প্রাচীন এক আদিবাসী প্রবাদ দিয়ে আলাপখানি শুরু করা যাক। ‘‘যখন দেখবে পৃথিবীর শেষ গাছটি মরে গেছে, শেষ মাছটি হারিয়ে গেছে, কেবল তখনি বুঝবে টাকা খাওয়া যায় না।’’ টাকা কি আসলে খাওয়ার জিনিস? কিন্তু তারপরও এই দুনিয়া নাকি ‘টাকার দুনিয়া’। শৈশবে মজা করে খেলা হতো ‘‘পৃথিবী টা কার গোলাম?’’ বড় হয়ে টের পাচ্ছি শৈশবের ওই মজা মিথ্যা ছিল না। তবে সব মূদ্রা কি আর গোলামি টিকিয়ে রাখার হিম্মত রাখে। ডলারের দুনিয়ায় তাই আর সব মূদ্রা পকেট বা কোচরের গর্তে লুকিয়ে থাকে। ডলারের দাম বাড়লে তেলের দাম বাড়ে, মালিকের দাম বাড়ে। এই যে আমরা এখন মিলিয়ন বিলিয়ন গুণছি, মাত্র একশ বছর আগেও এসবে অভ্যস্থ হতে হয়নি। দরকারই পড়েনি। এই নিদারুণ নির্দয় ‘দরকার’ আমরাই তৈরি করেছি। মাটির কলিজা থ্যাৎলে ওঠানো তেল বা গ্যাস কিংবা পাহাড় চুরমার করে তোলা কয়লার হিসাব করতে আমাদের জটিল নৃশংস সব হিসাবের দরকার হয়েছে।
বাংলাদেশের বহু আদিবাসী ভাষায় এক থেকে বিশ পর্যন্তই কেবল সংখ্যা আছে। এর বেশি গুণতে হয়নি। মনে পড়ে কডা, কড়া, লালেং কিংবা মুসোহরদের ২০ পর্যন্ত সংখ্যার নাম জানতে গিয়ে কী মুশকিলেই না পড়তে হয়েছিল। ঠাকুরগাঁওয়ে মুসোহরপাড়ায় একবার লীলমনি ঋষিকে বলেছিলাম, ‘‘এক হাজার গুণতে পারবেন?’’ হাসতে হাসতে গড়াগড়ি বুড়ি আমার পিঠে ধাক্কা দিয়েছিল। কুড়ির বেশি হিসাব করা লীলমনির দরকার না হলেও, দুনিয়া আজ বেহিসাবী মুনাফার গোণাগুনতিতে কাহিল।
কিন্তু এই বেহিসাবী ভোগ-বাহাদুরি দুনিয়ার বৃহত্তম বন আমাজন থেকে চিম্বুকের মতো দক্ষিণ এশিয়ার এক টুকরো পাহাড়ও আজ আস্ত রাখছে না। আজ পরিস্থিতি এতটাই নির্মম এবং ভঙ্গুর, যে, পৃথিবী নামের গ্রহকে বাঁচানোর জন্য মানুষকে দেনদরবার করতে হচ্ছে। দাঁড়াতে হচ্ছে নিজেরই বিরুদ্ধে। নিজেকে থামাতে দাঁড়াচ্ছে মানুষ। ফ্লোরিয়েনসিস, ডেনিসোভান, ইরেকটাস কিংবা নিয়ানডার্থাল মানুষদের এমন ভঙ্গুর সময় সামাল দিতে হয়েছে কিনা আমরা জানি না। কিন্তু হোমো স্যাপিয়েন্স মানুষদের সামনে আজ দাঁড়িয়ে আছে নিজের তৈরি বিপদ।
এই বিপদের এক কেতাবি পরিচয় ‘জলবায়ু পরিবর্তন’। ১৯৯২ সালে বিশ্ব ধরিত্রী সম্মেলনে বিশ্ব নেতৃত্ব স্বীকার করেছে পৃথিবী এক গভীরতর অসুখে কাতর। গঠিত হয়েছে ‘ইউনাইটেড নেশনস ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ’ (ইউএনএফসিসিসি)। এই সংস্থাই ১৯৯৫ সালে জার্মানির বার্লিনে আয়োজন করে প্রথম জলবায়ু সম্মেলন ‘কপ-১’। আর সদ্য পেরিয়ে আসা ২০২৩ সালের ৩০ নভেম্বর থেকে ১৩ ডিসেম্বর সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইতে বসেছিল ২৮ তম জলবায়ু সম্মেলন, ‘কপ-২৮’। ২০০ টি দেশের ৮৫ হাজার প্রতিনিধি ১৩ দিনে তহবিল, অর্থায়ন, অভিযোজন, প্রতিশ্রুত অঙ্গীকার বিষয়ে তর্ক, বাহাস ও আলাপ জারি রাখেন সেখানে।
