মৃত্যুদণ্ডের সাজা চূড়ান্ত হওয়ার আগে কাউকে কারাগারের নির্জন সেল বা কনডেম সেলে রাখা যাবে না বলে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল করেছে রাষ্ট্রপক্ষ।
মঙ্গলবার আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় এ আবেদনটি করা হয় বলে জানিয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন।
রাষ্ট্রের প্রধান এই আইন কর্মকর্তা সাংবাদিকদের বলেন, “রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আপিল করা হবে। তার আগে লিভ টু আপিল ফাইল করা হবে। এখন নির্দেশনাগুলো স্থগিত চেয়ে আবেদন করা হয়েছে। নইলে সমস্যা দেখা দিতে পারে।”
বুধবার এ বিষয়ে চেম্বার আদালতে শুনানি হবে বলেও জানান তিনি।
এর আগে সোমবার বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি মো. বজলুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ কয়েক দফা নির্দেশনাসহ পর্যবেক্ষণ দেয়।
সেদিন আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত তালুকদার। রিটাকারীদের পক্ষে ছিলেন শিশির মনির।
চূড়ান্ত নিষ্পত্তির আগে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের কনডেম সেলে রাখার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালের ২ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টে রিটটি করেন চট্টগ্রাম, সিলেট ও কুমিল্লা কারাগারের কনডেম সেলে বন্দি তিন কয়েদি– সাতকানিয়ার জিল্লুর রহমান, সুনামগঞ্জের আব্দুল বশির ও খাগড়াছড়ির শাহ আলম।
ওই বছরের ২২ সেপ্টেম্বর রিটটির শুনানি হয়। তখন রাষ্ট্রপক্ষের অনুরোধে হাইকোর্ট রুল জারি না করে কনডেম সেল ও কনডেম সেলে বন্দিদের সংখ্যা, কারাগারের সংস্কার, ব্যবস্থাপনা, কনডেম সেলের সুযোগ-সুবিধা সংক্রান্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলেন। দীর্ঘদিন পর রিটটি হাইকোর্টের আরেকটি বেঞ্চে উত্থাপন করা হয়। শুনানির পর ওই বেঞ্চ রুলসহ আদেশ দেয়।
মৃত্যুদণ্ড চূড়ান্ত হওয়ার আগে দণ্ডিতদের কনডেম সেলে বন্দি রাখা কেন আইনত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না এবং মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের কনডেম সেলে বন্দি রাখা সংক্রান্ত কারাবিধির ৯৮০ বিধিটি কেন অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয় ওই রুলে।
সেইসঙ্গে কনডেম সেলে রাখা বন্দিদের কী ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়, সে বিষয়ে কারা মহাপরিদর্শককে ছয় মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেয় আদালত। সে ধারাবাহিকতায় কারা মহাপরিদর্শকের পক্ষে আদালতে প্রতিবেদন দেওয়া হয়।
সোমবার হাইকোর্টের রায়ের নির্দেশনা ও পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে রিটকারীদের আইনজীবী মো. শিশির মনির বলেন, কোনও ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড চূড়ান্ত হওয়ার আগে তাকে মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামি বলা যাবে না এবং তাকে কনডেম সেলে রাখা যাবে না।
তিনি বলেন, মামলায় বিচার বিভাগীয় পদক্ষেপ আছে; হাইকোর্ট বিভাগ, আপিল বিভাগ ও রিভিউ এবং প্রশাসনিক পদক্ষেপ আছে; রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা আছে। এই সবকিছু নিষ্পত্তি করে যখন একজন ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ডাদেশ চূড়ান্ত হবে, কেবল তখনই একজন ব্যক্তিকে কনডেম সেলে বন্দি রাখা যাবে, এমনটাই বলেছেন আদালত।
