বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টা। ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের হাজতখানার সামনে ছিল মানুষের উপচেপড়া ভিড়। তাদের অনেকেই সকাল ৯টা থেকে আছেন এই হাজতখানার সামনে। তারা অপেক্ষায় করছিলেন পুলিশ ভ্যানের, যাতে থাকতে পারে তাদের স্বজন, প্রিয়জন।
১১টার দিকে একে একে ঢাকার বিভিন্ন থানা থেকে আসামিদের নিয়ে আসতে থাকে পুলিশ ভ্যান। একটা পুলিশ ভ্যান দেখলেই ছুটে যাচ্ছিলেন স্বজনরা। গাড়ির কাছে গিয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে অনেকেই তার স্বজনের নাম ধরে ডাকছিলেন।
অনেকে পুলিশের কাছে জানতে চাইছিলেন- কোন থানা থেকে এসেছে গাড়িটি। সেই গাড়িতে যারা আছেন তাদের নামও জানার চেষ্টা করছিলেন তারা। তখন গাড়ির ভেতর থেকে আসামিদের কেউ কেউ সাড়া দিচ্ছিলেন স্বজনদের ডাকে।
এসময় পুলিশ সদস্যরা স্বজনদের কোনও প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আসামিদের নিয়ে হাজতখানায় চলে যাচ্ছিলেন। বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত এমন চিত্র দেখা গেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের হাজতখানার সামনে।
পোশাক শ্রমিক রেহানার জন্য একদমই অপরিচিত পুরান ঢাকার এই আদালতপাড়া। তাই স্বামী মো. কাওছারকে নিয়ে সকাল সাড়ে ৯টা থেকে তিনি হাজতখানার সামনে বসেছিলেন পুলিশ ভ্যানের অপেক্ষায়।
কোটাবিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সহিংসতার ঘটনায় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) বিভিন্ন থানায় গতকাল বুধবার পর্যন্ত অন্তত ৭৩টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে এক হাজার সাতশ’র বেশি মানুষকে। যাদের অনেককে বৃহস্পতিবার আদালতে হাজির করা হয়।
‘ফোনে মারামারির ভিডিও পাওয়ায় ১৫ বছরের ছেলে গ্রেপ্তার’
হাজতখানার সামনে দুপুর ১২টার দিকে রেহানার সঙ্গে কথা হয় সকাল সন্ধ্যার।
কেন এখানে বসে আছেন- জানতে চাইলে রেহানা বলেন, “গতকাল আমার গার্মেন্টস খুললে ছেলেকে বাসায় রেখে ডিউটিতে যাই। ও বাসার বাইরে গেলে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়।”
রেহানা বলছেন, তাদের ছেলে আমীর হামজার ফোনে কোটা আন্দোলন ঘিরে যে সংঘর্ষ হয় তার ভিডিও পাওয়ার কথা বলে তাকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ।
রেহানা বলেন, “আদাবর থানায় গেলে তারা জানায় মামলা হয়েছে। এখন আদালত থেকে জামিন করিয়ে নিতে হবে। গতকাল থেকে ছেলেকে আমরা দেখি না। এখন ওরে কীভাবে জামিন করাব কিছু বুঝতাছি না। সবাই বলছে, পুলিশ নাকি গাড়িতে করে এখানে আনবে। আদালতে গেলে নাকি জামিন হইবো, এইজন্য এখানে বসে আছি।”
ছেলেকে কীভাবে, কোন মামলয় গ্রেপ্তার করেছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমার ছেলের নাম আমীর হামজা, বয়স ১৫ বছর। ক্লাস নাইনে (নবম শ্রেণি) পড়ে ও। আমি গার্মেন্টসে চাকরি করি। ওর বাবা রাজমিস্ত্রীর যোগালির কাজ করে। আমরা মোহাম্মদপুরে টিক্কাপাড়ার ১২ নম্বর রোডে থাকি।
“চারদিন ধইরা আমার অফিস (গার্মেন্টস) বন্ধ ছিল। আমি বাসায় ছিলাম, ছেলেকেও বাসায় ধরে রাখি। গতকাল অফিস খুলছে, আমি অফিসে যাই। ওর বাবাও কাজে যায়। ওরে ঘুমে থুইয়া গেছি। ওরে বলছি- বাবা ঘর থেকে বের হয়ো না। পুলিশ রাস্তাঘাটে ধরবো, ওরে ভয় দেখাইয়া গেছি। বাসায় থাইকো।”
তিনি বলেন, “বাসায় টিভি নাই, মোবাইল চালাতে পারে নাই। তখন মোবাইল নিয়া বাইরে বের হইছে। তখন নাকি ওকে ধইরা নিয়ে গেছে। আমি তো ডিউটি থেকে রাত ৮টায় বাসায় আইছি। পরে শুনি আমার ছেলেকে ধরে নিয়ে গেছে।
“আমরা থানায় যাইনি, আমীর হামজার বন্ধু একইসঙ্গে গ্রেপ্তার হওয়া নাইমের মা থানায় গেছিল। পুলিশ বলছে, ওদের মোবাইলে মারামারির ভিডিও পাইছে। এখন নাকি ওদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এখন আদালতে গিয়ে জামিন করাতে হবে। এইজন্য সকাল থেকে আদালতে এসে বইসা আছি। একজন উকিলের সঙ্গে কথা কইছি। হেই কইছে জামিন করাইয়া দিব।”
এ সময় কান্না জড়িত কণ্ঠে রেহানা বেগম বলেন, “আন্দোলনের সময় ছেলেকে ঘরে ধরে রাখলাম। আর আন্দোলন শ্যাষ হইলো আমার নিরপরাধ ছেলেকে ধরে নিয়ে গেল। এখন আমি কী করব? কোথায় যাব?”
