বাইরে তখন ঝুম বৃষ্টি। এদিকে বাসও পৌঁছে গেছে গন্তব্যে। নেমে ছাতাটা মেলতেই ঝড়ো হাওয়া এসে যেন উড়িয়ে নিতে চাইল এবাদুর রহমানের ছাতাটি। কোনোমতে ছাতার উড়ে যাওয়া রক্ষা করতে পারলেও ততক্ষণে সেটি উল্টে দুমড়ে-মুচড়ে গেছে। বাধ্য হয়ে ভিজতে ভিজতেই দৌড়ে সড়কের পাশের দোকানের সামনে আশ্রয় নিতে হলো তাকে।
সোমবার ঢাকার বসিলা বাসস্ট্যান্ডের একটি দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে কথা হলো এবাদুরের সঙ্গে। নতুন ছাতা নষ্ট হওয়ায় আফসোস করছিলেন।
বললেন, “ছাতাটা আইনা কী লাভ হইল! বাতাসে নতুন ছাতাটাও ভাঙল, বৃষ্টিতেও ভেজা লাগল।”
বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন এবাদুর। থাকেন মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যান এলাকায়। সকাল থেকে অনবরত বৃষ্টি ঝরলেও কাজের তাগিদে ঘর থেকে তাকে বের হতেই হয়েছে।
জানালেন, বেতন-কমিশন সবকিছু মিলে মাস শেষে ১২-১৫ হাজার টাকা পান। এর মধ্যে কাজে বের না হলে বেতন কাটা যায়। তাই ঝড়-বৃষ্টি-রোদ কিছুই দেখার উপায় নেই তার।
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট প্রবল ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে সকাল থেকেই অঝোরে বৃষ্টি ঝরছে ঢাকায়। সেই সঙ্গে বইছে দমকা হাওয়া। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন এবাদুরের মতো কর্মজীবী মানুষ ।
ঢাকার রাস্তায় ঘুরে দেখা গেল, গণপরিবহন তেমন নেই। রিকশার সংখ্যাও হাতেগোনা। অল্প কিছু সিএনজিচালিত অটোরিকশা পথে থাকলেও, তারা ভাড়া হাঁকছে দুই থেকে তিনগুণ।
খিলক্ষেতে কথা হয় বেসরকারী কর্মজীবী নাজনীনের সঙ্গে। তার গন্তব্য মতিঝিল। বাসা থেকে বের হয়ে দেখতে পেলেন বাস নেই। প্রবল বৃষ্টির ঝাঁপটায় অটোরিকশা খুঁজতে গিয়ে হয়েছেন আধভেজা। অন্যদিন যেখানে ২০০-২৫০ টাকায় অটোরিকশা পেয়ে যান, সেখানে আজ চাইছে ৬০০-৭০০ টাকা।
জলাবদ্ধতা-যানজট
বৃষ্টির কারণে ঢাকার অনেক সড়কে দেখা দিয়েছে জলাবদ্ধতা। মিরপুরের কাজীপাড়া থেকে শেওড়াপাড়া যাওয়ার পথে রাস্তায় জমেছে কোমর সমান পানি। রিকশায় উঠলেও পানি উঠে আসছে যাত্রীর পায়ের কাছে।
শুধু মিরপুর নয়, একই অবস্থা বিমানবন্দর, মানিক মিয়া এভিনিউ, গ্রিনরোড, নিউ মার্কেট, ধানমণ্ডি, মোহাম্মদপুর, মিরপুর-১০ নম্বর থেকে ১৪ নম্বর যাওয়ার পথসহ বেশ কিছু এলাকায়।
জলাবদ্ধতার পথ ধরে মূল সড়কগুলোর কোথাও কোথাও দেখা দিয়েছে যানজট।
মোহাম্মদপুর থেকে আব্দুল্লাহপুর চলাচলকারী প্রজাপতি পরিবহনের বাসচালক ইসমাইল তালুকদার বলেন, রাস্তায় যানবাহন কম থাকলেও পানি জমে থাকায় জায়গায় জায়গায় যানজট লেগে যাচ্ছে। তাছাড়া বৃষ্টির কারণে যাত্রী নেই বললেই চলে।
এই আবহাওয়ায় বাস নিয়ে বের হয়ে লোকসান গুনতে হয় কিনা, সেই চিন্তায় আছেন তিনি।
বাড়তি ভাড়ার কবলে নগরবাসী
ভোর থেকেই রেমালের প্রভাবে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। দিনভর কখনো ঝেঁপে কখনো গতি কমিয়ে অবিরত ঝরে চলেছে বৃষ্টি।
বৈরি আবহাওয়ার সুযোগে বাড়তি ভাড়া হাঁকছেন অটোরিকশা ও রিকশাচালকেরা। ২০০ টাকার ভাড়া উঠেছে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায়, ৩০০ টাকার ভাড়া ৬০০তে।
এমনকি রিকশাভাড়াও বাড়িয়ে দিয়েছেন চালকরা। প্রতি ট্রিপে ৫০ থেকে ৬০ টাকাও বেশি হাঁকছেন অনেকে।
ইসিবি গোলচত্তর এলাকার বাসা থেকে সকাল ৮ টার দিকে অফিসের উদ্দেশে বেরিয়েছিলেন মো. সাদ্দাম হোসেন, যাবেন ধানমণ্ডি। প্রায় ৩০ মিনিট দাঁড়িয়ে থেকেও বাসের দেখা পাননি তিনি। বাধ্য হয়ে একটি অটোরিকশা ভাড়া করতে চাইলেন। ২৫০-৩০০ টাকার ভাড়া চালক চাইলেন ৬০০ টাকা। যা খরচ করে যাওয়া অনেকের জন্যই অসম্ভব।
বেশি ভাড়ার চাওয়ার কারণ জানতে চাইলে ফারুক হোসেন নামের এক রিকশাচালক বলেন, “ভাই ভাড়া বেশি নিই, এভাবে কইলে কষ্ট লাগে। আপনারা না ভেজার জন্য কত কী করতেসেন, আর আমরা ভিইজ্যা রিকশা চালাইতেছি। ভিইজা অসুস্থ হলে রিকশা নিয়ে বাইর হইতে পারুম না। অন্য সময় তো ভাড়া বেশি চাই না!”
