ভুল চিকিৎসায় ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের এক শিক্ষার্থীর মৃত্যুর অভিযোগের জের ধরে টানা তিন দিন উত্তপ্ত ঢাকার একটি অংশ। কলেজে কলেজে সংঘর্ষ, ভাংচুর, মারপিট, হামলা চলছেই।
সবশেষ সোমবার দিনভর মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় কবি নজরুল ও সোহরাওয়ার্দী কলেজের শিক্ষার্থীরা। মারপিটে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের হাতে ছিল বিভিন্ন ধরনের লাঠি-সোটা। যা দিয়ে একে অন্যকে আক্রমণ করে তারা।
সকাল সন্ধ্যার আলোকচিত্রীর তোলা ছবিতে বেশ কয়েকজনকে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। ক্যামেরায় ধরা পড়েছে, বেধড়ক মারপিটের দৃশ্যও।
এসময় মোল্লা কলেজে ব্যাপক ভাংচুর ও লুটপাট চালানো হয়। কলেজের ভেতর থেকে কম্পিউটারের মনিটর, সিপিইউ, চেয়ার, প্রিন্টারের কাগজ, খাতা-পত্র, ট্রফি, প্রাণিবিজ্ঞান গবেষণাগারে ব্যবহৃত কঙ্কাল, বইসহ বিভিন্ন সামগ্রী লুট করা হয়।
যেখানে ঘটনার শুরু
অভিজিত হাওলাদার নামে ডিএমআরসির একাদশ শ্রেণির এক শিক্ষার্থী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার পর পুরান ঢাকার ন্যাশন্যাল মেডিকেল ইনস্টিটিউট হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ১৮ নভেম্বর মারা যায়। ভুল চিকিৎসায় তার মৃত্যু হয়েছে অভিযোগ তুলে গত ২১ নভেম্বর ডিএমআরসির শিক্ষার্থীরা ন্যাশন্যাল মেডিকেলে যায় প্রতিবাদ জানাতে।
সেদিন প্রতিবাদ জানাতে গেলে কবি নজরুল কলেজ ও সোহরাওয়ার্দী কলেজের শিক্ষার্থীসহ স্থানীয়দের হামলা শিকার হন হলে অভিযোগ তোলেন ডিএমআরসির শিক্ষার্থীরা।
এর প্রতিবাদে রবিবার ন্যাশনাল মেডিকেল ঘেরাওয়ের ‘সুপার সানডে’ কর্মসূচি দেয় মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থীরা।
পূর্বঘোষিত সেই কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে রবিবার ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ঢুকে ব্যাপক ভাংচুর চালায় তারা। একই সময়ে হামলা চালানো হয় পাশের কবি নজরুল সরকারি কলেজ ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজেও। হামলা-ভাংচুরে কলেজদুটি অনেকটাই ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়।
সুপার সানডে কর্মসূচিতে মোল্লা কলেজের পাশাপাশি আরও যোগ দেয় ধানমণ্ডি আইডিয়াল কলেজ, ঢাকা কলেজ, সরকারি বিজ্ঞান কলেজ, গিয়াস উদ্দিন ইসলামিক মডেল কলেজ, সরকারি তোলারাম কলেজ, তেজগাঁও সরকারি কলেজ, দনিয়া কলেজ, বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফ পবলিক কলেজ, সেন্ট গ্রেগরী স্কুল অ্যান্ড কলেজ, শামসুল হক খান স্কুল অ্যান্ড কলেজ, বীরশ্রষ্ঠ নূর মোহাম্মদ পাবলিক কলেজ, শেখ বোরহান উদ্দিন পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিগ্রি কলেজ ও ক্যামব্রিয়ান স্কুল অ্যান্ড কলেজ।
হামলায় নজরুল ও সোহরাওয়ার্দী কলেজের দরজা-জানালার কাচ, আসবাবপত্র, শিক্ষকদের ব্যক্তিগত গাড়ি ও অ্যাম্বুলেন্স ভাঙচুর করা হয়। নষ্ট করে দেওয়া হয় বই-খাতা-কাগজপত্র। চালানো হয় লুটপাটও।
মেগা মানডে
এই কর্মসূচির জবাবে সোমবার ‘মেগা মানডে’ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেয় কবি নজরুল ও সোহরাওয়ার্দী কলেজের শিক্ষার্থীরা।
ঘোষণা অনুযায়ী পুর ১২টার পর কবি নজরুল ও সোহরাওয়ার্দী কলেজের শিক্ষার্থীরা দলবেঁধে মোল্লা কলেজে গিয়ে হামলা চালায়। এ সময় মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ বাধে।
সোহরাওয়ার্দী ও কবি নজরুলের শিক্ষার্থীরা জানান, রবিবার তাদের ক্যাম্পাসে হামলার তদন্ত এবং এ বিষয়ে রাষ্ট্রীয় কোনও উত্তর না পাওয়ায় এবং মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের পক্ষ থেকে সমস্যার সুষ্ঠু সমাধানে কোনও উত্তর না পাওয়ায় তাদের এই কর্মসূচি। এর সঙ্গে সরকারি সাত কলেজের শিক্ষার্থীদেরও সমর্থন রয়েছে বলেও দাবি তাদের।
