বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের আলোচিত নাম সালমান এফ রহমান এবং এস আলম পরিবারের সদস্য ও তাদের প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম তদন্তে চার সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সদস্যরা হলেন- বিএসইসির পরিচালক মোহাম্মদ আবুল হাসান, অতিরিক্ত পরিচালক নজরুল ইসলাম, সহকারী পরিচালক অমিত কুমার সাহা ও তৌহিদুল ইসলাম সাদ্দাম।
সোমবার পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) পক্ষ থেকে এই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
বিএসইসির ইন্সপেকশন, ইনকোয়ারি অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন বিভাগের পরিচালক মাহমুদুল হক স্বাক্ষরিত এক নির্দেশনায় তদন্ত কমিটিকে সালমান এফ রহমান, তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যসহ তার নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠান এবং এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম, তার স্ত্রী, মেয়ের স্বামী, আত্মীয়সহ তার নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকাণ্ডের ফলশ্রুতিতে পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট কোনও অনিয়ম হয়েছে কি না—এ বিষয়ে বিশদ অনুসন্ধান করার নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময়কার আলোচিত ও প্রভাবশালী এ দুই ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ রয়েছে।
তদন্ত কমিটি গঠন সংক্রান্ত বিএসইসির নির্দেশনায় বলা হয়, কমিটিকে ৬০ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করে কমিশনে তাদের প্রতিবেদন জমা দিতে হবে।
গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। এরপর ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। এরপর ১৩ অগাস্ট নৌ-পথে পালানোর সময় সালমান রমহান ও সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে রাজধানীর সদরঘাট থেকে গ্রেপ্তার করার কথা জানায় পুলিশ। পরে একাধিক হত্যা মামলায় তাদের গ্রেপ্তার দেখিয়ে রিমান্ডে নেওয়া হয়। এখন তারা কারাগারে আছেন।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান দেশের ব্যাংক ও পুঁজিবাজারের আলোচিত-সমালোচিত নাম। আশির দশক থেকেই দেশের শীর্ষস্থানীয় ঋণখেলাপি হিসেবে পরিচিত তিনি। ১৯৯৬ সালে পুঁজিবাজার কেলেঙ্কারিতেও তার নাম এসেছিল।
তবে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর সালমান এফ রহমানের বেক্সিমকো গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলো বিশেষ সুবিধা নিয়ে ঋণখেলাপির তালিকা থেকে নাম কাটায়। ২০১১ সালে পুঁজিবাজার কেলেঙ্কারির পর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটি নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে সালমান এফ রহমানের ভূমিকা রয়েছে বলে উল্লেখ করে।
অন্যদিকে, সরকার পতনের পর থেকে দেশে প্রকাশ্যে দেখা যায়নি চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপের সাইফুল আলমকে (এস আলম)।
শেখ হাসিনার সরকার পতনের পরপরই ব্যাংক খাতে জোরেশোরে আলোচনা শুরু হয় এস আলম গ্রুপ নিয়ে। জোরজবরদস্তি করে পর্ষদের দখল নেওয়া ইসলামী ব্যাংকসহ শরীয়াহভিত্তিক অন্য ব্যাংক থেকে এস আলমসহ এ গ্রুপের প্রতিনিধিদের সরানো হয়।
এক সময়ের দেশের শীর্ষ ব্যাংক ইসলামী ব্যাংককে ২০১৭ সালে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে মালিকানা ও ব্যবস্থাপনার নিয়ন্ত্রণ নেয় সদ্য বিদায় নেওয়া আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ এস আলম গ্রুপ। এরপর সাড়ে সাত বছরে নামে-বেনামে ব্যাংকটি থেকে প্রায় ৮৮ হাজার কোটি টাকা বের করে নিয়েছে এই ব্যবসায়ী গোষ্ঠী।
গত ৫ সেপ্টেম্বর ইসলামী ব্যাংকের নবনিযুক্ত চেয়ারম্যান ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের সঙ্গে বৈঠক শেষে বলেন, জুন শেষে ব্যাংকটির ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৭৪ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি- প্রায় ৮৮ হাজার কোটি টাকা এস আলম গ্রুপ নিয়েছে।
