জাহাজে করে আমদানি করা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) রূপান্তর করে সরবরাহের জন্য বঙ্গপোসাগরে যে দুটি ভাসমান টার্মিনাল আছে, তার একটি বন্ধ আছে প্রায় তিন মাস। এতে দেশে এলএনজি সরবরাহ অর্ধেকে নেমে এসেছে।
কক্সবাজারের মহেশখালীতে সমুদ্রে ভাসমান দুটি এলএনজি টার্মিনালের মধ্যে একটি যুক্তরাষ্ট্রের এক্সিলারেট এবং অন্যটি দেশের কোম্পানি সামিট ব্যবস্থাপনা করে। স্বাভাবিক অবস্থায় এক্সিলারেট ৬০০ ও সামিট ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট সরবরাহ দিয়ে থাকে।
তবে গত ২৭ মে ঘুর্ণিঝড় রেমালের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সামিটের টার্মিনলটি, সেটি মেরামতের চেষ্টা এখনও চলছে।
এ অবস্থায় দুটি টার্মিনালের যে ১১০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি সরবরাহের সক্ষমতা ছিল, তা জুনের শুরু থেকেই কমে নামে অর্ধেকে।
এতে দেশের মোট গ্যাস সরবরাহে সংকট দেখা দিয়েছে। আর তা সামাল দেওয়ার জন্য সরকারের হাতে থাকা দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে উৎপাদন খুব বেশি বাড়ানো যাচ্ছে না।
দেশে মে মাসে যেখানে দিনে ৩ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ দেওয়া হতো, এখন সেখানে মিলছে মাত্র ২৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট।
চাহিদার বিপরীতে এলএনজি না পেয়ে সরকার শিল্প কারখানা, সিএনজি স্টেশন, বিদ্যুৎ, সার উৎপাদন খাতে রেশনিং করছে। আর এই রেশনিং করতে গিয়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আবাসিক এলাকার গ্রাহকরা নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস পাচ্ছে না।
সংকট উত্তরণে সরকার বিকল্প খুঁজে না পেয়ে সামিট গ্রুপকে চিঠি দিয়ে একদিনের মধ্যে জানতে চেয়েছে কবে নাগাদ সামিটের টার্মিনালটি চালু হবে। গত ১৯ আগস্টের চিঠির জবাব বুধবার দিয়েছে সামিট গ্রুপ। সেখানে প্রতিষ্ঠানটি সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে চালুর আশ্বাস দিয়েছে।
যদিও এর আগে ১৫ আস্টের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সামিট বলেছিল সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতে তাদের টার্মিনালটি চালু করে এলএনজি সরবরাহ যুক্ত হতে পারবে।
এ বিষয়ে জানতে রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী রফিকুল ইসলামকে ফোন দিলে তিনি জুম মিটিংয়ে ব্যস্ত থাকার অজুহাতে কথা বলতে চাননি।
এরপর প্রতিষ্ঠানটির মহাব্যবস্থাপক (এলএনজি) প্রকৌশলী শাহ আলম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “চিঠির জবাব দিয়েছে সামিট। সেখানে প্রতিষ্ঠানটি বলেছে আগস্টের মধ্যেই কাজ শেষ করে সেপ্টেম্বরের শুরুতেই সরবরাহে যুক্ত হবে। এজন্য মেরামতের পর কাঙিক্ষত ভ্যাসেলটি শুক্রবার (২৩ আগস্ট) নাগাদ মহেশখালীতে পৌঁছবে। সাগর অনুকূল থাকলে কাজ শুরু হবে।”
সামিটের এলএনজি সরবরাহ বন্ধ থাকায় গত তিন মাসে অন্তত চারটি এলএনজিভর্তি কার্গো কিনে তা বাতিল করতে হয়েছে। এর ফলে পেট্রোবাংলার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। সেই ক্ষতির পরিমাণ কত এবং কীভাবে তা আদায় করা হবে জানতে চাইলে শাহ আলম বলেন, “এটি উর্ধতন কর্মকর্তারাই ভালো জানবেন।”
পরে বিষয়টি জানতে পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মাইনস) প্রকৌশলী মো. কামরুজ্জামান খানকে ফোন দিলেও সাড়া মেলেনি।
গ্যাস উত্তোলন সরবরাহে নিয়োজিত রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলার হিসাবে, দেশে দিনে ৩,৮২৯ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ দেওয়ার সক্ষমতা আছে তাদের। যদি সেই সক্ষমতা তারা কখনোই পূরণ করতে পারেনি। এই সক্ষমতার মধ্যে দেশি-বিদেশি গ্যাসক্ষেত্র থেকে ২৭২৯ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ সক্ষমতা আছে। বিপরীতে মিলছে ২০২১ মিলিয়ন ঘনফুট।
আর আমদানি করা এলএনজির সক্ষমতা আছে ১১০০ মিলিয়ন ঘনফুট। সরবরাহ দেওয়া হচ্ছিল সমপরিমাণ। কিন্তু সামিটের কারণে তিন মাস ধরে সেই সরবরাহ অর্ধেকে নেমেছে।
পেট্রোবাংলার সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, “দিনে ৩,৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা থাকলে ৩০০০-৩১০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস দিয়েই আমরা মোটামুটিভাবে সামাল দিচ্ছিলাম। এই পরিমাণ গ্যাস থাকলে আমাদের বাড়তি চাপ নিতে হয় না।
“কিন্তু সামিট সব এলোমেলো করে দিল। এখন ৫০০ মিলিয়ন গ্যাসের জন্য আমাকে শিল্প কারখানা, বিদ্যুৎ উৎপাদন, সার কারখানা এবং আবাসিক গ্রাহককে পর্যন্ত রেশনিং করতে হচ্ছে।”
গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ আজিজ খানের মালিকানাধীন সামিটের এলএনজি টার্মিনাল চালুর বিষয়টি দীর্ঘায়িত করাকে ইচ্ছাকৃত কি না, তা তদন্ত করে দেখতে বলছেন অনেক গ্রাহক। কিন্তু এ বিষয়ে সামিট করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফয়সাল খানের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
তবে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে একটি বিবৃতি দিয়ে বলা হচ্ছে, সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি নাগাদ টার্মিনালটি চালু করে এলএনজি সরবরাহ দেওয়া সম্ভব হবে।
বিবৃতিতে বলেছে, আবহাওয়া ও সমুদ্র পরিস্থিতি অনুকূল থাকলে আগস্টের শেষ নাগাদ ডিসকানেক্টেবল টারেট মুরিং (ডিটিএম) প্লাগের পুনঃস্থাপন ও পুনঃসংযোগ সম্পন্ন করবে সামিট। এরপর আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যবর্তী সময়ে জাহাজ থেকে জাহাজে স্থানান্তরের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে।
ডিটিএম হস্তান্তরে একটি শক্তিশালী ও উচ্চতর ক্ষমতাসম্পন্ন ক্রেনের জন্য সামিট ওরিয়েন্টাল ড্রাগন নামে একটি ডাইভিং সাপোর্ট ভেসেলের (ডিএসভি) সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে; যা ২২ আগস্ট সিঙ্গাপুর থেকে মহেশখালীতে পৌঁছাবে।