Beta
শনিবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
Beta
শনিবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

সাক্ষাৎকার

রাষ্ট্র সংস্কারের আগে প্রয়োজন নাগরিকদের আস্থা ফিরিয়ে আনা

তানজীমউদ্দিন খান

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের অন্যতম নেতা অধ্যাপক মো. তানজীমউদ্দিন খান মনে করেন রাষ্ট্র সংস্কারের আগে অন্তর্বর্তী সরকারকে নাগরিকদের আস্থা অর্জন করতে হবে। কিন্তু অন্তর্বতী সরকার যে ভিন্ন উদাহরণ তৈরি করছে তেমন কোনও নজির এখনও দেখা যাচ্ছে না বলেও মন্তব্য করেছেন এই অধ্যাপক। দীর্ঘদিন ধরে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিপীড়নবিরোধী আন্দোলন এবং শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের স্বার্থরক্ষার আন্দোলনে সক্রিয় এই অধ্যাপক জুলাই-আগস্টের ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানেও সাহসী ভূমিকা রেখেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজীমউদ্দিন খানের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সকাল সন্ধ্যার প্রতিবেদক অনিক রায়

রাষ্ট্র সংস্কারের আগে প্রয়োজন নাগরিকদের আস্থা ফিরিয়ে আনা

তানজীমউদ্দিন খান

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের অন্যতম নেতা অধ্যাপক মো. তানজীমউদ্দিন খান মনে করেন রাষ্ট্র সংস্কারের আগে অন্তর্বর্তী সরকারকে নাগরিকদের আস্থা অর্জন করতে হবে। কিন্তু অন্তর্বতী সরকার যে ভিন্ন উদাহরণ তৈরি করছে তেমন কোনও নজির এখনও দেখা যাচ্ছে না বলেও মন্তব্য করেছেন এই অধ্যাপক। দীর্ঘদিন ধরে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিপীড়নবিরোধী আন্দোলন এবং শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের স্বার্থরক্ষার আন্দোলনে সক্রিয় এই অধ্যাপক জুলাই-আগস্টের ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানেও সাহসী ভূমিকা রেখেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজীমউদ্দিন খানের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সকাল সন্ধ্যার প্রতিবেদক অনিক রায়

সকাল সন্ধ্যা: কখন এবং কোন পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক আন্দোলনে সরাসরি ভূমিকা রাখার কথা চিন্তা করল?

তানজীমউদ্দিন খান: ‘শিক্ষক নেটওয়ার্ক’ ধারাবাহিকভাবেই ভূমিকা রেখে আসছে। ২০১৩ সালে আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের কাজ শুরু করি তখন এটা শুধু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ছিল। পরে এর ব্যাপ্তি বেড়েছে, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও এতে যুক্ত হয়েছেন। সাধারণত শিক্ষার্থীদের উপর যখনই নিপীড়নের ঘটনা ঘটে তখনই আমরা পাশে দাঁড়াই। এবং এবারও তাই হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যখন মারধরের শিকার হলো তখনই আমরা পাশে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিই। যেদিন হল ভ্যাকেন্ট ডিক্লেয়ার হলো সেদিন আমরা কর্মসূচি পালন করি। থানায় গিয়ে আমাদের কিছু আটক শিক্ষার্থীকেও মুক্ত করি। আমাদের নিপীড়ন বিরোধী অবস্থান থেকেই আমরা শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। এটা আমাদের জন্য নতুন কোনও কিছু না। স্বাভাবিকভাবে সবসময় এটা আমরা করে আসছি। কোন সরকার ক্ষমতায় আছে তা আমাদের বিবেচ্য না। আমাদের মূল লক্ষ্য শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের স্বার্থ সুরক্ষা বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে।

সকাল সন্ধ্যা: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক কোন পদ্ধতি অনুসরণ করে সাংগঠনিক কাজ করে?

তানজীমউদ্দিন খান: আমাদের সাংগঠিনক ফরমেটটা একটু শিথিল। কারও কোনও পদ-পদবি নেই। আমরা যখন তাগিদ অনুভব করি নিজেদের ভিতর যোগাযোগ করি। আমাদের হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপ আছে, আমাদের ফেইসবুক গ্রুপ আছে। মূলত ফেইসবুক গ্রুপে কেউ লিখে কোনও একটা বিষয়ে আমাদের কিছু করার আছে কিনা। তখন আমরা নিজেরা নিজেরা মতামত দেই এ বিষয়ে কি করা উচিত বা করা উচিত না। আমরা সবাই যখন একমত হই তখনই আমরা কাজ করি।

আমাদের সদস্য সংখ্যা সুনির্দিষ্ট না। আমাদের সাংগঠনিক কাঠামো ঢিলেঢালা। যে কেউ এসে এখানে যুক্ত হতে পারে। গিভেন যে তারা ‘সনাতনী রাজনীতির’ নয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেমন সনাতনী রাজনীতিতে ‘সাদা’ ‘নীল’ বা অন্য কোনও দলের— সরকারের পক্ষ কিংবা বিপক্ষ; এর বাইরে যারা আছেন তারাই আমাদের সদস্য হতে পারেন।