চলতি আলাপখানি জলবায়ু সংকট ও বিশ্বজুড়ে আদিবাসী মানুষের বহুমুখী বয়ানের এক বিরল সমন্বয়। দুবাই জলবায়ু সম্মেলনে অংশ নেওয়া দুনিয়ার নানাপ্রান্তের আদিবাসী মানুষদের জলবায়ু অভিজ্ঞতা ও প্রাণ-সঞ্জীবনী আলাপখানি পালক মেলছে।
প্রাণবৈচিত্র্য ও বাস্তুতন্ত্র পরিষেবা বিষয়ে আন্তঃসরকারি বিজ্ঞান-নীতি মঞ্চ ‘দ্য ইন্টারগর্ভমেন্টাল সইন্স-পলিসি প্ল্যাটফর্ম অন বায়োডাইভার্সিটি অ্যান্ড ইকোসিস্টেম’ (আইপিবিইএস)। ২০১২ সালের ২১ এপ্রিল ৯৪ টি রাষ্ট্রের সম্মতিতে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। আইপিবিইএস (২০১৯) প্রতিবেদন জানায়, নানামুখী চাপের ভেতরে থেকেও আদিবাসী ও স্থানীয় জনগণ কর্তৃক সুরক্ষিত প্রকৃতি অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় কম হ্রাস পাচ্ছে। আদিবাসী লোকায়ত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাসমূহ সুরক্ষা করা জরুরি। জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে কর্মরত জাতিসংঘের আন্তরাষ্ট্রিক সংস্থা আইপিসিসির (২০১৯) প্রতিবেদন জানায়, আদিবাসী লোকায়ত জ্ঞান ও কৃষি অনুশীলনগুলি জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা, প্রাণসম্পদ সুরক্ষা ও খাদ্য নিরাপত্তায় ভূমিকা রাখে। নিযুত গবেষণা, প্রমাণ ও দলিল হাজির থাকলেও আদিবাসী জ্ঞান, আত্মপরিচয় এবং নেতৃত্ব আজো অস্বীকৃত। জলবায়ু দেনদরবারে পৃথিবীকে জানাবোঝার লোকায়ত জীবনবীক্ষা এখনো দাগের বাইরে।
পানামার গুনা ও আদিকৃষির শিক্ষক:
আদিবাসী গুনারা পানামা ছাড়াও কলম্বিয়ার কিছু গ্রামে বসবাস করেন। পানামার সানব্লাস নামের এক ক্ষুদ্রদ্বীপে মূলত গুনাদের বসবাস। পানামা সিটি, কোলন, কুনা দ্য মাদুগান্ডি, কুনা দ্য ওয়ারগান্ডি এলাকাতেও গুনাদের দেখা যায়। গুনারা কুনা নামেও পরিচিত। গুনারা অবশ্য নিজেদের ‘দুলে বা তুলে’ নামে পরিচয় দেন, এর অর্থ ‘জনগণ’। গুনাদের ভাষাকে বলে ‘দুলেগায়া’। বাংলাদেশে সিলেটের পাত্র আদিবাসীরা যেমন নিজেদের ‘লালেং’ হিসেবে পরিচয় করান এবং মাতৃভাষাকে বলেন ‘লালেং ঠার’। গুনারা তাদের ঐতিহ্যবাহী উজ্জ্বল রঙিন তাঁতবস্ত্র মোলাসের জন্য বিখ্যাত। এই উজ্জ্বলতা বাংলাদেশে হাজংদের পাথিন, মণিপুরীদের ইনাফি কিংবা ত্রিপুরাদের রিগনাই পোশাকেও ঝিলিক দেয়। কৃষিকাজ, মাছধরা এবং ঐতিহ্যবাহী বস্ত্র উৎপাদনের মাধ্যমে গড়ে ওঠেছে গুনাদের অর্থনীতি। কলা, নারিকেল, সামুদ্রিক