শুরুতে কবি নজরুল ও সোহরাওয়ার্দী কলেজের শিক্ষার্থীরা যাত্রাবাড়ীতে মোল্লা কলেজের সামনে গিয়ে প্রথমে ঢিল ছুড়তে শুরু করে। এতে কলেজ ভবনের সামনের কাচসহ জানালার কাচ ভেঙে যায়। এ সময় মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ বাধে। এক পর্যায়ে লাঠিসোটা নিয়ে মোল্লা কলেজের ভেতরে ঢুকে পড়ে কিছু শিক্ষার্থী।
শুরুতে হামলাকারী শিক্ষার্থীরা কোনও প্রতিরোধের মুখে পড়েনি। দুপুর ১টার কিছু আগে তাদের ধাওয়া দেয় মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসী। তখন সংঘর্ষ শুরু হয়।
সংঘর্ষে ওই সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। আশপাশের সড়কে তীব্র যানজট ছড়িয়ে পড়ে।
৩ শিক্ষার্থী নিহত জানিয়ে মোল্লা কলেজের বিজ্ঞপ্তি
সোহরাওয়ার্দী ও কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থীদের হামলায় নিজেদের তিনজন নিহত হওয়ার দাবি করে বিকালে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠায় মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজ কর্তৃপক্ষ।
কলেজটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশরাফ সামীর পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “ডক্টর মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজ গভীর শোক ও ক্ষোভের সঙ্গে জানাচ্ছে যে, আজ আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এক নৃশংস হামলা চালানো হয়েছে। তথাকথিত সাত কলেজ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে বহিরাগত একদল সন্ত্রাসী প্রবেশ করে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়।
“এ হামলায় তিন শিক্ষার্থী নির্মমভাবে প্রাণ হারায় এবং শতাধিক শিক্ষার্থী ও শিক্ষক আহত হয়েছেন। আহতদের মধ্যে অনেকের অবস্থা গুরুতর, যাদের মধ্যে কয়েকজনকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।”
যদিও নিহতের বিষয়টি নিশ্চিত নন বলে জানান শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা মাহবুবুর রহমান মোল্লা। তিনি বলেন, নিহতের সংখ্যা নিশ্চিত নন তিনি।
অবশ্য কলেজটির পক্ষ থেকে পরে আরেকটি বিজ্ঞপ্তি আসে। কলেজের অধ্যক্ষ মো. ওবায়দুল্লাহ নয়নের সই করা ওই বিজ্ঞপ্তিতে শিক্ষার্থী নিহতের কোনও প্রসঙ্গ নেই।
সেখানে বলা হয়, হামলায় শতাধিক শিক্ষার্থী ও শিক্ষক আহত হয়েছেন। যাদের মধ্যে অনেকের অবস্থা গুরুতর। কয়েকজনকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
এই হামলায় সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল ইনস্টিটিউট হাসপাতালের ছাত্র নামধারী ব্যক্তি জড়িত বলেও অভিযোগ করা হয় বিজ্ঞপ্তিতে।
সেখানে নৃশংস হামলা, লুটপাটের ঘটনায় ন্যায়বিচার চেয়ে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেন অধ্যক্ষ।
সংঘর্ষে কেউ মারা যায়নি, জানাল পুলিশ
মোল্লা কলেজের তিন শিক্ষার্থী মৃত্যুর দাবিকে নাকচ করে দিয়ে পুলিশ জানিয়েছে, সংঘর্ষে নিহত হওয়ার খবর সঠিক নয়। এটি অপপ্রচার।
বিকালে ঢাকা মহানগর পুলিশের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়,“সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উল্লিখিত ঘটনায় দুই জন নিহত হয়েছেন মর্মে অনেকেই অপপ্রচার চালাচ্ছেন, যা মোটেই সঠিক নয়। সংশ্লিষ্ট সকলকে এরূপ অপপ্রচার থেকে বিরত থাকার জন্য ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হলো।”
গুলিভর্তি ম্যাগাজিন চুরি : পুলিশের মামলা
পুলিশের ব্যবহৃত পিস্তলের গুলি চুরিসহ বেশ কিছু অভিযোগে ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজসহ ঢাকার বিভিন্ন কলেজের আট হাজার শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মামলা করেছে পুলিশ।
রবিবার সূত্রাপুর থানার উপপরিদর্শক এ কে এম হাসান মাহমুদুল কবীর এই মামলা করেন।
সোমবার মামলার এজাহার আদালতে এলে তা গ্রহণ করেন ঢাকার অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম জিয়াদুর রহমান। সেইসঙ্গে আগামী ২৪ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন।
শিক্ষার্থীদের শান্ত থাকতে সরকারের আহ্বান
