Beta
শনিবার, ১৭ মে, ২০২৫
Beta
শনিবার, ১৭ মে, ২০২৫

বেতন নয় ভালোবাসায় ফুটবল রাঙাচ্ছেন সাধন

শৈলকুপা ফুটবল একাডেমির ফুটবলারদের সঙ্গে কোচ সাধন কুমার বিশ্বাস। ছবি: সংগৃহীত
শৈলকুপা ফুটবল একাডেমির ফুটবলারদের সঙ্গে কোচ সাধন কুমার বিশ্বাস। ছবি: সংগৃহীত
[publishpress_authors_box]

শৈশব থেকে ফুটবলের প্রেমে পড়েন সাধন কুমার বিশ্বাস। পড়ার টেবিলের চেয়ে ফুটবল মাঠ বেশি টানতো তাকে। হতে চেয়েছিলেন জাতীয় দলের ফুটবলার। কিন্তু চোট ও নানা প্রতিবন্ধকতায় লাল-সবুজের জার্সিতে খেলা হয়নি সাধনের। তবে জাতীয় পর্যায়ে না খেললেও ঢাকা ও খুলনাতে টানা সাত মৌসুম খেলেছেন মোহামেডান ব্লুজ, খুলনা আবাহনী, কসমস ক্লাব, শিপইয়ার্ড ক্লাবে।

ফুটবল ছেড়ে এক সময় জীবিকা অর্জনের জন্য চাকরি জীবনে প্রবেশ করেন সাধন কুমার। কিন্তু ফুটবল যার নেশা, তার কি ১০টা-৫টার ছকবাঁধা চাকরিতে মন টেকে? শেষ পর্যন্ত চাকরি ছেড়ে সাধন আবারও ফেরেন ফুটবল মাঠে। তবে এবার আর ফুটবলার নয়। কোচের ভূমিকায় দেখা মেলে সাধনের।

ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা উপজেলায় রয়েছে সাধনের ফুটবল একাডেমি। শৈলকুপা কলেজ মাঠে নিয়মিত চলে এই একাডেমির ফুটবলারদের অনুশীলন। প্রতিষ্ঠানটির নাম দিয়েছেন শৈলকুপা ফুটবল একাডেমি।

বর্তমানে এই একাডেমিতে ৬০ জন পুরুষ ও ২৫ জন নারী ফুটবলার অনুশীলন করেন। কিন্তু অবাক ব্যাপার হচ্ছে এই একাডেমিতে অনুশীলনের জন্য ফুটবলারদের কাছ থেকে কোনও টাকা পয়সা নেন না সাধন!

ট্রফি হাতে শৈলকুপা ফুটবল একাডেমির ফুটবলাররা। ছবি: সংগৃহীত

মনের সন্তুষ্টির জন্যই তিনি এলাকার খেলাপাগল কিছু ফুটবলারদের নিয়মিত বিনা বেতনে অনুশীলন করান। সাধন কুমার বলছিলেন সেই কথা, “আসলে ছোট বেলা থেকে আমি ফুটবলের সঙ্গে জড়িত। আর এলাকায় দীর্ঘদিন খেলার সঙ্গে থাকার সুবাদে একটা অন্যরকম পরিবেশ তৈরি হয়ে গেছে। অনেক অভিভাবক এসে বলে আমার ছেলেমেয়েকে ফুটবল খেলা শেখাও। যদি ফুটবল খেলে ওরা একটা ভালো পর্যায়ে যেতে পারে। সেই ভাবনা থেকেই সম্পূর্ণ বিনা পারিশ্রমিকে ওদের অনুশীলন করাই।”

শুধু তাই নয়, দরিদ্র পরিবার থেকে আসা এই ফুটবলারদের অনুশীলনের পরে নাস্তার টাকাও দেন নিজের পকেট থেকে!

সাধন মূলত ফুটবল একাডেমি তৈরির পরিকল্পনা শুরু করেন ২০০৯ সালে। তখন চাকরি ছেড়ে নিজের এলাকা শৈলকুপার হাবিবপুর গ্রামে একটা ফুটবল ক্লাব তৈরি করেন। এরপর ২০১০ সালে খেলোয়াড় কল্যাণ সমিতি নামের ওই ক্লাবটি স্থানীয় লোকজনের হুমকির কারণে বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন।

মাঝে বিরতি দিয়ে ২০২২ সালে আবারও নেমে পড়েন ফুটবলারদের কোচিং করাতে। এরপর গঠন করেন শৈলকুপা ফুটবল একাডেমি।

এই একাডেমির নারী ফুটবলাররা গত কয়েক বছর বিভিন্ন আঞ্চলিক টুর্নামেন্টে নিজেদের সাফল্য ধারাবাহিকভাবে দেখিয়ে চলেছেন। সাধন এই সাফল্যের কথা বেশ গর্বের সঙ্গেই বললেন, “ এই একাডেমি গড়ার পর রাজবাড়ীর কালুখালী, খোকসা ও কুষ্টিয়ার আলমডাঙ্গায় বিভিন্ন টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে শৈলকুপা ফুটবল একাডেমি।”