মাছ উৎপাদন করেন গুনারা। ওজব (নারিকেল) এবং স্কুনজিট (বড় চিংড়ি) গুনাদের এলাকা থেকে রপ্তানি হয়। গুনাদের আদিকৃষিরীতির অনুশীলনগুলো হাতে কলমে শেখান প্রবীণ নারী ব্রিসেইডা ইগলেসিয়াস । আলাপকালে জানান, জলোচ্ছ্বাস এবং লবণাক্ততা ক্রমাগত বাড়ছে। গুনা ভাষায় মাটিকে বলে ‘ঞিয়াব’ এবং মাতৃদুনিয়াকে বলে ‘ঞিয়াবগুয়ানা’। লবণাক্ততার কারণে মাটির ‘মারউই’ বা উর্বরতা বিনষ্ট হচ্ছে। তিনি ইউক্যালিপটাস গাছ ও বিভিন্ন ভেষজ চারা লাগিয়ে লবণাক্ততার মাত্রা কমানোর নানা আদি অভিযোজন নিয়ে কাজ করছেন।
আমাজন বনের গুয়ারানি আদিবাসী:
বিশ্বের সর্ববৃহৎ অরণ্য আমাজনের গুয়ারানি আদিবাসীরা ‘গুয়ারানি-কাইয়ুয়া’ নামেও পরিচিত। আবার অনেক জায়গায় কাইয়্যুয়া, কাইনগুয়া, কাইয়্যুয়া, কেউয়া, কাইয়ভা, কিয়বা কিংবা কেওভা নামেও পরিচিত। কারণ বিভিন্ন সময়ে ইউরোপীয়দের কারণে এতো বহুমুখী উচ্চারণ তৈরি হয়েছে। প্যারাগুয়ে, ব্রাজিল এবং উত্তর-পূর্ব আর্জেন্টিনা অংশে তাদের মূল বসতি। ব্রাজিলের মাটো গ্রসো দ্যু সুল এলাকায় গুয়ারানিদের বসবাস বেশি। গুয়ারানি-কাইয়ুয়াদের ‘কাইয়ুয়া’ নামের অর্থ ‘জনগণ বা মানুষ’। গুয়ারানিদের আদি বিশ্বাসমতে ঈশ্বর ‘নান্দি রূ’ পৃথিবীতে প্রথম গুয়ারানিদের সৃষ্টি করেছেন পবিত্র গোষ্ঠী হিসেবে। গুয়ারানিদের প্রতিটি এলাকায় একটি পবিত্র প্রার্থনাস্থল থাকে, সমাজের একজন শামান (পুরোহিত) এর দেখভাল করেন। শিকার, চাষবাস, মাছধরা এবং কবিরাজি গুয়ারানি জীবনজীবিকার উৎস। গুয়ারানিদের সমাধিস্থলকে বলে ‘তেরা সেম মাল’ মানে ‘যে ভূমিতে শয়তান থাকে না’। আমাজন এলাকায় নানা উন্নয়ন কর্মসূচির কারণে সবকিছুর সাথে গুয়ারানিদের সমাধিস্থলও হুমকির মুখে। যেখানে ঘুমিয়ে আছেন তাদের প্রিয় প্রিয়জন পবিত্র মানুষেরা। সেই সমাধিস্থল হারানোকে গুয়ারানিরা তাদের ধর্ম ও বিশ্বাসের ওপর আঘাত মনে করেন। গুয়ারানি নেতা ভালডিলাইস ভেরন পরিবেশ-গণহত্যা বিরুদ্ধে কাজ করেন। আলাপকালে জানান, বর্ষারণ্যে নিয়মিত বর্ষা কমছে এবং বৃষ্টি অনিয়মিত হচ্ছে। পাশাপাশি নানাবিধ বাণিজ্যিক কর্মসূচি আমাজন বনকে দখল করে আছে। পৃথিবীকে বাঁচাতে হলে অবশ্যই আমাদের আমাজন বনকে বাঁচাতে হবে।
কর্ডিলারার ইগরট আদিবাসী:
ফিলিপাইনের উত্তরাঞ্চলের লুজনে অবস্থিত কর্ডিলারা পৃথিবীর এক বিরল ধান অঞ্চল। পাহাড়ের ধাপে ধাপে ধানের জমিন। বাংলাদেশের রাংটিয়া ও মধুপুর শালবনের চালায় ভাদ্র-আশ্বিনে কিছুটা এমন দৃশ্য দেখা যেত। ১৯৫০ সালে রাষ্ট্র এসব অঞ্চলে জোর করে জুমআবাদ নিষিদ্ধ করে। মান্দি, কোচ, হাজং, ডালু, বানাই মানুষেরা সেই অধিকার হারিয়েছেন। এখন কেবল পার্বত্য চট্টগ্রামে জুমের সময় এমন দৃশ্য কিছু টিকে আছে। কর্ডিলারার ইগরট আদিবাসীরা অবশ্য ধান আবাদের বিশেষ ধরণটি ধরে রাখতে পেরেছেন। ইগরট আদিবাসীরা ইফুগাও বা ইপুগাও নামেও পরিচিত। ইগরট নামটি এসেছে ‘ইগলত’ থেকে, মানে ‘পাহাড়ের মানুষ’। বাংলাদেশে ‘হাচেক মান্দি’ বলতে গারোরা ‘পাহাড়ের মানুষ’ বুঝেন, কিংবা ‘মিজো’ মানেও ‘পাহাড়ের সন্তান’। তরুণ ইগরট নেতা ঞেডলয়েড ইয়াংয়েড আলাপকালে জানান খনিজ উত্তোলনের নামে তাদের বন দখল করা হচ্ছে এবং সামরিক এলাকা বৃদ্ধি পাচ্ছে। চাষাবাদের এলাকা ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে, পাশাপাশি অনাবৃষ্টি এবং অনিয়মিত বর্ষা বাড়ায় ধানের বৈচিত্র্য বিনষ্ট হচ্ছে।
কোস্টারিকার কাবিকার জনগোষ্ঠী:
দক্ষিণ আমেরিকার দেশ কোস্টারিকা। কোস্টারিকার বৃহৎ আদিবাসী গোষ্ঠীর নাম কাবিকার। জনসংখ্যা প্রায় ১৭,০০০। প্রত্যন্ত অঞ্চল তালামাংকায় মূল বসতি। যদিও বর্তমানে রিও কোয়েন থেকে রিও রাভেনটাজন অবধি এর বিস্তৃতি ঘটছে। নদী উপত্যকার এই কাবিকার-ভূমি পৃথিবীর এক উল্লেখযোগ্য বৈচিত্র্যময় বাস্তুতন্ত্র। মাতৃসূত্রীয় কাবিকার মূলত কৃষি বন ও বাগানের ওপর নির্ভরশীল। সিডার, লাওরেল, বালসা, পিচ পামের মতো উঁচু গাছের দেখা মেলে কেবল কাবিকার এলাকাতেই। কফি, কোকো, মরিচ, শিমুলআলু ও নানা ফলফলাদি চাষ করেন তারা। বাংলাদেশের খাসি জনগোষ্ঠী যেমন বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের পাহাড়ি টিলায় পানজুম গড়ে তুলেছেন। পান, লেবু, সুপারি, গোলমরিচ, শিমুলআলু, ফলমূল চাষ হয় পানজুমে। খাসিপুঞ্জিতেই উঁচু গাছের সারি ও বৃক্ষবৈচিত্র্য দেখা যায়। কাবিকার প্রতিনিধি মারিছেল্লা ফার্নান্দেজ জানান, তাপমাত্রা ক্রমশ বাড়ছে এবং আর্দ্রতা কমে যাচ্ছে, এমন আবহাওয়া বড় গাছের বীজের অংকুরোদগম কমিয়ে দিচ্ছে।
মায়া সভ্যতার মায়া:
হরপ্পা, মহেঞ্জোদারো, মিশর, মেসোপটেমীয়, গ্রিক, রোমান, সিন্ধু, ওয়ারী-বটেশ্বর কিংবা ইনকার মতোই দক্ষিণ আমেরিকার প্রাচীন সভ্যতা মায়া। বহু প্রাচীন মন্দির স্থাপত্য, বর্ষপঞ্জিকা, গণিত, শিল্পকলা, জ্যোর্তিবিদ্যা এবং লিখিত পাণ্ডুলিপির জন্য এই সভ্যতা জগত বিখ্যাত। মায়া জনগোষ্ঠী ঐতিহাসিক মায়া সভ্যতা বিকশিত করেছিলেন। যদিও তারা নিজেদের প্রাচীনকাল থেকে ‘মায়া’ নামে অভিহিত করেননি, কিন্তু বর্তমানে ‘মায়া’ পরিচয়টি একটি একক প্রত্যয় হিসেবে মায়াসভ্যতার উত্তরাধিকারদের বোঝানো হয়। বৃহৎ অর্থে মায়াদের মেসো-আমেরিকার আদিবাসী হিসেবে অভিহিত করা হয়। গুয়াতেমালা, মেক্সিকো, বেলিজ, এল