আমাদের সদস্য সংখ্যা সুনির্দিষ্ট না। আমাদের সাংগঠনিক কাঠামো ঢিলেঢালা। যে কেউ এসে এখানে যুক্ত হতে পারে। গিভেন যে তারা ‘সনাতনী রাজনীতির’ নয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেমন সনাতনী রাজনীতিতে ‘সাদা’ ‘নীল’ বা অন্য কোনও দলের— সরকারের পক্ষ কিংবা বিপক্ষ; এর বাইরে যারা আছেন তারাই আমাদের সদস্য হতে পারেন। যারা আসলে ওসবের মধ্যে থাকতে চান না তাদের জন্যই এই নেটওয়ার্ক। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নাইট কোর্সের বিরুদ্ধে আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা রাবার বুলেটে আক্রান্ত হয়েছিল। সেই প্রেক্ষাপটেই কিন্তু আমাদের এই শিক্ষক নেটওয়ার্ক কাজ শুরু করেছিল। আমাদের মূলত আলোচনা ছিল, আমরা এই কাজগুলো কোনও পদ-পদবীর জন্য করছি না। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর যে স্বার্থরক্ষা সেটা মূলত আমাদের উদ্দেশ্য। আমাদের নেটওয়ার্কের ওই অর্থে কোনও সাংগঠনিক কাঠামো নেই। আমরা আসলে অসাংগঠনিক ভাবে সাংগঠনিক।

সকাল সন্ধ্যা: প্রধান উপদেষ্টা বাছাই করার মিটিংয়ে শিক্ষার্থীরা আপনাদের সঙ্গে আলোচনায় বসেছিল। তখন কোন প্রেক্ষাপটে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নাম এলো?

তানজীমউদ্দিন খান: এটা আসলে আমাদের সাথে আলোচনার আগেই। আমরা যেদিন গিয়েছিলাম সেদিন ভোরেই ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম অনলাইনে ঘোষণা দেন ড. ইউনূসের নাম। এটা ওদেরই সিদ্ধান্ত ছিল। এই সিদ্ধান্তে আমরা যে খুব ভূমিকা পালন করেছি, বিষয়টা তেমন না।

ওদের অনেকের সাথেই আমাদের যোগাযোগটা ঘনিষ্ঠ হওয়ার একটা বড় কারণ ওরা অনেকেই ২০১৮ সালের আন্দোলনে ছিলেন। এই সুবাদে আমাদের সাথে কিছু ব্যক্তিগত সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। যেমন ধরুন হাসনাত আবদুল্লাহ। ওর সাথে আমার পরিচয় কিন্তু সেই প্রথম বর্ষ থেকেই। আমি যেহেতু সন্ধ্যায় বা সকালে হাঁটি। হাঁটার সময়ই ওদের অনেকের সাথে আলাপচারিতা হতো বিভিন্ন রকমের। ওদেরও কিন্তু শিক্ষক নেটওয়ার্ক নিয়ে বেশ আগ্রহ ছিল। আমাদের প্রশ্ন করত, আপনারা কিভাবে কাজ করেন। যে প্রশ্নগুলো এখন আমি শুনছি। আপনাদের তো কোনও সুনির্দিষ্ট কাঠামো নাই। আমি ওদের বলতাম, আমাদের যে সুনির্দিষ্ঠ কাঠামো নেই, এজন্য আমরা টিকে আছি। কিন্তু এর মধ্যে যদি পদ-পদবী তৈরি হতো তাহলে অনেক ব্র্যাকেট শিক্ষক নেটওয়ার্ক তৈরি হতো। এভাবে অনেক বিষয় নিয়ে ওদের অনেকের সাথে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা হয়েছে অনেক। আমরা দুটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, বা আমরা যে নামে ডাকতে চাই—‘সর্বজন বিশ্ববিদ্যালয়’ নিয়ে কনভেনশনও করেছি, এসব বিষয়ে ওদের আগ্রহও ছিল।

ড. ইউনূসের বিষয়টা একান্তই ওদের সিদ্ধান্ত। এখন এটার তো কিছু কৌশলগত কারণও ছিল। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক রাজনীতির ধরণটা যদি খেয়াল করি। বাংলাদেশ এবং দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। এখানে ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বনাম চীন— এই হিসাবটা আছে। আবার গ্লোবাল পলিটিক্সে ভারত, রাশিয়া এবং চীনের একটি সম্পর্ক আছে, অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমের দেশগুলো। বাংলাদেশকে কেন্দ্র করেও বেশ কিছু নতুন বাস্তবতা আছে। যেমন ইন্দো-প্যাসেফিক স্ট্র্যাটেজি একদিকে, মেরিটাইম সিল ক্রুক আরেকদিকে। চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লড়াই আছে। এক ধরনের ভূ-রাজনৈতিক জটিলতা এখানে আছে। এরকম একটা জটিলতা হ্যান্ডেলের জন্য এমন একজন ব্যাক্তিত্ব প্রয়োজন যে এই ধরনের জটিলতা উৎরাতে পারবেন সহজে, বা জটিলতার মধ্যেও টিকে থাকতে পারেন।

ড. ইউনূসের বিষয়টা একান্তই ওদের সিদ্ধান্ত। এখন এটার তো কিছু কৌশলগত কারণও ছিল। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক রাজনীতির ধরণটা যদি খেয়াল করি। বাংলাদেশ এবং দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। এখানে ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বনাম চীন— এই হিসাবটা আছে। আবার গ্লোবাল পলিটিক্সে ভারত, রাশিয়া এবং চীনের একটি সম্পর্ক আছে, অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমের দেশগুলো।

প্রফেসর ইউনূস যেহেতু নোবেল বিজয়ী, পশ্চিমাদের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো। এমনকি ভারতের সাথে এবং ভারতের মানুষের মধ্যেও তার যে জনপ্রিয়তা সবকিছু মিলিয়েই হয়ত ওরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত হিসাব। এটার সাথে শিক্ষার্থীদের পছন্দ বা অপছন্দের কোনও সম্পর্ক নেই। আরেকটা বিষয়, সবকিছু মিলিয়ে এমন একজনকে দায়িত্ব নিতে হতো যার গ্রহণযোগ্যতা সবচেয়ে বেশি। জটিল এই রাজনৈতিক সিচুয়েশনে একজন গ্রহণযোগ্য মানুষ খুঁজছিল সবাই। বাংলাদেশ যে ভূ-রাজনৈতিক স্পর্শকাতর অবস্থায় আছে সে জায়গায় এমন ব্যাক্তিত্ব আমাদের কিছু সুবিধা দেবে।