হাজতখানার সামনে রেহানার মতো আক্ষেপ-আহাজারি করছিলেন উজ্জ্বল হোসেন নামে একজন। সকাল সন্ধ্যাকে তিনি জানান, তার ছোটভাই ফরহাদ হোসেন এবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। বয়স ১৬ বছর।
উজ্জ্বল বলেন, “গতকাল কম্পিউটার ক্লাসে যাওয়ার সময় শনির আখড়া বাস স্ট্যান্ড থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশ। এখন অপেক্ষা করছি থানা থেকে এখানে আনলে আমরা আদালতে গিয়ে জামিন চাইব।”
তিনি বলেন, “আমার ছোটভাইকে কেন গ্রেপ্তার করা হলো কিছুই বুঝতাছি না। এত দিন ও বাসা থেকে বের হয়নি। গতকাল পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে কম্পিউটার ক্লাস করতে বের হয়। এখন আমার প্রশ্ন কেন তাকে গ্রেপ্তার করা হলো?”
‘ছাদে ক্রিকেট খেলছিল, ধরে নিয়ে গেছে পুলিশ’
রেহানা ও উজ্জ্বলের মতো হাজতখানার সামনে অপেক্ষায় ছিলেন সাইদুল ইসলাম নামের একজন। তিনি জানান, পল্টন থানার এক মামলায় তার দুই ভাগ্নে নাসির (২০) ও রাকিবকে (১৭) গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যারা কাপ্তানবাজার এলাকার এক দোকানের কর্মচারী। তাদের গ্রামের বাড়ি ঝালকাঠির নলছিটি।
সাইদুল ইসলাম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমি থাকি মাতুয়াইলে। ওরা (ভাইগ্নারা) থাকে নয়া পল্টনের ওদের মালিকের বাসায়। দোকান বন্ধ থাকায় ছয়তলা ভবনের ছাদে ক্রিকেট খেলতেছিল ওরা। সেখান থেকে ধরে নিয়ে গেছে পুলিশ।
“ওরা কাপ্তান বাজারে ঝাড় বাতিরদোকানে কাজ করে। গত রোববার ধরে নিয়ে গেছে। পল্টন থানায় দুই দিন রাখছিল, পরে মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠিয়েছে।”
‘দিনমজুরি করেও মামলা খাইতে হইলে আমাদের মাইরা ফেলুক’
আদালতের বারান্দায় কথা হয় রোজা ইসলাম নামে এক নারীর সঙ্গে। তিনি জানান, তার স্বামী হৃদয় খানের জন্য অপেক্ষা করছেন। ২২ বছর বয়সী হৃদয় খান স্টেডিয়াম মার্কেটে এক দোকানে চাকরি করেন। গতকাল বাসা থেকে বের হয়ে দোকানে যাওয়ার পথে তাকে গ্রেপ্তার করা হয় ডেমরা থানার মামলায়। বৃহস্পতিবার তাকে আদালতে হাজির করার কথা- এটা জেনে মা রত্না বেগমকে নিয়ে আদালতের বারান্দায় অপেক্ষা করছেন।
রত্না বেগম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমার মেয়ের জামাই দিনমজুরি করে খায়। কাজের জন্য বের হইছিল। পুলিশ দেইখ্যা দৌড় দিছে, এজন্য পুলিশ ধইরা নিয়ে গেছে। দিনমজুরি করেও যদি মামলা খাইতে হইলে আমাদের মাইরা ফেলুক।”