সালভাদর, নিকারাগুয়া ও হন্ডুরাসে প্রায় ৭ লাখ মায়া’র বসবাস। গুয়াতেমালার মায়া আদিবাসীদের বিশ্বাস পরমেশ্বর ইৎজাম্মা দুনিয়া সৃষ্টি করেছেন। দেবতা ছাআকস ঝড়, বজ্রপাত ও বৃষ্টিপাত নিয়ন্ত্রণ করেন। মায়া কৃষক মারিয়া পেডরো আলাপকালে জানান, প্রতিনিয়ত ঝড় বাড়ছে এবং একইসাথে অনিয়মিত বৃষ্টি বেড়েছে। গরমেরকালে আর্দ্রতা বেশি থাকে। পাহাড়ি এলাকায় আলুর বৈচিত্র্য এই আবহাওয়ায় টিকিয়ে রাখা কঠিন।
রাশিয়ার বরফ রাজ্যের ইভেংকি:
উত্তর এশিয়ার রাশিয়া, মঙ্গোলিয়া ও চীনের এক যাযাবর শিকারজীবী ও পশুপালনজীবী আদিবাসী জনগোষ্ঠীর নাম ইভেংকি। যারা একইসাথে ইভেংক বা ইওয়েংকি নামেও পরিচিত। মঙ্গোলিয়াতে এরা খামনিগান নামে পরিচিত। রাশিয়ার উত্তরাঞ্চলে ইভেংকির সংখ্যা প্রায় ৩৮ হাজার। সাইবেরিয়ার বরফাচ্ছিত বিশাল অঞ্চল বৈকাল হ্রদ এবং আমুর নদীর অববাহিকায় মূলত এদের বাস। ইভেংকির ভাষার সাথে সাইবেরিয়ার ইভেন এবং নেগিডাল আদিবাসীদের ভাষার মিল আছে। মূলত বল্গাহরিণের দুধ, মাংস, চামড়ার ওপর ইভেংকিদের জীবিকা নির্ভরশীল। ইভেংকিদের ভেতর ঘোড়া ও বিশেষ জাতের গরু পালনও করতে দেখা যায়। আলাপ হয় ইভেংকি বল্গাহরিণ শিকারি ভিয়াচেস্লভ সাদ্রিন এবং ‘ইলকেন’ নামের আদিবাসী বিষয়ক এক স্থানীয় পত্রিকার সম্পাদক আন্দ্রেই ইসাকভের সাথে। তারা জানান, তাপমাত্রা বাড়ছে এবং বরফ গলছে, বসন্তকালে খুব সমস্যা দেখা দিচ্ছে, হরিণের খাদ্য সংকট দেখা দিচ্ছে। সামনে অনেক বিপদের ইলকেন (চিহ্ন)।
মাসাইমারা উদ্যানের মাসাই:
পৃথিবীর ১০টি গুরুত্বপূর্ণ বন্যপ্রাণী সংরক্ষিত অঞ্চলের অন্যতম কেনিয়ার মাসাইমারা জাতীয় উদ্যান। তাঞ্জানিয়ার সেরেংগেটি জাতীয় উদ্যানও এর সাথে যুক্ত। সিংহ, চিতা বাঘ, কালোচিতা, হাতি, জিরাফ, জেব্রার এক অন্যতম বিচরণস্থল মাসাইমারা। মাসাইমারা মূলত মাসাই আদিবাসীদের ঐতিহ্যগত ভূমি। মাসাইদের মাতৃভাষা ‘মাআ’। মাআ ভাষার সাথে ডিংকা এবং কালেনজিন মাআ ভাষা থেকেই ‘মাসাইমারা’ নামটি এসেছে। ‘মারা’ মানে বিন্দু বিন্দু দাগ। কেনিয়ার বিস্তীর্ণ মরু অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে জেগে থাকা ঝোপ-গুল্ম গুলো দেখতে বিন্দু বিন্দু দাগের মতো। মাসাইরা মূলত নীল নদ অববাহিকার আদি মানুষ। জেবু জাতের গরুর পাল নিয়ে মাসাইরা দলগতভাবে বছরব্যাপী বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে বেড়ায়। মাংস, দুধ, মধু, চামড়াজাত সামগ্রী এবং পুঁতির অলংকার মাসাই জীবিকার অন্যতম উৎস। ২০১৯ সালের জনশুমারিতে মাসাইদের জনসংখ্যা দেখানো হয়েছে প্রায় ১২ লাখ। কিন্তু রাষ্ট্রীয় এই শুমারি