জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা, ভৌগোলিক অখণ্ডতা ও সামাজিক স্থিতিশীলতা গভীর হুমকিতে পড়ছে বলে জানিয়েছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়া, উপকূল ধ্বংস করা এবং জলবায়ুজনিত বাস্তুচ্যুতির কারণে আগামী কয়েক দশকের মধ্যে বাংলাদেশকে তার মানচিত্র নতুনভাবে আঁকতে হতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
সোমবার ঢাকার ডিফেন্স সার্ভিসেস কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজে ‘জাতীয় নিরাপত্তার ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব’ শীর্ষক এক সেশনে পরিবেশ উপদেষ্টা এসব কথা বলেন।
বক্তব্যে তিনি জানান, শতকের মাঝামাঝিতে এক মিটার সমুদ্রপৃষ্ঠ উচ্চতা বাড়লে ২১টি উপকূলীয় জেলা ডুবে যেতে পারে। তাতে গৃহহীন হবে কোটি মানুষ। কৃষি ও মাছ চাষে ব্যবহৃত নদীগুলোতে ঢুকে পড়বে লবণাক্ত পানি।
তিনি বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তন মানে শুধু মিঠা পানি লবণাক্ত হয়ে যাওয়া নয়। এর মানে আমাদের ভূখণ্ড হারানো, জনগোষ্ঠী নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া এবং সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হওয়া।”
২১০০ সালের মধ্যে ৫২টি ছোট দ্বীপ রাষ্ট্র, যেমন মালদ্বীপ, সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশের অবস্থা আরও সংকটাপন্ন মন্তব্য করে তিনি বলেন, দেশের ৬৫ শতাংশ মানুষ আমিষের চাহিদা মেটাতে মিঠা পানির মাছের ওপর নির্ভরশীল। লবণাক্ততা এই জীবনরেখা ধ্বংস করে দিতে পারে। সেইসঙ্গে বাংলাদেশ প্রতিবছর বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও খরার কারণে জিডিপির ১ শতাংশ হারাচ্ছে। ২০৫০ সালের মধ্যে এ হার দ্বিগুণ হতে পারে। ফসলহানি, পানির সংকট ও গণ-বাস্তুচ্যুতি সংঘাত সৃষ্টি করবে বলেও তিনি সতর্ক করেন।
“বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ ডুবে গেলে, বাকি দুই-তৃতীয়াংশে প্রচণ্ড চাপ পড়বে। অস্থিরতা তখন স্বাভাবিক হয়ে উঠবে।” বলেন তিনি।
বক্তব্যে তেলসমৃদ্ধ দেশের কৌশলগত বিরোধিতা, কিয়োটো চুক্তির ব্যর্থতা ও প্যারিস চুক্তির দুর্বল বাস্তবায়ন নিয়েও সমালোচনা করেন তিনি।
জলবায়ু ঝুঁকিতে সপ্তম অবস্থানে থাকা একটি দেশ বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি ভুগছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ২০২৪ সাল ছিল এ যাবৎকালের সবচেয়ে উষ্ণ বছর। সমুদ্রের উষ্ণতা ও হিমবাহ গলনের হার দ্বিগুণ হয়েছে।
তিনি বলেন, “এক্ষেত্রে বিশ্বের নিষ্ক্রিয়তা আমাদের মতো দেশের জন্য মৃত্যুদণ্ড। সব দেশ তাদের প্রতিশ্রুতি পূরণ করলেও তাপমাত্রা ৩ থেকে ৪.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বাড়বে- যা মানবজাতির জন্য সহনশীল মাত্রার থেকে অনেক বেশি।”
এ সময় তিনি বাংলাদেশের জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনার কথা বলেন, যেখানে ১১টি জলবায়ু ‘চাপ অঞ্চল’ চিহ্নিত করা হয়েছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে ২০৫০ সালের মধ্যে ২৩ হাজার কোটি ডলার প্রয়োজন বলেও জানান তিনি। তবে তিনি বলেন, “শুধু অর্থ নয়, উন্নয়নের ধরনই পাল্টাতে হবে।”
এজন্য তিনি নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর জোর দেন। যেমন, নেপাল থেকে জলবিদ্যুৎ আমদানি। ভবন নির্মাণেও তিনি প্রাকৃতিক বায়ুপথ ও প্রাকৃতিক আলো ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দেন। পরিবেশ আইন কঠোরভাবে প্রয়োগের আহ্বান জানান তিনি। উপকূলীয় নারীদের লবণাক্ত পানির ক্ষত এবং কৃষকদের আশাহীনতার কথা তুলে বলেন, “তাদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসন পরিকল্পনা প্রয়োজন।”
রিজওয়ানা হাসান বলেন, “এটা শুধু গাছ বাঁচানোর লড়াই নয়—এটা দেশ বাঁচানোর লড়াই। আমরা ব্যর্থ হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এক ভিন্ন বাংলাদেশ পাবে, যা আজকের মানচিত্রে কল্পনাও করা যায় না।”