অন্যদিকে সরকারিসহ বিভিন্ন ব্যাংক থেকে অনিয়মের মাধ্যমে আরেক শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী বেক্সিমকো গ্রুপের ঋণ নেওয়ার খবরও সামনে আসে। এ গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমানকে সরানো হয় আইএফসি ব্যাংকের চেয়ারম্যানের পদ থেকে।
পরে সিআইডি অর্থপাচারের অভিযোগের প্রাথমিক প্রমাণের তথ্যের ভিত্তিতে এস আলম গ্রুপ ও বেক্সিমকো গ্রুপের বিরুদ্ধে পৃথক অনুসন্ধানে নামার কথা জানিয়েছে।
সালমান ও এস আলমসহ তার পরিবারের সদস্য ও স্বজনদের ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করা হয়েছে। বিভিন্ন অভিযোগে আলোচিত এ দুই ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে তদন্তে নেমেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
ওষুধ, বস্ত্র, আমদানি-রপ্তানি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, হোটেল, প্রকৌশল, সংবাদমাধ্যমসহ নানা খাতে ছড়িয়ে আছে সালমানের বেক্সিমকো গ্রুপের ব্যবসা। পুঁজিবাজারে তার প্রভাব নিয়েও নানা আলোচনা রয়েছে।
বেক্সিমকো গ্রুপের চার কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত। আরেকটি কোম্পানি বেক্সিমকো সিনথেটিকস ডিলিস্টিং হয়েছে বছর দুই আগে। বেক্সিমকো লিমিটেড ও বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত।
অন্যদিকে এস আলম গ্রুপের কোম্পানি এস আলম কোল্ড রোল্ড স্টিল লিমিটেড তালিকাভুক্ত রয়েছে।
এ দুই আলোচিত ব্যবসায়ী এবং তাদের পরিবারের সদস্য, স্বজন ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠিানের পুঁজিবাজারে ‘অনিয়ম’ খতিয়ে দেখার বিষয়ে বিএসইসির আদেশে বলা হয়, “গত ১৪ আগস্ট দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় এস আলম গ্রুপ এবং সালমান এফ রহমানের অনিয়মের বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সালমান এফ রহমান আশির দশক থেকেই শীর্ষস্থানীয় ঋণখেলাপি হিসেবে পরিচিত।
“১৯৯৬ সালে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিতে তার নাম এসেছিল। তবে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর সালমান এফ রহমানের বেক্সিমকো গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলো বিশেষ সুবিধা নিয়ে ঋণখেলাপির তালিকা থেকে নাম কাটায়। ২০১১ সালে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির পর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটি নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে সালমান এফ রহমানের ভূমিকা রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছিল।”
পত্রিকার খবরের সূত্র ধরে বিএসইসির প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, “একসময়ের দেশের শীর্ষ ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসিকে ২০১৭ সালে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে মালিকানা ও ব্যবস্থাপনার নিয়ন্ত্রণ নেয় সদ্য বিদায় নেওয়া আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ এস আলম গ্রুপ। এরপর সাড়ে সাত বছরে নামে-বেনামে ব্যাংকটি থেকে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা বের করে নিয়েছে এই ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ও এর স্বার্থসংশ্লিষ্ট রাজশাহীর নাবিল গ্রুপ। এই অর্থ ব্যাংকটির মোট ঋণের এক-তৃতীয়াংশ।”
“ঋণের যে তথ্য এখন পর্যন্ত পাওয়া গেছে, ব্যাংক থেকে পাচার করা অর্থের প্রকৃত পরিমাণ তার চেয়ে বেশি বলেই মনে করেন কর্মকর্তারা। সংবাদে অভিযোগ করা হয়েছে, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি থেকে টাকা বের করা হয়েছে এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম, তার স্ত্রী, মেয়ের স্বামী, আত্মীয়সহ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নামে।”
এমন প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বিএসইসি এই তদন্ত কমিটিকে এসব ব্যক্তি ও তাদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের কারণে পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট কোনও অনিয়ম হয়েছে কি না—তা খতিয়ে দেখতে নির্দেশ দিয়েছে।