অন্যদিকে আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা আমরা বুঝতে পারছিলাম, মেগা-প্রকল্পকে ঘিরে আমাদের এসব কিস্তি দিতে গিয়ে অর্থনীতি চাপের মুখে পড়তে যাচ্ছে। এটাই কিন্তু আমাদের আরেকটা বড় চ্যালেঞ্জ। অর্থনীতিকে রিকোভার করা। সেক্ষেত্রে তো এরকম একটা পারসোনালিটি দরকার ছিল। যার মাধ্যমে এই রিকোভারি করাটা সহজ হতে পারে। এই রিকোভারির ক্ষেত্রে একটা অভিজ্ঞ চোখ খুবই জরুরি ছিল। আমার কাছে মনে হচ্ছে, এই দুইয়ের সম্বন্বয়টা প্রফেসর ইউনূসের মধ্যে পাওয়া গেছে। এটা আমার ব্যক্তিগত বিশ্লেষণ। ওরা এভাবে বিশ্লেষণ করেছে কিনা জানি না।

সকাল সন্ধ্যা: রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এখন রাজনীতি ও রাষ্ট্রের সংস্কার নিয়ে কতটা আশাবাদী আপনি?

তানজীমউদ্দিন খান: রাষ্ট্র সংস্কারের তো কোনও বিকল্প নেই। কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে শুরু হয়ে একদফা দাবির মধ্য দিয়ে গিয়ে শেষ যেটা জনপ্রিয় দাবি তা হলো রাষ্ট্র সংস্কার। এই জায়গাতে কিন্তু খুব শক্তিশালী জনমত আছে। পুরনো এবং জীর্ণ রাজনীতিতে আর কেউ ফেরত যেতে চায় না। পুরনো রাজনীতিটা মানুষের পক্ষের রাজনীতি ছিল না। এটা নিজ নিজ দলের পক্ষের রাজনীতি ছিল। ব্যবসায়ীদের পক্ষের রাজনীতি ছিল। একটি অলিগার্ক সোসাইটি বানানোর রাজনীতি ছিল। সাধারণ মানুষের পক্ষে কোনও রাজনীতি ছিল না। কিন্তু এই আন্দোলন বা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষ তার একটা স্পেস রেডি করতে পেরেছে। সাধারণ মানুষ তাই মনে করে— বাংলাদেশকে সাধারণ মানুষমুখী করার একটি সুযোগ এবার এসেছে। এটা হতে পারে রাষ্ট্র সংস্কারের মধ্য দিয়ে বা অন্যকিছুর মধ্য দিয়ে। তারমানে একটি নতুন বাংলাদেশের স্বপ্নের ক্ষেত্র তৈরি করেছে এই গণ-অভ্যুত্থান।

এই যে বিভিন্ন জায়গায় এখন ‘বদলি’ হচ্ছে নতুন ‘পোষ্টিং’ হচ্ছে। এগুলো কিন্তু এমন ঘটনা নয় যা আমাদেরকে আত্মবিশ্বাস দিতে পারে যে নতুন বাংলাদেশের সূচনা হচ্ছে। যে উপায়ে মামলাগুলো দেওয়া হচ্ছে এর আগের কতৃত্ববাদী সরকার যেভাবে মামলা দিত তার থেকে ব্যতিক্রম কিছু কি আমরা দেখছি। ওইটাই কিন্তু রেপ্লিকেট করছি আমরা। মানুষের আস্থা ফেরাতে আমরা যেরকম ভিন্ন চর্চা বা অনুশীলন চাই সেই জায়গাটা কিন্তু এখনও পরিস্কার করা যায়নি।

তবে আমাদের যেটা মনে রাখতে হবে, যেকোনও সংস্কারের প্রথমে প্রয়োজন প্রাথমিক জরুরি কিছু কাজ। সেটা হলো মানুষজনের আস্থা ফিরিয়ে আনা। প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙ্গে পড়েছে। যে রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে আমরা ছিলাম সেটা কোনও রাষ্ট্র ব্যবস্থাই ছিল না। ওটা একটা বন্দনা ব্যবস্থা ছিল। আমরা একটা রাজনৈতিক বন্দোবস্তের মধ্যে ছিলাম যেখানে বন্দনা ছাড়া অন্যকিছু হতো না। বন্দনার মধ্যে দিয়ে সকল দুর্বলতাকে আড়াল করে দেওয়া হতো। এই বন্দনা থেকেই তো আমরা বের হতে চাই। এটা থেকে বের হতে গেলে যা করতে হবে তা হলো আস্থা তৈরি করতে হবে। আস্থা তৈরিতে ভিন্ন উদাহরণ তৈরি করতে হবে।

এই যে বিভিন্ন জায়গায় এখন ‘বদলি’ হচ্ছে নতুন ‘পোষ্টিং’ হচ্ছে। এগুলো কিন্তু এমন ঘটনা নয় যা আমাদেরকে আত্মবিশ্বাস দিতে পারে যে নতুন বাংলাদেশের সূচনা হচ্ছে। যে উপায়ে মামলাগুলো দেওয়া হচ্ছে এর আগের কতৃত্ববাদী সরকার যেভাবে মামলা দিত তার থেকে ব্যতিক্রম কিছু কি আমরা দেখছি। ওইটাই কিন্তু রেপ্লিকেট করছি আমরা। মানুষের আস্থা ফেরাতে আমরা যেরকম ভিন্ন চর্চা বা অনুশীলন চাই সেই জায়গাটা কিন্তু এখনও পরিস্কার করা যায়নি। সংস্কারের প্রশ্ন অনেক পরে, তার আগে অন্তর্বতী সরকার যে ভিন্ন সেটার উদাহরণ প্রতিমুহুর্তে তৈরি করতে হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত ওই অর্থে আমরা তেমন কোনও নজির কিন্তু পাইনি। অনেককেই ধরা হচ্ছে, তাদের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে। কিন্তু বাস ভাঙ্গার বা আগুন লাগানোর বিষয় নিয়ে যে মামলা তা তো পুরনো অনুশীলন। আমরা যদি পুরাতন অনুশীলনের মধ্যে দিয়ে যাই তাহলে তো আমরা যে সংস্কার করব সেই সিম্পটম তো থাকে না। সেক্ষেত্রে আস্থা তৈরি হয় না।