মোশাররফ নামের এক অটোরিকশাচালকও নিজের যুক্তি দিয়ে বললেন, ঝড়-তুফানের মধ্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় বেরিয়েছেন তারা। এ অবস্থায় একটু বাড়তি ভাড়া তো দিতেই হবে।
আবার যাত্রী পাচ্ছেন না বলেও অভিযোগ অনেক চালকের।
দুপুর ১ টার দিকে মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডে সিএনজি নিয়ে যাত্রীর অপেক্ষায় বসে ছিলেন আশরাফুল ইসলাম। সকাল ১১টার দিকে উত্তরা থেকে এক যাত্রী নিয়ে ধানমন্ডিতে এসেছিলেন তিনি। এরপর ২ ঘণ্টা এদিক-সেদিক ঘুরেও কোনও যাত্রী পাননি তিনি।
আশরাফুল বলেন, “সকালে অফিস টাইমে একটু যাত্রী ছিল। এরপর আর রাস্তায় যাত্রীর দেখা নাই। যে বৃষ্টি হইতেছে, খুব ঠেকায় না পড়লে কেউ ঘর থেকে বের হচ্ছে না।”
মেট্রোরেল চলাচলে বিঘ্ন
বৃষ্টির কারণে বিঘ্ন ঘটেছে মেট্রোরেল চলাচলেও। সকাল থেকে মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ ছিল। পরে সকাল ১০টা ৮ মিনিটের দিকে উত্তরা উত্তর স্টেশন থেকে একটি ট্রেন ছাড়ে। তবে সেটিও নির্ধারিত সময়ে মেনে চলতে পারেনি।
ফলে প্রতিদিন যারা মেট্রোরেল ব্যবহার করে কর্মস্থলে যান, তারা পড়েন বিপাকে।
শ্যাওড়াপাড়া মেট্রোস্টেশনের নিচে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে কথা হয় শাহবাগের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা জিল্লুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বললেন, এই আবহাওয়ায় এখন কীভাবে অফিসে পৌঁছবেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। মেট্রোরেল যে চলবে না সেটি আগে জানলে বিকল্প ব্যবস্থা বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগেই ভাবতে পারতেন।
জলাবদ্ধতার কবলে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান
রাস্তা ছাপিয়ে পানি ঢুকেছে ধানমণ্ডির হকার্স মার্কেটের ভেতরে। হাঁটুপানির মধ্যে ক্রেতাশূন্য মার্কেটে বসে আছেন দোকানীরা। পানির কবল থেকে কাপড় রক্ষা করাই এখন তাদের একমাত্র লক্ষ্য।
নবরুপা শাড়ি বিতানের কর্মচারি নাজমুস সাকিব বলেন, “সামনে ঈদ, বোঝেন তো সবই। এখন বৃষ্টির পানি দোকানের ভেতরে ঢুকে গেছে। বিক্রির চেয়ে এখন কাপড় রক্ষা করাই দায়। যেভাবে পানি বাড়ছে তাতে চিন্তায় পড়ে গেছি।”
ঢাকায় ক্ষয়ক্ষতি
ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে ঝড়ো বাতাসে উত্তরার জসীমউদ্দীন সড়কে একটি গাড়ির ওপর গাছ ভেঙে পড়ার ঘটনা ঘটেছে। শুধু উত্তরাতেই নয় ঢাকার বেশ কিছু এলাকায় গাছ ভেঙে পড়ার ঘটনা ঘটেছে। মিরপুর পাইকপাড়া এলাকায় সরকারি ডি টাইপ কোয়ার্টার এলাকায় বড় আকারের একটি কৃষ্ণচূড়া গাছ ভেঙে পড়ে। এ সময় ওই এলাকার চলাচলের সড়ক বন্ধ হয়ে যায়।
গাছ পড়তে দেখো গেছে মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডের কবরস্থানের সামনেও।
পরে ফায়ার সার্ভিস সদস্যরা এসব গাছ কেটে সরিয়ে যান চলাচলের প্রতিবন্ধকতা দূর করেন।
পুলিশের গুলশান ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার হাফিজুর রহমান বলেন, “সারাদেশেই বৈরি আবহাওয়া। সেই প্রভাব রাজধানীর সড়কেও পড়েছে। বৃষ্টির কারণে রাস্তার অনেক জায়গায় পানি জমে যাওয়ায় গাড়ি কিছুটা ধীর গতিতে চলছে। তবে তেমন যানজট হয়নি।”