নাগরিকেরা সচেতন না হলে দেশ থেকে দুর্নীতি দমন করা সম্ভব নয় বলে মনে করেন দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আব্দুল্লাহ। তিনি বলেন, দুর্নীতি না করলেও সবাই বিভিন্নভাবে দুর্নীতিকে সহায়তা করে। নাগরিকরাই দুর্নীতিবাজদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়, তাদের বর্জন করে না।
শনিবার হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ আয়োজিত এক সেমিনারে এসব কথা বলেন তিনি। জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘দুর্নীতি দমনে নাগরিকদের ভুমিকা’ শীর্ষক এই সেমিনারের আয়োজন করা হয়।
দুদক চেয়ারম্যান বলেন, “দুর্নীতি রেখে দেশের উন্নয়ন করা সম্ভব না। আর উন্নয়ন হলেও তা স্থায়ী হবে না। নাগরিকরা সচেতন না হলে শুধু আইন করে দেশ দুর্নীতিমুক্ত করা সম্ভব না। পরিবারের স্ত্রী-সন্তানদেরও এ বিষয়ে ভূমিকা রাখতে হবে।”
সরকারের বিভিন্ন বিভাগে দুর্নীতির খবর প্রকাশের প্রসঙ্গ টেনে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, সাধারণত মানুষের যাতায়াত যেখানে বেশি সেখানকার দুর্নীতির খবরই প্রকাশ হয়, গণমাধ্যমে আসে। কিন্তু এমন অনেক বিভাগ আছে যেখানে দুর্নীতি হয় কিন্তু খবর তেমন আসে না।
“সেখানে উইন উইন সিচ্যুয়েশনে (সমঝোতার ভিত্তিতে) দুর্নীতি হয়। আমি সেসব প্রতিষ্ঠানের নাম বলব না।”
সেমিনারের শুরুতে আয়োজক সংগঠনের চেয়ারম্যান জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ দুদকে কর্মরত সবার সম্পদের হিসাব প্রতি দুই বছর পরপর জনগণকে জানাতে ওয়েবসাইটে প্রকাশসহ ১৯ দফা সুপারিশ করেন।
এসব প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, “আমাদের দেশের একটা প্রবণতা হলো, দুর্নীতি বলতে আমরা কেবল সরকারি কর্মচারি বুঝি। দুর্নীতির ফোকাসটা সরকারি কর্মচারিদের মধ্যে দিয়ে সবাই প্রিভিলেজ (প্রাধান্য) নিয়ে যা খুশি তাই করে যাচ্ছে কিনা সেটাও দেখা দরকার।”
সেমিনারে ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরামের বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হুমায়ুন রশিদের বক্তব্যের সমালোচনাও করেন দুদক চেয়ারম্যান।
হুমায়ুর রশিদ তার বক্তব্যে অভিযোগ করে বলেন, “দেশের আমলারা সব টাকা বিদেশে পাঠিয়ে দেন। তাদের সন্তানেরা বিদেশে লেখাপড়া করে, সন্তানদের পড়ানোর নামে তারা বিদেশে টাকা পাঠায়। হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া দেশের অধিকাংশ আমলাদের সন্তানেরা বিদেশে থাকে, বিদেশেই লেখাপড়া করে।”
এই বক্তব্যের সমালোচনা করেন মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আব্দুল্লাহ। তিনি বলেন, “সমস্ত দুর্নীতিবাজ মানে সরকারি আমলা, বাকিরা একটা ক্লিন ইমেজ নিয়ে যা খুশি তা করবেন। এসব মুখস্ত কথা বলে বরং সব আড়াল করে দেওয়া হয়।
“নিয়মের বাইরে কাজ করলেই তো সেটা দুর্নীতি হয়। সেটা কি সবাই জানে না?”