প্রক্রিয়া নিয়ে মাসাইরা বহু বিতর্ক তুলেছেন। আদিবাসী এই জনশুমারি নিয়ে বাংলাদেশে পঞ্চাশ বছর ধরে তর্ক আছে। সর্বশেষ জনশুমারিতে বাংলাদেশে রাজশাহীর কডা জনগোষ্ঠীর নাম এবং জনসংখ্যা অর্ন্তভূক্তই করা হয়নি। আবার নিদারুণভাবে আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউট জানায়, কডা ভাষা দেশের একটি বিপন্ন ভাষা। আদুমু নামে মাসাইদের লম্ফনৃত্য কিংবা বাংলাদেশের মান্দিদের গ্রিকা ও চাম্বলমিসা নাচ শক্তি ও বীরত্বকে তুলে ধরে। আলাপ হয় মাসাইমারার ঐতিহ্যগত চিকিৎসক নায়লা মুসিয়েনি ওলে সিওয়ানটের সাথে। পাঁচজন নারী নিয়ে বন থেকে ঔষধি গাছ সংগ্রহ করেন এবং গর্ভবতী নারীদের চিকিৎসা দেন তিনি। আশেপাশে কোনও হাসপাতাল নেই, বুনো ঝোপই হাসপাতাল। সিংহ, জিরাফ, জেব্রার সাথে বসবাস করেন। পরিবেশ সুরক্ষায় মাসাইদের বেশকিছু নিয়ম আছে। তারা বড় গাছ কাটেন না। কারণ তারা বিশ্বাস করেন, গাছ কাটলে মাটির নিচে পানি পাওয়া যাবে না এবং বৃষ্টিপাতও কমে যাবে। বহিরাগত মানুষ নির্বিচারে গাছ কাটছে এবং বন্যপ্রাণীর অবৈধ বাণিজ্য করছে। এসব কারণে মানুষ ও বন্যপ্রাণীর ভেতর দ্বন্দ্ব তৈরি হচ্ছে। এমনকি বর্তমানে বৃষ্টির পরিমাণ কমে খরা বাড়ছে। সবার জীবনই দূর্বিষহ হয়ে উঠছে।
ব্রাজিলের নদী অববাহিকার কারিপুনা:
ব্রাজিলের আমাপা এলাকার মূলত কারিপি নদী অববাহিকায় এক আদিবাসী জনগোষ্ঠীর নাম কারিপুনা। জনসংখ্যা প্রায় তিন হাজার। কারিপুনা এলাকার বাস্তুতন্ত্র বিনাশ করে মহাসড়ক, সেতুসহ নানা বৃহৎ স্থাপনা তৈরি হচ্ছে। এর ফলে কারিপুনাদের উচ্ছেদ হতে হয়। ওয়াপুক সেতু নির্মাণের কারণে উইয়াপুক এলাকা থেকে কারিপুনাদের উচ্ছেদ হতে হয়েছে। বাংলাদেশে যেমন কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ উন্নয়ন প্রকল্প, রংপুর-মহিমাগঞ্জ চিনিকল কিংবা পায়রা বন্দর নির্মাণের কারণে চাকমা, সাঁওতাল এবং রাখাইন আদিবাসীদের উচ্ছেদ হতে হয়েছে। প্রাকৃতিক কৃষি এবং মাছ ধরার মাধ্যমেই কারিপুনাদের জীবিকা নির্বাহ হয়। কারিপুনা নেতা লুয়্যেন আনিকা দস সান্তোস আলাপকালে বলেন, উন্নয়নের মাধ্যমে আদিবাসী বসত উচ্ছেদ বন্ধ করা দরকার। তা না হলে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় গৃহীত কোনও প্রকল্পই সুফল বয়ে আনবে না।
পেরুর জংগলের আগুয়ারুনা:
আগুয়ারুনা বা আওয়াজুনরা পেরুভিয়ান জংগলের আদিবাসী। পেরুর উত্তর এবং ইকুয়েডর সীমান্তে প্রবাহিত মারানন নদী অববাহিকায় মূলত এরা বসবাস করেন। বাংলাদেশে তঞ্চংগ্যা ও চাকমা আদিবাসীরা যেমন বসতি গড়ে তুলেন বড় কোনও নদীর অববাহিকায়। আগুয়ারুনাদের মোট জনসংখ্যা প্রায় আট হাজার। প্রাচীন ইনকা সভ্যতার উত্তরাধিকারী তারা। লম্বা বাঁশের নল ব্লোপাইপের ভেতর বিষমাখা তীর ভরে মুখ দিয়ে ফু দিয়ে শিকারে আগুয়ারুনারা বেশ পটু। এক ধরনের শক্ত পাম গাছের কাঠের তৈরি ‘পিজুআইয়্যু’ দিয়েও তারা শিকার করে। মাংস, চামড়া, দাঁত, শিং, পালক, হাড় বন্যপ্রাণীর নানাকিছু আগুয়ারুনাদের জীবনজীবিকার অন্যতম উৎস। ব্রাজিল টাপির, সাজিনো, লাল ব্রোকেট, ওসিলট, জাগুয়ার, মাজাজ, রনসকো, আচুনি, আনুজি, ভোঁদড় ও নানা প্রজাতির বানর ও পাখি আগুয়ারুনাদের বাঁচিয়ে রাখে। উভিল্লাসহ নানা বুনো পাম ফল, বাকল, কাণ্ড ও রেজিন সংগ্রহ কিংবা বন থেকে মধু, মোম, ভেষজ, পতঙ্গ, লিয়ানা লতা সংগ্রহ তাদের অন্যতম কাজ। বর্ষারণ্যের উদ্ভিদ ও প্রাণীকুল নিয়ে আগুয়ারুনাদের বিস্তর জ্ঞান জনউদ্ভিদ ও জনপ্রাণিবিদ্যা গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। জনউদ্ভিদবিদ্যা গবেষণায় নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেও দেখেছি, অরণ্য ও স্থানীয় প্রাণবৈচিত্র্য নিয়ে বাংলাদেশের আদিবাসীদের বিস্তর জ্ঞান কোনওভাবেই কোনও প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যায়তন দিতে পারবে না। চাষাবাদের জন্য আগুয়ারুনারা পিজ্যুআইয়্যু গাছের ডাল দিয়ে বানানো সূঁচালো ‘ওয়াই’ ব্যবহার করে। বাংলাদেশের মান্দি বা গারো জনগোষ্ঠী হাবাহুয়া বা জুমআবাদের জন্য বাঁশের তৈরি ‘গোসা’ ব্যবহার করেন। আগুয়ারিনা পরিবেশকর্মী ইভিলিন ইসাবেল মলিনা রড্রিগুয়েজ আলাপকালে জানান, বর্ষারণ্যের পিচ পাম ফল গবাদি প্রাণিসম্পদের প্রধান খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং মাছের খাদ্য হিসেবেও অনেকে ব্যবহার করেন। তাপমাত্রা বেড়ে শুষ্কতা বেড়ে যাওয়ায় পিচ পাম গাছের গোড়া ছত্রাকজনিত রোগে বেশি আক্রান্ত হয়।
আদিবাসী সঞ্জীবনী সুরক্ষিত হোক:
কেনিয়ার মাসাইমারা থেকে আগত ‘ইন্ডিজিনাস পারসন্স উইথ ডিজ্যাবিলিটি গ্লোবাল নেটওয়ার্ক’-এর প্রতিনিধি থমাস ছুরুরু এবং মানাশে সাইটুটি নাটুটুর সাথে দুবাই জলবায়ু সম্মেলনে আলাপ হয়। তারা জানান, ‘‘…যেকোনও সামাজিক নিরাপত্তাবলয়ে আদিবাসীরা পেছনে পড়ে থাকে, এক্ষেত্রে আদিবাসী প্রতিবন্ধী মানুষদের কোনোও মূল্যায়নই করা হয় না।’’