বিনা বেতনে এই ফুটবলারদের অনুশীলন করান কোচ সাধন বিশ্বাস। ছবি: সংগৃহীত

শুধু তাই নয় গত জানুয়ারি মাসে তারুণ্যের উৎসবে ঝিনাইদহ জেলায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছে শৈলকুপা নারী ফুটবল দল। এরপর খুলনা বিভাগে হয়েছে রানার্স আপ। এ বছর অনুষ্ঠিত প্রাথমিক বিদ্যালয় গোল্ডকাপে সারা বাংলাদেশে তৃতীয় হয়েছে দোহারো প্রাথমিক বিদ্যালয়। এই দলে খেলেছেন শৈলকুপা ফুটবল একাডেমির ৫ ফুটবলার- সমাপ্তি খাতুন, পুজা রানী, মিনতি রানী, দীপা রানী, জিনতী খাতুন।

তাছাড়া জেলা পর্যায়ে সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জিতেছেন সমাপ্তি খাতুন। টুর্নামেন্টে ৩ ম্যাচে ১২ গোল করে সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কারও জেতেন সমাপ্তি।

শৈলকুপা কলেজ মাঠটি এবড়ো খেবড়ো। ফুটবল অনুশীলনের জন্য খুবই অনুপযোগী। বিকল্প ভেন্যু না থাকায় এমন মাঠেই অনুশীলন করাতে বাধ্য হন সাধন। শৈলকুপার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে কেউ সাইকেল চালিয়ে, কেউ ভ্যানে, অটো রিকশায় চড়ে আসেন অনুশীলনে।  

এই একাডেমির জন্য তেমন সরকারি অনুদানও বরাদ্দ মেলেনা সাধনের। আক্ষেপের সুরে বলেন, “আমি স্থানীয় উপজেলা ক্রীড়া সংস্থা বা প্রশাসনের কাছ থেকে সেভাবে সহযোগিতা পাইনি। এবার মাত্র একটা বল পেয়েছি অনুশীলনের জন্য।”

শুধু তাই নয়, শৈলকুপার বড় বড় ব্যবসায়ীদের কাছে স্পনসরের জন্য গেলেও খালি হাতে ফিরতে হয়েছে অনেক সময়। যে কারণে ফুটবলারদের বুট, জার্সি, বলসহ অন্যান্য সরঞ্জাম সরবরাহ করতে অনেক সময় বেগ পেতে হয় সাধনের।

সমাপ্তি খাতুনের বাড়ি দোহারো গ্রামে। বাবা ভ্যান চালক। পরিবার থেকে সমর্থন পেলেও প্রতিবেশিরা সমাপ্তিকে অনেক সময় বাজে কথা বলে। তবুও হাল ছাড়তে চান না সমাপ্তি, “আমার এলাকার লোকজন বলে, মেয়ে মানুষ ফুটবল খেলে কি করবে? অনেক সময় অনুশীলনে আসার পথে বাজে মন্তব্য করে। কিন্তু আমি সে সব কথা না শোনার ভান করি। আমি একজন ভালো ফুটবলার হতে চাই।”

শুধু সমাপ্তি নন। এই একাডেমির সব ফুটবলারের স্বপ্ন জাতীয় দলে খেলা। নারী ফুটবল লিগে খেলা। কিন্তু শৈলকুপা থেকে ঢাকায় গিয়ে কিভাবে মেয়েরা ফুটবল খেলবে সে বিষয়ে কোনও ধারণা নেই সাধন কুমারের, “আমি চাই আমার একাডেমির মেয়েরাও নারী ফুটবল লিগে খেলুক। ওদের সেই সামর্থ্য আছে। কিন্তু জেএফএ কাপ, নারী ফুটবল লিগসহ মেয়েদের বিভিন্ন টুর্নামেন্টের বিষয়ে জেলা ক্রীড়া সংস্থা কোনও তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করে না। কবে কোন খেলা হয়ে যাচ্ছে সেটা জানতেও পারিনা।”

নিজে জাতীয় দলে খেলতে পারেননি। কিন্তু একজন সাধন কুমার স্বপ্ন দেখেন তার একাডেমির ফুটবলাররা খেলবেন বাংলাদেশ জাতীয় দলে। সেই স্বপ্নের মায়াঞ্জন চোখে মেখেই রোদ, ঝড়, বৃষ্টি  উপেক্ষা করে প্রতিদিন ফুটবল নিয়ে ছুটে আসেন মাঠে।

যদি শৈলকুপা থেকে একজন ফুটবলারও জাতীয় দলে সুযোগ পায়, সেটাই হবে সাধনের বড় প্রাপ্তি। তাইতো বিনা পারিশ্রমিকে শুধু ভালোবাসা দিয়ে ফুটবলার তৈরি করে চলেছেন সাধন।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত