প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেছেন, রাজপথে আন্দোলন করে আদালতের রায় পরিবর্তন করা যাবে না।
সরকারি চাকরিতে (প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি) মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের ওপর বুধবার এক মাসের জন্য স্থিতাবস্থা জারি করে আদেশ দেওয়ার সময় এ কথা বলে তিনি।
এ সময় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষেও ফিরে যেতে বলেন প্রধান বিচারপতি। যারা সড়কে অবস্থান নেওয়ায় রাজধানী ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ সব সড়ক নিশ্চল হয়ে পড়েছে।
আদেশের সময় প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, “সকল প্রতিবাদী কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদেরকে স্ব স্ব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরে গিয়ে নিজ নিজ কাজে অর্থাৎ পড়াশোনায় মনোনিবেশ করতে বলা হলো।”
তিনি বলেন, “দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মহোদয়, প্রক্টর ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান এবং তাদের ছাত্রছাত্রীদেরকে স্ব স্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফিরিয়ে নিয়ে শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করবেন মর্মে এই আদালত মনে করে।”
স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদকারী ছাত্রছাত্রীরা চাইলে আইনজীবীর মাধ্যমে তাদের বক্তব্য অত্র আদালতের সামনে তুলে ধরতে পারেন উল্লেখ করে প্রধান বিচারপতি বলেন, “আদালত মূল দরখাস্তটি নিষ্পত্তিকালে তাদের বক্তব্য বিবেচনায় নিবে।”
প্রধান বিচারপতি বলেন, “স্ট্যাটাস কো মানে হলো স্থিতাবস্থা, সবাই আপনারা তা জানেন। অর্থাৎ এটা নিয়ে আর কোনও কথা হবে না। লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) না আসা পর্যন্ত যার যার কাজে ফিরে যান।”
আদেশের আগে প্রধান বিচারপতি বলেন, “আমরা তো এই সমাজের মানুষ। কিছু কথা বলতে হয়। সেটা হচ্ছে যে, হাইকোর্টে একটা রায় হয়ে গেছে। আমাদের যে সকল ছাত্র-ছাত্রীরা যে আন্দোলন করছে, তাদের মনে একটা বিবাদ ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তারা বের করার পথ যেটা মনে করছে, তারা সেটাই করছে। তারা রাস্তায় নেমেছে। তারা যেটা করেছে তা সমর্থন করার মতো না। যাই হোক তারা আমাদেরই ছেলে মেয়ে।
“আমি প্রথম থেকে বলেছিলাম, রাস্তায় স্লোগান দিয়ে রায় পরিবর্তন হয় না। এটা আজকে না। আমি আরও একটি মামলায় ট্রাইব্যুনালে থাকতে বলেছিলাম। রাস্তায় স্লোগান দিয়ে রায় পরিবর্তন করতে পারবেন না। এর জন্য সঠিক পদক্ষেপ নেন।”
তিনি বলেন, “রাস্তায় যারা আন্দোলন করছেন, তাদের কিছু কথা তো আছে। তাদের এই কথাগুলো শুনবে কে? আমরা তো মানুষ। টেলিভিশন যখন দেখি টকশোতে কত কথা কতভাবে বলে। মনে হয় সমস্ত জ্ঞান তাদেরই। আর আমরা যারা এখানে আছি আমাদের কোনও জ্ঞানই নেই। এত কথা বলে উস্কানি দেওয়ার তো কোনও মানেই হয় না। বিষয়টির একটি সমাধান দরকার।”
এখন হাইকোর্ট বিভাগ একভাবে সমাধান করেছেন- একথা উল্লেখ করে প্রধান বিচারপতি বলেন, “সেটা সঠিক হয়েছে, কি সঠিক হয়নি- সেটা দেখার অধিকারটা কার? সেটা দেখার একমাত্র অধিকার সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের। আপিল বিভাগ ছাড়া কোনোভাবেই সম্ভব না। এই কথাটা এই বাচ্চাদের কেউ বলেন না কেন?”
এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, “যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, যারা বড় বড় জায়গায় আছেন- তারা কেন বলেন না, বাবা এটা তো পথ না। তোমরা যাও কোর্টে। কোর্টে কারও না কারও মাধ্যমে যাও, কোর্ট সেটা দেখবে। আমাদের ক্ষমতা আছে, আমরা হাইকোর্টের রায়টি বাতিল করে দিতে পারি।
“সরকারকে ডিরেকশন দিতে পারি। ইউ ডু ইট, ডোন্ট ডু ইট- দুইটাই বলতে পারি। আবার বলতে পারি, হাইকোর্টের রায় ঠিক হয়নি। আবার বলতে পারি ঠিক হয়েছে। কোনটা বলব সেটা হাইকোর্টের রায় দেখে। রায়টি আমাদের সামনে না আসা পর্যন্ত বলতে পারছি না।”
প্রধান বিচারপতি বলেন, “এই পর্যন্ত যা হয়েছে, এনাফ ইজ এনাফ। আমার মনে হয় রায়টি আমাদের সামনে আসুক, রায়টি আসলে আমরা প্রোপার মূল্যায়ন করব। তাই এই পর্যায়ে আমরা উভয়পক্ষের আইনজীবীদের শুনানি নিয়ে পর্যবেক্ষণসহ আদেশ দিচ্ছি। আদেশটি আমরা বাংলা ও ইংরেজিতে মিলিয়ে দিচ্ছি।”
হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে করা আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী শাহ মনজুরুল হক। শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন এবং রিট আবেদনকারীদের পক্ষে ছিলেন মুনসুরুল হক চৌধুরী।
অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন ও শাহ মনজুরুল হক আদালতের কাছে হাইকোর্টের রায় স্থগিত রাখার আবেদন জানান। রিট আবেদনকারীদের আইনজীবী মুনসুরুল হক চৌধুরী হাইকোর্টের রায় বহাল রাখার দাবি জানান।
আদেশের পরে অ্যাটর্নি জেনারেল যা বললেন
আদেশের পর অ্যাটর্নি জেনারেল আমিন উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, “নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা পদ্ধতি ছিল, পরবর্তীতে ২০১৮ সালে কোটা পদ্ধতির বিষয়ে একটি কমিটি করে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে সেটা বাতিল করে দেওয়া হয়। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির চাকরির ক্ষেত্রে সেটা বহাল থাকে।
“পরবর্তীতে এটা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে একটি মামলা হয়। সেই মামলায় শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট বিভাগ রায়ে কোটা পদ্ধতি বাতিলের প্রজ্ঞাপন বাতিল করে দিয়েছেন। অর্থাৎ হাই কোর্টের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে কোটা পদ্ধতি যেটা আগে ছিল, সেটাই আবার বহাল হয়ে যায়।”
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, “পরবর্তীতে এ রায়টি চ্যালেঞ্জ করে আমরা আপিল বিভাগে একটি আবেদন করি। যেহেতু রায়ের অনুলিপি পাওয়া যায়নি, তাই আমরা সিএমপি ফাইল করেছিলাম। সেই আবেদনের আজকে শুনানি হলো। আমরা কোর্টকে বললাম, এখনও রায়ের অনুলিপি পাইনি। রায় না পাওয়া পর্যন্ত আমরা কিছু করতে পারছি না।
“যেহেতু গত ৫ বছর ধরে কোটা পদ্ধতিটা বিলুপ্ত ছিল। সেই ক্ষেত্রে নতুন করে রায় না পাওয়া পর্যন্ত হাইকোর্টের রায়ের ওপর আমরা স্থগিতাদেশ চেয়েছিলাম। উভয়পক্ষকে শুনানি করে আপিল বিভাগ স্থিতাবস্থা দিয়েছেন। অর্থাৎ যে অবস্থায় আছে, সেই অবস্থায়ই থাকবে।
“অর্থাৎ চাকরি যেগুলো চলমান আছে, সেগুলো সবই ঠিক থাকবে।”
কোটা থাকছে, কি থাকছে না- এমন প্রশ্নের জবাবে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, “এখন যেহেতু স্থিতাবস্থা আছে, যেগুলা ছিল, সবগুলো থাকবে।”
আন্দোলনকারীদের প্ল্যাটফর্ম ‘বৈষ্যম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ বুধবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি একদিন আগেই ঘোষণা করেছিল।
শাহবাগে কেন্দ্রীয়ভাবে কর্মসূচি পালনের পাশাপাশি আগারগাঁও, গুলিস্তান, সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়, মালিবাগ, মহাখালীতে সড়কে অবস্থান নিয়েছে আন্দোলনকারীরা। তাতে এসব এলাকার সড়কে গাড়ি চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, “আন্দোলনকারীদের বিষয়ে আমি বলব, সুপ্রিম কোর্ট এটা বিবেচনায় নিয়েছেন, সুপ্রিম কোর্টের আদেশেও আছে আন্দোলনকারীদের কোনও বক্তব্য থাকলে তারা আইনজীবীর মাধ্যমে আপিল বিভাগে দিতে পারবে। তাই এখন আর যৌক্তিক কোনও কারণ নেই। এখন উচিত এটা বন্ধ করে নিজ নিজ অবস্থানে ফিরে যাওয়া। আন্দোলন আর করা জনদুর্ভোগ আর বাড়ানোর যৌক্তিক কোন কারণ নেই।”