দুর্নীতি দেখেও কেউ কিছু না বলে সব দুদকের ওপর ছেড়ে দিয়ে সবাই বসে থাকে, এমন অভিযোগ করেন তিনি। তার মতে, সবাই সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করলে এসব ঘটনায় দুদকের যুক্ত হওয়ার প্রয়োজনই হতো না।
এ সময় তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের উদাহরণ দেন। বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংকে আপনি যান তো, গিয়ে দেখেন কারও চিকিৎসার জন্য ১০ হাজার ডলার পাঠাতে পারেন কিনা? বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি ছাড়া কেউ চাইলেই কি কেউ টাকা পাঠাতে পারবে? তাহলে এই অর্থ পাচার হয় কীভাবে?”
দেশের সব মানুষ দুর্নীতি না করলেও সবাই বিভিন্নভাবে দুর্নীতিকে সহায়তা করছে অভিযোগ করে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, “এখন তো মসজিদ কমিটি থেকে শুরু করে যেকোনো সামাজিক সংগঠনের কমিটি করার সময় ভালো মানুষদের নেওয়া হয় না। কারণ তারা টাকা দিতে পারে না। এসব কমিটিতে তাদেরই নেওয়া হয়, যাদের টাকা আছে। তাহলে আমরা কী দুর্নীতিবাজদের সহায়তা করছি না?”
প্রতিবেশি দুর্নীতি করলে নাগরিকদের কিছু করার নেই কিনা, সে প্রশ্নও তোলেন দুদক চেয়ারম্যান।
বলেন, “আর কিছু না করতে পারি, আমরা দুর্নীতিবাজদের বর্জন তো করতে পারি। আমরা দুর্নীতিবাজদের দাওয়াতে যাব না, তাকে বর্জন করব। কিন্তু সেটা না করে আমরা তাকেই অতিথি করছি। এভাবে নাগরিকরাই তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছি।”
অর্থপাচারের জন্য মানিলন্ডারিং আইনে ২৯টি অপরাধের মধ্যে একটিমাত্র অপরাধের বিচার কেবল দুদকের দায়িত্ব জানিয়ে তিনি বলেন, “অথচ মানিলন্ডারিং হলেই প্রশ্নে ওঠে, দুদক কিছুই করল না!”
গত দুই বছরে অন্তত ৩০ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, কারও চাকরি চলে গেছে, কারও পদাবনতি হয়েছে, বিভিন্ন মেয়াদে সাজাও হয়েছে।
এরপরেও দুর্নীতির বিষয়ে জাতির যে প্রত্যাশা, দুদক তার ধারে কাছেও যেতে পারে না; বললেন দুদক চেয়ারম্যান।
“এটা স্বীকার করে নিলাম। তবে হ্যাঁ আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব যা আইনে আছে এবং সবার যা প্রত্যাশা, তার জন্য কাজ করে যাচ্ছি।”
এসময় দুর্নীতি নির্মূলে নাগরিক সমাজকে সচেতন করতে বিভিন্ন জেলা উপজেলা পর্যায়ে ৫০৩টি দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি গঠন, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ২৫ হাজার ৫৪২টি সততা সংঘ গড়ে তোলার কথা উল্লেখ করেন তিনি।
দুর্নীতি প্রতিরোধের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে সচেতন নাগরিকদের সঙ্গে পাওয়া যায় না, এমন আক্ষেপও করেন।
প্রতিদিন দুদকে গড়ে ৬০টি অভিযোগ আসে জানিয়ে তিনি বলেন, এসব অভিযোগ যাচাই বাছাইয়ের পর তা নথিভুক্ত করা হয়। দুদকের পাশাপাশি দেশের মানুষদেরও যার যার জায়গা থেকে কাজ করতে অনুরোধ জানান।
আইনজীবী এখলাছ উদ্দিন ভুইয়া ও আইনজীবী মো. ছারওয়ার আহাদ চৌধুরীর সঞ্চালনায় সেমিনারে আরও বক্তব্য দেন-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন, সাবেক সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটওয়ারী এবং এটিএন বাংলার প্রধান নির্বাহী জ ই মামুন।