দুনিয়ার সবচে বড় বন আমাজনে প্রায় পাঁচ শতাধিক আদিবাসী জাতির বাস। ব্রাজিল, ইকুয়েডর, পেরু অঞ্চলে বিস্তৃত এই বনের অন্যতম প্রাণ সঞ্জীবনী হচ্ছে এখানকার নানা নদী, ঝর্ণা ও জলধারা। এই জলধারা আদিবাসীদের কাছে পবিত্র। আমাজন বনের পবিত্র জলধারা সুরক্ষায় কর্মরত ‘দ্য আমাজন সেক্রেড হেডওয়াটার্স অ্যালায়েন্স’-এর মুখপাত্র গ্রেগরিও দিয়াজ মিরাবাল ‘কপ-২৮’ উপলক্ষ্যে প্রকাশিত তাদের এক পুস্তিকায় লিখেছেন, ‘‘…যেখানে আদিবাসীরা বসবাস করে, সেখানেই বন আছে। বন ও নদীর সাথে আদিবাসীদের সম্পর্ক কয়েক বছরের নয়, এই সম্পর্ক সহস্র বছরের। আমরা সবাই মিলে একটি বৃহৎ পরিবার। বন আমাদের কাছে মায়ের মতো, কারণ এই বন আমাদের দেখে রাখে’’। ‘ইন্ডিজেনাস উইমেন বায়োডাইভার্সিটি নেটওয়ার্ক’-এ প্রতিনিধি ফিফিয়ান জেপ্টো জানান, ‘‘.. আদিবাসী সমাজগুলো মূলত কৃষি ও পশুপালনের উপর নির্ভরশীল। আদিবাসী জীবনের লোকায়ত জ্ঞান ও উৎপাদন ব্যবস্থা বাস্তুতন্ত্র সুরক্ষা করে। এই উৎপাদন মাটিতে জৈব শক্তি বাড়ায়। কিন্তু বাস্তুতন্ত্র বিনষ্ট হওয়ার কারণে বিশ্বব্যাপী আদিবাসীরা চরম ঝুঁকিতে আছে’’। সুদানের ‘জিনাব ফর উইমেন ইন ডেভলপমেন্ট’-এর প্রতিনিধি ফাতিমা আহমেদ বলেন, ‘‘পরিবেশ সুরক্ষায় আদিবাসীদের লোকায়ত জ্ঞান খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু জলবায়ু অভিযোজন বিষয়ক বৃহৎ প্রকল্পগুলো আদিবাসীদের লোকায়ত জ্ঞান ও চর্চাকে কোণঠাসা করে রাখে। বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধারে আদিবাসীদের জ্ঞানকে স্বীকৃতি দেওয়া জরুরি।’’
আদিবাসীরা সহস্র বছরের প্রাচীন চর্চাগুলো টিকিয়ে রাখার জন্য লড়াই করছে। এসব চর্চা উদ্ভিদ ও প্রাণীর সহাবস্থানকে সমর্থন করে। আদিবাসীরা পৃথিবীর যত্ন নিতে জানে এবং পৃথিবীকে পবিত্র হিসেবে বিশ্বাস করে। ‘এআইপিপি’ প্রতিনিধি বাংলাদেশের চন্দ্রা ত্রিপুরা বলেন, ‘‘.. প্রকৃতির সাথে আমাদের একটা আত্মিক সম্পর্ক আছে। নদী পার হতে গেলে আমরা নদী দেবতাকে স্মরণ করি, পবিত্র বন থেকে কোনও কিছু আনতে হলে প্রকৃতির কাছে অনুমতি প্রার্থনা করি। আদিবাসীদের প্রথাগত ভূমি রাষ্ট্র এবং কোম্পানিগুলো উন্নয়নের নামে দখল করছে। একইসাথে মানবসৃষ্ট জলবায়ু সংকটে আমরা এখন দিশেহারা। প্রবীণরা ছাড়া নতুন প্রজন্মের কেউ আমাদের লোকায়তবিদ্যা জানছে না। কারণ এখন আগের দিনের ভেষজ গাছ নেই, কীভাবে এই জ্ঞান তাহলে আমরা সুরক্ষা করব?’’
আদিবাসী কী অ-আদিবাসী সর্বজনের ঐক্য ও সংহতি ছাড়া লোকায়ত জ্ঞান ও প্রাণবৈচিত্র্যনির্ভর আদিবাসী সঞ্জীবনীর সুরক্ষা অসম্ভব। আর এই সঞ্জীবনী হারালে আমরা পৃথিবীকে বাঁচাতে পারব না। জলবায়ু সম্মেলনে গৃহীত ঘোষণা, তহবিল কিংবা অর্থায়নের অঙ্গীকার কি পৃথিবীর সব আদিবাসীদের গ্রামে পৌঁছবে? এই সিদ্ধান্ত বৈশ্বিকভাবে এবং স্ব স্ব জাতিরাষ্ট্রকেও রাজনৈতিকভাবে নিতে হবে।
লেখক: প্রাণ ও প্রতিবেশ বিষয়ক গবেষক ও লেখক।
ই-মেইল: animistbangla@gmail.com