কোটার প্রকৃত অবস্থা কি হলো এখন- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “আগে যে অবস্থায় ছিল সেই অবস্থায়ই আছে। স্থিতাবস্থা দেওয়া হয়েছে সাবজেক্ট ম্যাটারে। সাবজেক্ট ম্যাটারে এটা বাতিল করা ছিল। যে বিজ্ঞপ্তিগুলো রয়েছে, সেগুলোতে কোটা পদ্ধতি লাগবে না। নতুন করে কোনও বিজ্ঞপ্তি দিতে হলে, এখন আপাতত কিছু করবে না। মামলাটা আগামী ৭ আগস্ট শুনানি হবে, তখন ঠিক করবে এটা।”
আদালতে আইনজীবী মুনসুরুল হক চৌধুরী যা বলেছেন
রিট আবেদনকারীদের পক্ষের আইনজীবী মুনসুরুল হক চৌধুরী শুনানিতে বলেন, “৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা ছিল, যেখানে বলা ছিল ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের না পাওয়া যায়, তাহলে মেধাতালিকা থেকে নিয়ে বাকিটা পূরণ করা হবে। তারপর এটা চলমান থাকা অবস্থায় ২০১৮ সালে একটা আন্দোলন হয়। এই আন্দোলনের কারণে নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে একটা প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে কোটা পদ্ধতি বাতিল করা হয়।”
“মুক্তিযোদ্ধারা মেধাহীন- এটা নিয়ে স্লোগান হয়েছে”- এটাই তাদের আন্দোলনের মূল চাবিকাঠি ছিল বলেও শুনানিতে উল্লেখ করেন রিট আবেদনকারীদের এ আইনজীবী।
“আমার নিবেদন হলো- রায় পাওয়ার পরে লিভ টু আপিল দায়ের করা পর্যন্ত হাইকোর্টের রায় বহাল থাকুক”, বলেন তিনি।
সরকারি চাকরিতে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল করে জারি করা পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ এবং দুই শিক্ষার্থীর করা আবেদনের বিষয়টি শুনানির জন্য ছিল বুধবার। শুনানি শেষে আদেশ দেয় প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানসহ পাঁচ বিচারপতির আপিল বেঞ্চ ।
চেম্বার আদালতের অনুমতি নিয়ে মঙ্গলবার ওই আবেদন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিক সমিতির সভাপতি আল সাদী ভুইয়া ও উর্দু বিভাগের শিক্ষার্থী আহনাফ সাঈদ খান।
মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের এক রিট আবেদনের শুনানি শেষে গত ৫ জুন বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাইকোর্ট বেঞ্চ কোটা পুনর্বহাল করে রায় দেয়। পরে রাষ্ট্রপক্ষ রায়টি স্থগিত চেয়ে আপিল বিভাগে আবেদন করে। আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত গত ৯ জুন এ আবেদনটি শুনানির জন্য ৪ জুলাই নিয়মিত বেঞ্চে পাঠান। গত ৪ জুলাই হাইকোর্টের রায় স্থগিত না করে রাষ্ট্রপক্ষকে নিয়মিত লিভ টু আপিল দায়ের করতে বলে সর্বোচ্চ আদালত।
২০১৮ সালে কোটা পদ্ধতি বাতিল করার আগ পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে নিয়োগে ৫৬ শতাংশ পদ বিভিন্ন কোটার জন্য সংরক্ষণ করা হতো। এরমধ্যে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ছিল ৩০ শতাংশ, নারী ১০ শতাংশ, জেলা ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ৫ শতাংশ ও প্রতিবন্ধী ১ শতাংশ কোটা।
এই কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে ছয় বছর আগে ‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের ব্যানারে আন্দোলন গড়ে তোলেন শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা। সে সময় এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন নুরুল হক নুরসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
এ আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি পর্যালোচনা করতে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলমের নেতৃত্বে ২০১৮ সালের ২ জুন একটি কমিটি করে সরকার। সব কাজ শেষে সরকারি চাকরির প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে কোনো কোটা না রেখে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের নিয়ম চালু করতে ২০১৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কাছে সুপারিশ জমা দেয় কমিটি। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন পাওয়ার পর ৩ অক্টোবর তা মন্ত্রিসভার বৈঠকে তোলা হলে সেখানে কোটা বাতিলের বিষয়টি চূড়ান্ত হয়। পরদিন ৪ অক্টোবর কোটা পদ্ধতি বাতিল করে পরিপত্র জারি করেন জনপ্রশাসন সচিব।