্মা। বক্স অফিসে ব্লকবাস্টার হয় এই ছবি। সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছিল ২০১৬ সালে।
প্যারিসে এই মুহূর্তে চলছে দি গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ- অলিম্পিক গেমস। প্যারিস যেতে পারেন আর নাই পারেন, অলিম্পিকের কিছু সিনেমা না হয় সঙ্গী হোক আপনার অবসরের।