ছাত্র সংসদ নির্বাচনের আগে হঠাৎ উত্তপ্ত হয়ে উঠল দেশের তিন প্রান্তের তিনটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়।
দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয়দের দফায় দফায় সংঘর্ষের পর জারি করা হয়েছে ১৪৪ ধারা।
পশ্চিমাঞ্চলের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাকসু নির্বাচনে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের ভোটাধিকারের দাবিতে ভাংচুর হয়েছে কোষাধ্যক্ষের কার্যালয়।
উত্তর-মধ্যাঞ্চলে ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) শিক্ষার্থীরা রেলপথ অবরোধ করে কৃষিবিদদের চাকরি সংশ্লিষ্ট দাবিতে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পরিবর্তিত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনগুলো যখন ছাত্র সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করছে, তখনই এমন সংঘাত দেখা দিল।
তবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহিংসতার সঙ্গে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের সংশ্লিষ্টতা থাকলেও অন্য দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তা নেই।
চবিতে ১৪৪ ধারা
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ বাধে শনিবার মধ্যরাতে।
হলে পর্যাপ্ত সিট না থাকায় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসের আশপাশের এলাকায় বিভিন্ন বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন, এগুলোর কোনোটিকে ‘হোস্টেল’, কোনোটিকে ‘কটেজ’ বলা হয়।
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমমে খবর এসেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ নম্বর গেটের কাছে জোবরা গ্রামে এমন একটি ছাত্রী হোস্টেলে এক নারী শিক্ষার্থী রাত ১২টার দিকে ঢুকতে গেলে ভবনের দারোয়ানের সঙ্গে তার তর্কাতর্কি থেকে সংঘাতের শুরু।

শিক্ষার্থীরা জানায়, দারোয়ান ও্ শিক্ষার্থীকে মারধর করলে ২ নম্বর গেটে থাকা অন্য শিক্ষার্থীরা তাকে মারতে গিয়েছিল। তখন দারোয়ানের পক্ষ নিয়ে স্থানীয়রা শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে ইট ছুড়তে থাকে। স্থানীয়রা লোকজন মাইকে ডেকে লোক জড়ো করে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়।
তবে স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, শিক্ষার্থীরা হামলা চালিয়ে বিভিন্ন ঘরবাড়ি ভাংচুর করেছে।
সোয়া ১২টা থেকে ভোর ৪টা পর্যন্ত বিদ্যালয়ের ২ নম্বর গেট এলাকায় সংঘর্ষ চলার পর সেনাবাহিনী গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।
ভোরে থামলেও ররিবার দুপুর ১২টার দিকে ফের ২ নম্বর গেট এলাকায় সংঘর্ষ শুরু হয়। দুই পক্ষের মধ্যে ইট ছোড়াছুড়ির মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মো. কামাল উদ্দিনসহ অন্তত ১০ শিক্ষার্থী আহত হয়েছে বলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছে।
প্রথম আলো জানায়, বেলা সাড়ে ১১টার দিকে এক প্রান্তে কয়েকশ শিক্ষার্থী অবস্থান নেয়। বিপরীত দিকে অবস্থান নেয় এলাকাবাসী। উপ-উপাচার্য (একাডেমিক) অধ্যাপক মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান, মো. কামাল উদ্দিন, প্রক্টর তানভীর মোহাম্মদ হায়দার আরিফসহ শিক্ষকরা দুই পক্ষকে বোঝানোর চেষ্টা করতে গিয়ে সংঘর্ষের মধ্যে পড়েন।
স্থানীয়রা প্রক্টর ও পুলিশের তিনটি গাড়ি ভাংচুর করে বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
দুপুরের সংঘর্ষের পর বেলা ২টা থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও এর আশেপাশের এলাকায় সব ধরনের জনসমাগম, সভা, সমাবেশ ও মিছিল নিষিদ্ধ করে স্থানীয় প্রশাসন।
স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া এক ফেইসবুক পোস্টে বলেছেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকার সচেষ্ট।
রবিবার দুপুরে দেওয়া ওই পোস্টে তিনি লিখেছেন, “পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকারের পক্ষ থেকে কড়া নির্দেশনা রয়েছে। ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। চবি ছাত্রনেতাদের সাথে যোগাযোগ করে জানা গেছে এখনও সংঘাত চলছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সহযোগিতা করুন। সন্ত্রাসীদের কোনভাবেই ছাড় দেওয়া হবে না।”