কলেজগুলোর মধ্যে চলমান সংঘাতময় পরিস্থিতির মধ্যে দেশের শিক্ষার্থীদের কোনও ধরনের সংঘর্ষে না জড়িয়ে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছে সরকার। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ ধরনের সংঘাতের পেছনে কোনও ধরনের ইন্ধন থাকলে তা কঠোর হাতে দমন করা হবে।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, “সম্প্রতি বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যে সংঘাত-সংঘর্ষ হয়েছে, সরকার তার প্রতি নজর রাখছে। আমরা ছাত্র-ছাত্রীদের কোনও ধরনের সংঘর্ষে না জড়িয়ে শান্ত থাকার আহ্বান জানাচ্ছি।”
এ ধরনের সংঘাতের পেছনে কোনও ইন্ধন আছে কি-না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
আলোচনায় বসবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সৃষ্ট দ্বন্দ্ব নিরসনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা সোমবার রাত ১০টায় বসবেন তিন কলেজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে।
সন্ধ্যায় এ বিষয়টি সকাল সন্ধ্যাকে নিশ্চিত করেছেন সরকারি সোহরাওয়ার্দী কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. কাকলী মুখোপাধ্যায়।
তিনি বলেন, “আজ রাত ১০টায় ঢাকার বাংলামোটরের রূপায়ন টাওয়ারে একটি বৈঠকের আহ্বান করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা। তাদের একজন টেলিফোনে জানিয়েছেন, এ বৈঠকের মাধ্যমে চলমান সমস্যার সমাধান হতে পারে।
“বৈঠকে সোহরাওয়ার্দী কলেজে, কবি নজরুল কলেজ এবং সম্ভবত ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজও থাকবে।”
এর আগে চলমান দ্বন্দ্ব ও সংঘাত নিরসনে জরুরি সভা আহ্বান করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
সংগঠনের মুখ্য সংগঠক আব্দুল হান্নান মাসউদের দেওয়া ঘোষণায় বলা হয়, “দেশব্যাপী চলমান আন্তঃপ্রাতিষ্ঠানিক দ্বন্দ্ব এবং সংঘাত নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন উদ্বিগ্ন। আমরা মনে করি, চলমান অন্তর্দ্বন্দ্ব ‘২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রেরই অংশ।
“ছাত্র সমাজের ঐক্যমতে চলমান দ্বন্দ্ব নিরসন হওয়া সম্ভব। সেই লক্ষ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ভূমিকা পালনকারী, ফ্যাসিবাদ বিরোধী ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর সাথে জরুরি আলোচনা সভা আহ্বান করেছে।”
সংঘর্ষের পেছনে উসকানি দেখছেন উপদেষ্টা মাহফুজ আলম
কেবল কলেজ শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষই নয়, রিকশাচালকরা-পোশাক শ্রমিকসহ সব বিক্ষোভে চলা অস্থিরতার পেছনে উসকানি দেখছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম।
‘অনেক মিত্রই আজ হঠকারীর ভূমিকায়’ শীর্ষক ফেইসবুক পোস্টে তিনি লিখেছেন, “বাম এবং ডান মানসিকতার কতিপয় নেতৃত্ব বা ব্যক্তি গণঅভ্যুত্থানে এবং পরবর্তীতে সরকারে নিজেদের শরিকানা নিশ্চিত না করতে পেরে উন্মত্ত হয়ে গেছেন। তাদের উন্মত্ততা, বিপ্লবী জোশ এবং উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড দেশটাকে অস্থির করে রেখেছে।”
অবশ্য কারা এই হঠকারী মিত্র, তাদের নাম উল্লেখ করেননি তিনি।
তীব্র ছাত্র-গণআন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট পতন ঘটে আওয়ামী লীগ সরকারের। এরপর ৮ আগস্ট ড. ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার।
এই আন্দোলনের মূল শক্তি শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভেদ তৈরি করে ‘অভ্যুত্থানের শক্তিকে প্রতিক্রিয়াশীল’ করে তোলার উসকানি দেওয়া হচ্ছে বলেও হুঁশিয়ার করেন মাহফুজ।
তিনি বলেন, “ছাত্রদের আজ সংঘাতের মুখে ঠেলে দিয়ে হত্যার মাধ্যমে ছাত্রদের বৈধতার সঙ্কট হলে, যারা যারা লাভবান হবে, তারা সবাই এ উসকানি এবং প্রশাসনিক ব্যর্থতার সাথে জড়িত। ধীরে ধীরে আমরা সবই বলব। অথবা, আপনারা চোখ খুললেই দেখতে পাবেন।”
সরকার পরিচালনায় নিজেদের ব্যর্থতার কথা স্বীকার করে নিয়েই মাহফুজ বলেন, “আমরা শিখেছি এবং ব্যর্থতা কাটানোর চেষ্টাও করছি। আমরা আরও চেষ্টা করব সবাইকে নিয়ে এগোনোর।”