আমরা অনেকের হাতেই এসময় অস্ত্র দেখেছি। বৈধ অস্ত্রেরও অবৈধ ব্যবহার ছিল। তৃণমূলের অনেক রাজনৈতিককর্মীর হাতেই কিন্তু অস্ত্র দেখা গিয়েছে। সেগুলো কিন্তু এখনও রিকোভার হয়নি।

আমার কাছে মনে হয় আস্থা তৈরি করাটা খুবই জরুরি। রাষ্ট্র সংস্কার আমরা কী করব ওই আলাপে আমরা পরেও যেতে পারি। এক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট একটা প্ল্যান অফ একশন নিয়ে আসতে হবে। সত্যি সত্যি আমি কী করব, লক্ষ্য কী সেটা ঠিক করা। এজন্য জনগনের সাথে প্রফেসর ইউনূসের একটি যোগাযোগের মাধ্যম তৈরি প্রয়োজন।

নিহতদের তালিকা প্রথম দিনের কাজ ছিল। আহতদের তালিকা করা আর তাদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা। শোনা যাচ্ছে অনেকে গুম আছেন নিখোঁজ আছেন তাদের তালিকা করা। অনেককে না কি কবর দেওয়া হয়েছে বা পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। এসব অনুসন্ধান করে তালিকা করা। আক্রান্ত পরিবারগুলোর তালিকা করে পুর্নবাসনের ব্যবস্থা করা। এগুলো খুবই দ্রুত করা উচিত ছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত এক্ষেত্রে কোনও সংগঠিত কার্যক্রম কিন্তু আমরা দেখিনি। ফলে, সংস্কারের আগে যে আস্থা তৈরির যে গতি তা হয়ত আমাদের আকাঙ্ক্ষার থেকে বেশ কিছুটা দূরে।

আমার কাছে মনে হয় আস্থা তৈরি করাটা খুবই জরুরি। রাষ্ট্র সংস্কার আমরা কী করব ওই আলাপে আমরা পরেও যেতে পারি। এক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট একটা প্ল্যান অফ একশন নিয়ে আসতে হবে। সত্যি সত্যি আমি কী করব, লক্ষ্য কী সেটা ঠিক করা। এজন্য জনগনের সাথে প্রফেসর ইউনূসের একটি যোগাযোগের মাধ্যম তৈরি প্রয়োজন।  

সকাল সন্ধ্যা: অনেকেই এই আন্দোলনকে বিপ্লবের সাথে তুলনা করছেন? আপনি  এ আন্দোলনকে কিভাবে বিচার করবেন?

তানজীমউদ্দিন খান: এটাকে আমি বিপ্লব হিসেবে দেখছি না। বিপ্লবের যে স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য তা কিন্তু এখানে অনুপস্থিত। একটা দাবিকে ঘিরে একটা অভ্যুত্থান হয়েছে। আবার অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে দাবিও পরিবর্তন হয়েছে। কোটা সংস্কার থেকে আমরা রাষ্ট্র সংস্কারে এসেছি। যেরকম নৃশংসতা হয়েছে তা নজিরবিহীন। একজন শিশু যে ছাদে খেলা করছিল সে গুলিতে মারা গিয়েছে। যে জানালার সামনে দাঁড়িয়েছে সেও গুলিবিদ্ধ হয়েছে। প্রত্যেকটি মানুষের জীবন কিন্তু ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গিয়েছিল। এই ঝুঁকির সাথে ছিল চেপে রাখা ক্ষোভ। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিসহ জীবনের কোনও জায়গাতেই সুশাসন ছিল না। এটা বন্দনা ব্যবস্থা থাকায়, রাষ্ট্র ব্যবস্থা পুরোটাই বিশৃঙ্খল ছিল। মানুষের ক্ষোভ ছিল। কিন্তু এই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ সে করতে পারছিল না। কারণ কোনও পলিটিক্যাল ব্যানারে তার যাওয়ার সুযোগ ছিল না। কোনও রাজনৈতিক দলই কিন্তু রাস্তায় দাঁড়াতে পারে নি। তাদেরকে খুন করা হয়েছে, গুম করা হয়েছে, মামলার পর মামলা দেওয়া হয়েছে। একেক জনের মাথায় হাজারের উপর মামলার কথাও আমরা শুনেছি। তখন যেই এসবের বিরোধিতা করত তাকেই বিএনপি জামায়াত ট্যাগ দিয়ে তার মনোবল নষ্ট করা হতো। সেই ব্যাক্তির জন্য বিপদজনক পরিস্থিতি তৈরি করা হতো। রাজাকার বলে যদি আমাকে কেউ পেটায় তাহলে সেটা অনেকটা যেন জায়েজ হয়ে যায়। কারণ রাজাকার বলামাত্রই অন্য কেউ কিন্তু আমাকে বাঁচাতে আর আসে না। সে যদি আসে তাহলে তাকেও রাজাকার বলা হবে। এই পরিস্থিতিতে এমন কোনও প্লাটফর্ম ছিল না যে ট্যাগিং-এর এই রাজনীতি থেকে বের হয়ে মানুষ তার ক্ষোভ প্রকাশ করতে পারবে। এই প্ল্যাটফর্মটা কিন্তু সবাইকে এক হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। মানুষ কিন্তু ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। আমরা শহীদ মিনারে ‘দ্রোহযাত্রা’য় দেখলাম কালচারাল এক্টিভিস্টদের সাথে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরাও এক হয়েছে। কিন্তু এই ‘দ্রোহযাত্রা’র নেতৃত্ব কিন্তু দিয়েছিল বাম সংগঠনগুলো।

এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, যারা এখন দায়িত্বে আছেন তাদের মধ্যে এই বোধটা কাজ করে কি না যে— গণ-অভ্যুত্থানে মানুষ এক কাতারে চলে আসল, সেই একসাথে থাকা মানষগুলোই যে রাজনৈতিকভাবে বিকল্প। সেটা তারা অনুধাবন করতে পারছেন কিনা এখন সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। যারা অন্তর্বতী সরকারে আছেন তারা কেউ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছেন কিনা সেটা আমি জানি না। তাদের মধ্যে এই সংস্কারগুলো আনার যে টিম স্পিরিট থাকার কথা সেটা আমরা দেখছি না।

ফলে এই ট্যাগিং-এর রাজনীতি থেকে বের হয়ে একটি প্ল্যাটফর্ম মানুষ খুঁজছিল। যেন তাকে কেউ আলাদা চিহ্নিত করে ট্যাগ না দিতে পারে। একইসাথে সে তার ক্ষোভটাও ঝাড়তে পারে। যখন তার বেঁচে থাকাটাই অনিশ্চিত হয়ে গেল, সে বাসায় বসেও গুলি খেতে পারে। মানুষ আসলে এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে চেয়েছে। পরিত্রাণ পেতে চেয়েছে বলেই ‘সনাতনী রাজনীতি’কে সে ছুঁড়ে ফেলতে চাচ্ছে। এজন্যই সে রাষ্ট্র সংস্কার বা সংবিধান সংস্কারের কথা বলছে। এটাকে তাই ক্লাসিকাল বিপ্লবের মডেলে দেখা যাবে না। এটা আসলে একটি গণ-অভ্যুত্থান হিসেবেই দেখি। তবে বিপ্লব হতে পারে এখন। যেহেতু আমরা রাষ্ট্র সংস্কারের কথা বলছি, সনাতনী রাজনীতির বাহিরে নতুন রাজনীতি তৈরির কথা বলছি। এতে হতে পারে একটি বিপ্লব।

এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, যারা এখন দায়িত্বে আছেন তাদের মধ্যে এই বোধটা কাজ করে কি না যে— গণ-অভ্যুত্থানে মানুষ এক কাতারে চলে আসল, সেই একসাথে থাকা মানষগুলোই যে রাজনৈতিকভাবে বিকল্প। সেটা তারা অনুধাবন করতে পারছেন কিনা এখন সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। যারা অন্তর্বতী সরকারে আছেন তারা কেউ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছেন কিনা সেটা আমি জানি না। তাদের মধ্যে এই সংস্কারগুলো আনার যে টিম স্পিরিট থাকার কথা সেটা আমরা দেখছি না। আর সংস্কার বলতে মানুষের আকাঙ্ক্ষা কী, তা হচ্ছে স্বৈরাচারী ব্যবস্থা হতে বের হয়ে আসা। সংবিধান, নির্বাচনী ব্যবস্থা এবং সংসদীয় ব্যবস্থায় যে ধরনের পরিবর্তন আনা দরকার সেইগুলোই কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্র সংস্কারে পরিণত হবে।

সকাল সন্ধ্যা: অন্তর্বর্তীসরকারকে সংস্কারের জন্য ঠিক কতটা সময় দেওয়া উচিত বলে মনে করেন?

তানজীমউদ্দিন খান: সময়ের আলাপ করাটা এখন গুরুত্বপূর্ণ না। এটা আমার কাছে মনে হয়। সাধারণ মানুষের আকাঙ্ক্ষার জায়গাটি হচ্ছে আমরা পিছনে ফিরব না। আগের ব্যবস্থায় ফিরব না। এখন যেটা স্পষ্ট সেটা হচ্ছে, রাষ্ট্রের প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানকে নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। বন্দনা ব্যবস্থার যে রাষ্ট্র পদ্ধতি সেটাতে একটা বাদে সব প্রতিষ্ঠানই অকার্যকর হয়ে গেছে। একটা যেটা কার্যকর ছিল তা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। একটা সড়ক দুর্ঘটনা ঘটলেও আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিচার চাইতাম। এটা কোনও সুস্থ রাজনৈতিক ব্যবস্থা ছিল না। ফলে আমরা আসলে মাইনাসে আছি। মাইনাস থেকে শূন্যে আসতে হবে, সেখান থেকে আবার উঠতে হবে। যার জন্য সময় নির্ধারণ করা এই মুহুর্তে সহজ কাজ না। ফলে এই আলাপটাও জরুরি না। যেহেতু ভিন্ন প্রেক্ষাপটে এই সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। এটা অন্য সময়ের মতো কেয়ারটেকার সরকার না। এটাকে ঠিক বাঁধাধরা নিয়মের মধ্যে ফেলে দেওয়া যাবে না। আবার এটাও ঠিক, বাংলাদেশে কোনও সরকার যদি দীর্ঘস্থায়ী হয় তার মধ্যেও স্বৈরাচারী প্রবণতা তৈরি হবে।

একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, দেশের মানুষ যেরকম রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছে তার ফলে মানুষকে যেটাসেটা কোনও একটা কিছু বুঝ দিয়ে দিলেই চলবে না। মানুষ অস্ত্রের মুখে বুক পেতে দিয়েছে। মানুষের এই সাহসিকতা মানুষকে অন্য একটা পর্যায়ে নিয়ে গেছে। ফলে কেউ যদি অন্যায়ভাবে দীর্ঘ মেয়াদে থাকতে চায়, আমার মনে হয় না সে সাধারণ মানুষের সমর্থন পাবে। এটাও ঠিক মানুষ আবার পুরনো ব্যবস্থায় ফিরে যেতে চায় না। এজন্য যারা অন্তর্বতীকালীন সরকারে আছেন তাদের এটা বোঝা জরুরি। মানুষকে বোঝা খুবই জরুরি। মানুষকে বুঝলে পদ-চেয়ারের লোভ থাকবে না। মনে রাখতে হবে আগেও মানুষ পদ-চেয়ার পেয়েছে। কিন্তু তাতে তারা মানুষের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে। যদি এই সরকারেরও এরকম হয় তাহলে আমাদের জন্য বিপদ তো কমবেই না বরং বাড়বে। তাদের বুঝতে হবে, তারা অন্য একটি ভিন্ন মিশন নিয়ে এখানে আছেন। মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষা বুঝে চলা তাই খুবই জরুরি।

সকাল সন্ধ্যা: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের সক্রিয় ভূমিকা থাকা সত্ত্বেও কেন আপনাদের কেউ উপদেষ্টা পরিষদে থাকলেন না? বাধা কোথায় ছিল?

তানজীমউদ্দিন খান: সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো এই অন্তর্বতীকালীন সরকার কিভাবে হলো। এটা যে একহাতে হয়েছে তা কিন্তু না। অনেক দলের দরকষাকষির মধ্য দিয়ে নামগুলো বিবেচিত হয়েছে। একদিকে শিক্ষার্থীরা তাদের মতো করে নাম দিয়েছেন। প্রফেসর ইউনূস যেহেতু এই সরকারের প্রধান তিনিও যাদের সাথে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন এমন কিছু নাম দিয়েছেন। আমি নিশ্চিত আমাদের যে বাহিনীগুলো আছে সেখান থেকেও কিছু নাম গেছে। সবপক্ষের দর-কষাকষির মধ্য দিয়ে নামগুলো এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের এই এষ্টাবলিষ্টমেন্টের মধ্যে থাকতেই হবে এই তাড়না আমাদের নাই। কিন্তু দায়িত্ব আসলে সেই দায়িত্ব নিতে আমরা প্রস্তুত। এই চ্যালেঞ্জটা আমরা নিতেও চাই। যেই কথাগুলো আমরা বলে এসেছি তাত্ত্বিকভাবে সেই কথাগুলো প্রয়োগ করতে পারার চ্যালেঞ্জ আমরা নিতে চাই। হয়ত যারা দর কষাকষি করেছেন তাদের মনে হয়েছে যে আমাদেরকে প্রয়োজন নেই। এটা নিয়ে আমাদের আক্ষেপ নেই। চ্যালেঞ্জটা নিতে পারলে শিক্ষক নেটওয়ার্কের ভালো হতো। না হওয়াতেও কোনও সমস্যা নেই। মূল বিষয় হলো, শিক্ষক নেটওয়ার্ক সবসময় যে কাজটি করে আসছে সেই কাজটাই আমরা করে যেতে চাই।

সকাল সন্ধ্যা: ৫ই আগস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের ঠিক আগের দিনই আপনারা অর্ন্তবর্তী সরকারের রূপরেখা ঘোষণা করেছিলেন? কোন প্রেক্ষাপটে তখনই আপনারা এমন ঘোষণা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন?

তানজীমউদ্দিন খান: ঘটনার পরম্পরা যখন আমরা দেখি, তখন একটা উপলব্ধি তো আসে। আমরা অনেকেই কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে গণঅভ্যুত্থান দেখেছি এর আগে, আমি নিজে সামরিক স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে ছিলাম। তখন আমি একটি ছাত্র সংগঠনের সদস্য হিসেবে ছিলাম। আমি তখন কলেজে পড়তাম। স্ট্রিট ফাইটার হিসেবে সেই আন্দোলনে ছিলাম। আমাদের যারা বয়োজেষ্ঠ্য তারা একাত্তরও দেখেছেন। এমনকি ২০০৭-০৮ সালে মিলিটারি-সিভিল সরকারের বিরুদ্ধে যে ছাত্র আন্দোলন হয়েছিলে যেটাকে কেউ কেউ ‘অগাস্ট বিপ্লব’ও বলে। সেটার সাথেও আমরা যুক্ত ছিলাম। ওই অভিজ্ঞতাগুলো থেকেই আমাদের মনে হচ্ছিল এই আন্দোলনের একটি পরিণতি ঘটবে। এর কারণ বিশেষ করে সাধারণ মানুষের সংশ্লিষ্টতা। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা যখন সারা দেশে আন্দোলন করছে। সাধারণ মানুষ তাদের পানি দিচ্ছে, দোকানগুলো খাওয়া দিচ্ছে টাকা নিচ্ছে না। এই ধরনের আন্দোলনকে কিন্তু দমানো যায় না। আন্দোলন যদি ওই অবস্থায় পৌঁছে যায় তখন সরকার যতই শক্তিশালী হোক তার পক্ষে এই আন্দোলন দমানো আর সম্ভব হয় না।