রাবিতে ভাংচুর
২৫ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠেয় রাকসু নির্বাচনের জন্য এখন মনোনয়নপত্র বিতরণ চলছে। তার মধ্যে রবিবার কোষাধ্যক্ষের কার্যালয়ে ভাংচুর চালানো হয়।
প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের ভোটাধিকারের দাবিতে ছাত্রদলের ঘেরাও কর্মসূচি থেকে এই ভাংচুর চালানো হয় বলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
বিবিসি বাংলা জানিয়েছে, সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ছাত্রদলের শতাধিক নেতা-কর্মী কোষাধ্যক্ষের কার্যালয় ঘেরাও করে।
ছাত্রদলের কর্মসূচির সঙ্গে একাত্মতা জানিয়ে ইউনিভার্সিটি টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় কমিটি ও রাবি শাখার কয়েকজন শিক্ষকও সেখানে অবস্থান নেয় সেখানে।
বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সভাপতি সুলতান আহমেদ রাহী সাংবাদিকদের বলেন, “প্রশাসন প্রথম থেকেই আমাদের দাবি মানতে অপারগতার কথা জানিয়েছে। আমরা শুরু থেকেই বলেছি, প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের ভোটাধিকার দিতে হবে। প্রশাসন তা মানেনি, তাই আজ আমরা কোষাধ্যক্ষের কার্যালয় ঘেরাও করেছি। দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।”
কোষাধ্যক্ষ সেতাউর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, “আজ সকাল থেকেই কার্যালয় ঘেরাও করেছে তারা, এখন আবার তালাবদ্ধ করে রেখেছে। আমি ভেতরে ঢুকতে পারছি না।”
আধা ঘণ্টা পর কার্যালয়ের ভেতরে ঢুকে মনোনয়নপত্র উত্তোলনের টেবিল ও চেয়ার ভাংচুর করে ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা।
রাকসু নির্বাচনের রবিবারই মনোনয়নপত্র বিতরণের শেষ দিন। কোষাধ্যক্ষের কার্যালয় থেকেই নির্বাচনের মনোনয়নপত্র বিতরণ হচ্ছে।
ছাত্রদলের ভাংচুরের পর এরপর ইসলামী ছাত্রশিবির, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরাসহ অন্যান্য সংগঠন এবং বিভিন্ন প্যানেলের সমর্থক শিক্ষার্থীরা মনোনয়ন উত্তোলনের দাবিতে ঘটনাস্থলে অবস্থান নিতে যায়। এতে উভয় পক্ষে ধস্তাধস্তিতে কয়েকজন আহত হয়।
কয়েক ঘণ্টা বন্ধ থাকার পর দুপুর ২টা থেকে আবারও মনোনয়ন বিতরণ শুরু হয় বলে জানিয়েছেন রাকসুর প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক এফ নজরুল ইসলাম।

বাকৃবিতে রেলপথ অবরোধ
তিন দফা দাবি আদায়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সকাল থেকে আড়াই ঘণ্টার বেশি সময় ধরে রেললাইন অবরোধ করে রাখে বলে ঢাকা-ময়মনসিংহ পথে ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে।
দাবি তিনটি হচ্ছে- নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া ছাড়া সরকার চাকরিতে নবম গ্রেডে পদোন্নতি দেওয়া যাবে না, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ডিএই, বিএডিসি ও অন্যান্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানের দশম গ্রেডের পদ যেমন উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা বা উপ-সহকারী বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বা সমমানের কৃষিবিদদের জন্য উন্মুক্ত করতে হবে। কৃষি বা কৃষি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে স্নাতক ছাড়া নামের পাশে কৃষিবিদ পদবি ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে হবে।
রবিবার সকাল সাড়ে ১১টা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের জব্বারের মোড়ে রেললাইনে শিক্ষার্থীরা অবস্থান নেন।
বিবিসি বাংলা জানায়, ঢাকাগামী হাওর এক্সপ্রেস ট্রেন আটকে দেন শিক্ষার্থীরা। পরে মানবিক কারণে দুপুর পৌনে ১টায় ট্রেনটি ছেড়ে দেন তারা। তবে এ সময় নেত্রকোণাগামী মহুয়া কমিউটার ট্রেন আটকে পড়ে।
কৃষিবিদ ঐক্য পরিষদ নামের একটি ব্যানারে এই কর্মসূচি পালন করছে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীরা বলছে, যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের দাবি মানা না হবে, অবরোধ চালিয়ে যাবে তারা।