আইনজীবী শিশির মনির বলেন, দ্বিতীয়ত আদালত বলেছেন, কোনও বন্দির যদি কোনো বিশেষ অসুবিধা থাকে, এটি হতে পারে শারীরিক কোনও অসুবিধা, সংক্রামক রোগ কিংবা কোনও যৌন সমস্যা, তাহলে তাকে আলাদা করে রাখা যাবে। এই ক্ষেত্রে জেলে থাকা ওই ব্যক্তির মতামত নিতে হবে।
রিটের শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষ আদালতকে জানিয়েছে, নতুন জেলকোড তৈরি হচ্ছে, হচ্ছে নতুন আইন ‘প্রিজন অ্যাক্ট’। হাইকোর্ট বলেছে, রায়ের পর্যবেক্ষণ যেন নতুন আইনে প্রতিফলিত হয়, সেটা বিবেচনা করতে।
রায়ে মৃত্যদণ্ডপ্রাপ্ত বন্দির বিষয়ে তথ্য চাইলে (সাংবাদিক, গবেষক) আইন অনুসারে তা দিতে কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। একইসঙ্গে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রিকেও আইন অনুসারে তথ্য দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া সুপ্রিম কোর্টের বার্ষিক রিপোর্টেও এসব আসামির তথ্য সন্নিবেশিত করতে বলা হয়েছে।
রায়ে বলা হয়েছে, “আমাদের দেশে হাইকোর্ট বিভাগে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির জামিনের দরখাস্ত শুনানি করা হয় না। বাকি আসামিদের জামিনের দরখাস্ত যেমন সহসাই শুনানি হয়, তারা জামিনও লাভ করেন। কিন্তু মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হলে তার জামিনের আবেদন আর শুনানি হয় না।”
আদালত বলেছে, অন্যান্য আসামিদের মত মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের জামিনের আবেদনও যেন শুনানি করা হয়।
সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির হত্যা মামলার ঘটনা তুলে ধরে রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, “গত ১২ বছর ধরে তদন্ত হচ্ছে, এখনও তদন্ত শেষ হচ্ছে না। বিচার তো আরও পরের স্টেজ। আমাদের দেশে ট্রায়াল স্টেজ শেষ হতেই ৫ থেকে ১০ বছর লেগে যায়। এই ধরনের বিলম্ব যেখানে হয়, সেখানে মৃত্যুদণ্ডের আসামিকে নির্জন সেলে ১৫ থেকে ২০ বছর পর্যন্ত যদি বন্দি রাখা হয়, তাহলে এটি ডাবল শাস্তি হয়।”
পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, “নির্জন কক্ষে বসবাস তার সাজা নয়, সাজা মৃত্যুদণ্ড। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টও এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ভারতের ওই রায় আমাদের রায় দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক ভূমিকা পালন করেছে।”
সেদিনই অ্যাটর্নি জেনারেল জানিয়েছিলেন, এ রায়ের বিষয়ে সরকারের সঙ্গে কথা বলে আপিলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
সেই ধারাবাহিকতায় মঙ্গলবার আপিল বিভাগে আবেদন করেছে রাষ্ট্রপক্ষ।
২০২২ সালের নভেম্বর পর্যন্ত তথ্যের ভিত্তিতে দেওয়া কারা কর্তৃপক্ষের প্রতিবেদন অনুসারে, দেশের কারাগারগুলোতে কনডেম সেল রয়েছে দুই হাজার ৬৫৭টি। এর মধ্যে পুরুষের জন্য দুই হাজার ৫১২টি ও নারীদের ১৪৫টি সেল রয়েছে। এসব সেলে মোট বন্দি আছেন দুই হাজার ১৬২ জন, যাদের মধ্যে পুরুষ বন্দি দুই হাজার ৯৯ জন ও নারী বন্দি ৬৩ জন।
সর্বোচ্চ সংখ্যক কনডেম সেল রয়েছে ঢাকা বিভাগের কারাগারগুলোতে। ঢাকা বিভাগের কারাগারগুলোতে থাকা এক হাজার ৮৪টি সেলে বন্দি আছেন এক হাজার ২৯৫ জন। সবচেয়ে কম ৫৪টি কনডেম সেল ময়মনসিংহ বিভাগে। ওই বিভাগে মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া পাঁচ আসামি আছেন কনডেম সেলে, যাদের সবাই পুরুষ।