আমাদের আগের অভিজ্ঞতা থেকে এটা আমাদের একটা অনুধাবন ছিল। এরকম পরিস্থিতিতে আপনি যত নৃশংস হবেন মানুষ তত বেশি পথে নামবে। এটা ভুল যে নৃশংসতা করলে মানুষ চলে যাবে। আসলে নৃশংসতা মানুষকে আরও বেশি ঐক্যবদ্ধ করে। সাধারণ মানুষ যেখানে যুক্ত হয়ে যায় সেখানে ফলাফল অবশ্যম্ভাবী। আমাদের একটা চিন্তা ছিল যে মানুষ অনেক সময় আশাহত হয়ে পড়ে। অনেক আন্দোলনেই আমরা দেখেছি। মানুষকে আশাহত হতে না দেওয়া এবং আমাদের অভিজ্ঞতার জায়গা থেকেই আমাদের অবস্থান। আমাদের খুবই ঝুঁকি ছিল। ঘটনাটা যদি উল্টো ঘটত তাহলে আমরা কয়জন বেঁচে থাকতাম নাকি আয়নাঘরে থাকতাম তা নিশ্চিত না। কিন্তু তাও ঝুঁকিটা আমাদের নিতেই হতো। আমরা নিয়েছিলাম। কারণ এটা দেশের মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় এবং অনিবার্য হয়ে পড়েছিল।

সকাল সন্ধ্যা: এই অভ্যুত্থান সফল হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়সহ স্কুল-কলেজগুলোতে বেশ কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে। আমরা দেখেছি নানা অভিযোগ তুলে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের পদত্যাগ ও প্রতিষ্ঠান ত্যাগে বাধ্য করছে। এতে ভবিষ্যতে শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ কতটা ব্যাহত হবে?

তানজীমউদ্দিন খান: একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে যে, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্কুল-কলেজ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই ভয়ানকভাবে দলীয়করণের মধ্য দিয়ে গেছে। যোগ্যতা থাকুক আর না থাকুক তাকেই প্রতিষ্ঠানের প্রধান বানিয়ে দেওয়া হচ্ছে যাদের আনুগত্য আছে সরকারী দলের সাথে। আনুগত্য নিয়ে যারা প্রধান বা বিভিন্ন দায়িত্ব ছিলেন তাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে গেছে তারা কোনওদিন শিক্ষার্থীমুখী ছিলেন না।

শিক্ষার্থীর স্বার্থরক্ষা করার চাইতে দলীয় স্বার্থ রক্ষা, মাস্তানদের প্রশ্রয় দেওয়া, অন্যায় করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এ কাজগুলো তারা রীতিমত ভয়ানকভাবে করেছে। যার ফলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে তাদের একটি দূরত্ব তৈরি হয়েছে। শিক্ষার্থীরা ভয়ে বিভিন্ন সময় এই অনাস্থার প্রকাশ করতে পারেনি। এখন এই নতুন অবস্থায় সেই অনাস্থা প্রকাশ করতে গিয়ে তা অরাজকতায় পর্যবসিত হচ্ছে। যেটা অনেক ক্ষেত্রেই গ্রহণযোগ্য না। অনেক ক্ষেত্রে আমি একে ‘মব জাষ্টিস’ হিসেবেই দেখছি।

প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের কিছু নিয়ম-কানুন আছে। আমরা যদি ধারাবাহিকভাবে এ ধরনের কার্যক্রম করি তাহলে তা ভবিষ্যতে খুব ভালো কিছু নির্দেশ করবে না। আসলে যেটা হচ্ছে এসব প্রতিষ্ঠানের যে প্রধানরা ছিলেন তারা একটি দলীয় পরিচয় নিয়ে ছিলেন। এখন যেহেতু দলটি নেই ফলে তাদের সেই পদ থেকে সরে আসতে হয়েছে। এতে একটা শূন্যতা তৈরি হয়েছে। যাতে অরাজকতা তৈরি হওয়ার সুযোগ হয়েছে। এর মধ্যে এখানে কিছু সুযোগ-সন্ধানী লোকও আছে যারা এই সুযোগে তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য কাজ করছে।

এসব কিন্তু অন্তর্বতীকালীন সরকারের মাথায় থাকা প্রয়োজন। যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, সেটা দ্রুত পূরণ করে স্থিতিশীলতা আনা প্রয়োজন ছিল। এখনও সেই প্রয়োজন আছে। এটা যত দ্রুত করা যায় ততই আমরা এই বিপদ থেকে মুক্ত হব। আবার শিক্ষার্থীদের যে রাগ, বঞ্চনা সেটাও আনএড্রেসড থাকলে চলবে না। সামনে যারা আসবে তাদের এগুলো মাথায় নিয়েই কাজ করতে হবে।

সকাল সন্ধ্যা: অনেক শিক্ষাঙ্গন থেকে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে আপনার মতামত কী? শিক্ষক রাজনীতিও কি নিষিদ্ধ করা উচিত?

তানজীমউদ্দিন খান: একটা বিষয় হচ্ছে, শিক্ষার্থীরা যেই রাজনীতির কথা বলে সেটাকে আমি রাজনীতি হিসেবে সংজ্ঞায়িত করব কিনা। যেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরকারের ছাত্র সংগঠনকে বের করে দেওয়া হলো। পরের দিন ভোরে আমি যখন হাঁটি তখন মুহসীন হলের সামনে একটা ব্যানার দেখলাম। সেখানে লিখা ‘‘এখানে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ’’। তখনও কিন্তু শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হয়নি। ওখানে আরও লিখা ছিল, ‘‘এখন থেকে কোন ছাত্রকে জোর করে পলিটিক্যাল প্রোগ্রামে, গেষ্টরুমে নেওয়া যাবে না।” শিক্ষার্থীরা যে রাজনীতি দেখেছে তা হচ্ছে গেষ্টরুমে অনাচারের রাজনীতি। এটা হচ্ছে হলের নিষ্পিষণের রাজনীতি। আমি তো সবসময় হলগুলোকে হিটলারের কনসেনট্রশন ক্যাম্প বলি। এ দায়ভার কিন্তু শিক্ষকদের। যারা হলগুলোর দায়িত্বে ছিলেন। তারা কেউই হল প্রশাসনের দায়িত্ব পালন করেন নি। হলের অনেক শিক্ষার্থীই জানে না তার হলের প্রভোষ্টকে বা হাউজ টিউটর কে। কে কোন ফ্লোরের দায়িত্বে আছেন। অথচ তারা হাউজ টিউটর এবং প্রভোষ্ট। তার মানে একটি সুনির্দিষ্ট ছাত্র সংগঠন হল প্রশাসন চালিয়েছে। ফলে শিক্ষার্থীরা সব সময় নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এখন ওই রাজনীতিকে বুঝতে হবে। এখন ওই রাজনীতি দিয়ে যদি সামগ্রিক রাজনীতি বুঝি তাহলে তা অন্য বিপদ হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে চিন্তার স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, অধিকার নিয়ে কথা বলার স্বাধীনতা। এখন আমি যদি রাজনীতি নিষিদ্ধ করার কথা বলি তাহলে আমি বিরাজনীতির প্রক্রিয়ায় ঢুকে যাব। এখন আমি বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়ায় যাব নাকি আমরা সেই রাজনীতিকে, যারা আমার হলগুলোকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্প বানিয়েছে তাদের প্রত্যাখান করব।

ফলে ঢালাওভাবে রাজনীতি নিষিদ্ধের আলাপ ঠিক না। সেটা ছাত্ররাজনীতিই হোক বা শিক্ষক রাজনীতি। আমাদের কাঠামোগত পরিবর্তন আনতে হবে রাজনীতিতে। যেই কাঠামোতে শিক্ষার্থী আর কোনওদিন ‘গুন্ডার্থী’ হয়ে উঠবে না, শিক্ষকরা সরকারের তল্পিবাহক হয়ে উঠবে না। এ ধরনের নতুন রাজনীতির সূচনা করাটা জরুরি।

একটা শিক্ষার্থী অনেক স্বপ্ন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। আমরা সেই স্বপ্নগুলোকে দুঃস্বপ্নে পরিণত করি। আমি সবসময় বলি আমরা ‘শিক্ষার্থী’দের ‘গুন্ডার্থী’ বানাই। প্রশ্ন হচ্ছে ‘গুন্ডার্থী’ বানানোর রাজনীতি থেকে আমরা বের হয়ে আসব কিনা। এটাই গুরুত্বপূর্ণ। এখন যদি কল্যাণের রাজনীতি না থাকে তাহলে তো আমার পাবলিক স্পেসটা থাকছে না। তার মানে সেখানেও একটি স্বৈরাচারী প্রবণতা মাথাচাড়া দিতে পারে।

ফলে ঢালাওভাবে রাজনীতি নিষিদ্ধের আলাপ ঠিক না। সেটা ছাত্ররাজনীতিই হোক বা শিক্ষক রাজনীতি। আমাদের কাঠামোগত পরিবর্তন আনতে হবে রাজনীতিতে। যেই কাঠামোতে শিক্ষার্থী আর কোনওদিন ‘গুন্ডার্থী’ হয়ে উঠবে না, শিক্ষকরা সরকারের তল্পিবাহক হয়ে উঠবে না। এ ধরনের নতুন রাজনীতির সূচনা করাটা জরুরি।

সকাল সন্ধ্যা: অভ্যুত্থানকে সরাসরি বিদেশি রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ বলে কোনও কোনও মহল, বিশেষ করে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ অভিযোগ করছে। আপনি কী মনে করেন?

তানজীমউদ্দিন খান: এটা অনেকেই অনেকভাবে বলতে পারে। যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক এই আন্দোলনের সাথে সরাসরি জড়িত ছিল। বিদেশি কোনও হস্তক্ষেপ থাকলে নিশ্চয় আমাদের সাথেও কেউ যোগাযোগ করত। এরকম যোগাযোগ তো কারও কাছ থেকে পাইনি। এরকম অভিযোগ অনেক থাকতে পারে। এটা আসলে খুবই মজার। তবে নতুন যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যে ভারতের বাংলাদেশের উপর যে একছত্র আধিপত্য ও প্রভাব সেটা খাটানোর সুযোগ এখন নেই। এখানেই নতুন কারও প্রভাব তৈরি করার সুযোগ তৈরি হয়েছে। এখন এই ব্যাপারে আলোচনা হতে পারে। যেহেতু বাংলাদেশকে ঘিরে একটি প্রতিযোগিতা আছে। পটপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে কারও কারও মধ্যে এই সুযোগটা নেওয়ার প্রক্ষাপট তৈরি হয়েছে। তার মধ্য দিয়ে এ আলাপটা আসতে পারে। ফলে আন্দোলনে বিদেশি শক্তি ছিল কিনা তা ভবিষ্যৎ গবেষকরাই বলতে পারবেন। তবে এটা বলতে পারি, আমাদের সাথে কেউ যোগাযোগ করেনি।

আর আন্দোলনটার যে চরিত্র, এটা খুবই আনপ্রেডিক্টেবল ছিল। এটা যে সরকার পতনের আন্দোলন হবে, এটা শুরুতে বোঝার কোনও সুযোগ ছিল কিনা আমি জানি না। এটা বোঝা গেলে নিশ্চয়ই এটা আগেই দমিয়ে দেওয়া হতো। খুব সুপরিকল্পিতভাবে যে আন্দোলনটি হয়েছে আমার কাছে তাও মনে হয় না। সরকারের নৃশংসতা যত বেড়েছে আন্দোলনের গতি তত বেড়েছে। ফলে, আমি ব্যাক্তিগতভাবে বলতে পারছি না মোটাদাগে যে আন্দোলনে বিদেশি শক্তি ছিল বা ছিল না। এটা ভবিষ্যৎ গবেষকরাই বলতে পারবে।

সকাল সন্ধ্যা: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
তানজীমউদ্দিন খান: আপনাকেও ধন্যবাদ।

ad

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত