ইরানের বিভিন্ন স্থাপনায় ইসরায়েলের হামলার ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে উভয়পক্ষকেই ‘সংযম’ দেখাতে আহ্বান জানিয়েছে বিভিন্ন দেশ।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশ মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাতের বিস্তার এড়াতে প্রজ্ঞার অনুশীলনের গুরুত্বের উপর জোর দিয়েছে।
ইরানের সাম্প্রতিক হামলার জবাবে ইসরাইলি ডিফেন্স ফোর্সেস (আইডিএফ) শনিবার খুব ভোরে ইরানের বিভিন্ন সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে প্রতিশোধমূলক হামলা চালিয়েছে।
এই ইসরায়েলি হামলায় ক্ষতি সীমিত বলার পর এবার দুজন সৈন্য মারা যাওয়ার কথা স্বীকার করেছে ইরান।
ইরান আর্মি শনিবার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, “দেশকে রক্ষা করতে গিয়ে আমাদের দুজন সৈনিক শহীদি মৃত্যু বরণ করেছেন।”
ইরানের বিমান প্রতিরক্ষা সদর দপ্তর বলেছে, “ইসরায়েলি হামলা ইরানের সমন্বিত বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে সফলভাবে প্রতিহত করা হয়েছে।”
তেহরানে হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়াহকে হত্যার পর লেবাননে ইরান সমর্থিত সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহর প্রধান হাসান নাসরাল্লাহসহ সংগঠনটির শীর্ষ নেতাদের হত্যার প্রেক্ষাপটে মাসখানেক আগে ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে প্রায় ২০০ ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছিল ইরান।
এরপর থেকেই ইসরায়েল ইরানে প্রতিশোধমূলক হামলা চালাতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছিল।
শনিবার ভোর থেকে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী ইরানের ইলাম, খুজেস্তান ও তেহরানে প্রায় ২০টি সামরিক ঘাঁটিতে হামলা করে। প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা ধরে হামলার পর তা সমাপ্তির ঘোষণাও দেয় ইসরাইল।
এই হামলার পর দুই দেশের মধ্যে চলমান উত্তেজনা আরও বেড়েছে। তবে এই বিষয়ে আর উত্তেজনা সৃষ্টি না করতে ইরানকে সতর্কও করেছে ইসরায়েল।
তবে ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, ইরান তার মাটিতে হামলার পর ‘বহিরাগত আগ্রাসী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষা করার অধিকার রাখে এবং এক্ষেত্রে বাধ্য’।
যুক্তরাষ্ট্র
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের মুখপাত্র শন স্যাভেট সাংবাদিকদের বলেছেন, “আমরা ইরানকে ইসরায়েলের ওপর হামলা বন্ধ করার আহ্বান জানাচ্ছি, যাতে যুদ্ধের এই চক্রটি আর না বেড়ে এখানেই শেষ হয়।
“তাদের (ইসরায়েল) প্রতিক্রিয়া ছিল আত্মরক্ষার একটি অনুশীলন এবং বিশেষভাবে জনবহুল এলাকা এড়িয়ে শুধু সামরিক লক্ষ্যবস্তুর উপর। তবে ইসরায়েলের সবচেয়ে জনবহুল শহর লক্ষ্য করে ইরান হামলা চালিয়েছিল।”
যুক্তরাষ্ট্র এই অভিযানে অংশ নেয়নি বলে জোর দিয়ে তিনি বলেন, “মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতা কমানো ও কূটনীতিকে ত্বরান্বিত করা আমাদের লক্ষ্য।”
হোয়াইট হাউসের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছেন, বাইডেন প্রশাসন বিশ্বাস করে, ইসরায়েল ও ইরানের পাল্টাপাল্টি সামিরক অভিযান ‘বন্ধ করা’ উচিত।
ইসরায়েল যখন ইরানে সামরিক অভিযান চালানোর বিষয়ে এগিয়েছে এবং হামলা চালিয়েছে—তখন এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে এসব বিষয়ে অবহিত করা হয়েছে বলে জানান ওই কর্মকর্তা।
সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম এক্সে এক পোস্টে পেন্টাগনের মুখপাত্র প্যাট্রিক রাইডার লিখেছেন, প্রতিরক্ষা সচিব লয়েড অস্টিন ইসরায়েলের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ইয়োভ গ্যালান্টের সঙ্গে কথা বলে ‘ইসরায়েলের নিরাপত্তা ও আত্মরক্ষার অধিকারের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অবিচল প্রতিশ্রুতির বিষয়ে পুনর্নিশ্চিত করেছেন’।
যুক্তরাজ্য
সব পক্ষকে সংযমের আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী কেইর স্টারমার বলেছেন, “ইসরায়েলি হামলার জবাবে ইরানের সাড়া দেওয়া উচিত নয় ।
“আমি স্পষ্ট যে ইসরায়েলের ইরানি হামলার বিরুদ্ধে আত্মরক্ষা করার অধিকার রয়েছে। আমি এ বিষয়েও স্পষ্ট করছি, আমাদের আরও আঞ্চলিক উত্তেজনা এড়াতে হবে এবং সব পক্ষকে সংযম দেখানোর আহ্বান জানাতে হবে।”
কমনওয়েলথ নেতাদের বৈঠকে যোগ দেওয়ার আগে তিনি এসব কথা বলেন বলে জানান দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তরের এক কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়ের পরামর্শে সংযম দেখানোর বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েছে ইসরায়েল; তা তাদের প্রতিক্রিয়ায় বোঝা যাচ্ছে।
ইরানের নেতৃবৃন্দ, পারমাণবিক ক্ষেত্র কিংবা তেল ও গ্যাসের স্থাপনাগুলোয় হামলা করেনি ইসরায়েল।
মধ্যপ্রাচ্যে এরকম কিছু ঘটলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে—এ বিষয়ে লন্ডন ও ওয়াশিংটন সতর্ক রয়েছে বলে জানান ওই কর্মকর্তা।
ফ্রান্স
ফ্রান্সের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, “এই অঞ্চলে উত্তেজনা বাড়লে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। এমন উত্তেজনা ও অভিযান থেকে বিরত থাকতে হবে।“
সৌদি আরব
ইসরায়েলি হামলার ঘটনাকে ‘ইরানের সার্বভৌমত্ব এবং আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন’ বলে উল্লেখ করে এর নিন্দা করেছে সৌদি আরব। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সব পক্ষকে ‘সর্বোচ্চ সংযম অনুশীলন এবং উত্তেজনা কমাতে‘ আহ্বান জানিয়েছে।
সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘সৌদি আরব এই অঞ্চলে অব্যাহত উত্তেজনা এবং এই অঞ্চলের দেশ ও জনগণের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলা সংঘাত যাতে না বাড়ে সেবিষয়ে তার দৃঢ় অবস্থান নিশ্চিত করছে।’
কাতার
কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, ইসরায়েলি হামলাটি ছিল ‘ইরানের সার্বভৌমত্বের স্পষ্ট লঙ্ঘন এবং আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন’।
এ ঘটনায় গভীর উদ্বেগ ব্যক্ত করে সংযম, সংলাপ ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে বিরোধ নিষ্পত্তি এবং এই অঞ্চলে নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতাকে অস্থিতিশীল করতে পারে এমন কিছু এড়াতে আহ্বান জানিয়েছে কাতার।
মধ্যপ্রাচ্যের জনগণের দুর্ভোগ, বিশেষ করে গাজা ও লেবাননে যুদ্ধ বিরতিতে প্রচেষ্টা জোরদারেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে কাতার।
মিশর
মধ্যপ্রাচ্যে নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলে এমন সব কর্মকাণ্ডের নিন্দা করেছে মিশর।
দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি বিবৃতিতে বলেছে, ” গাজা উপত্যকায় যুদ্ধবিরতি চুক্তির কাঠামোর মধ্যে দ্রুত পৌঁছানো উচিত, যার মাধ্যমে জিম্মিদের মুক্তি দেওয়া হবে; কারণ এটিই এই অঞ্চলের উত্তেজনা কমানোর একমাত্র উপায়।”
তুরস্ক
তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিবৃতিতে বলেছে, “ইসরায়েল, যারা গাজায় গণহত্যা করছে, পশ্চিম তীরকে দখলের প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং লেবাননে প্রতিদিন বেসামরিক লোকদের হত্যা করছে, এই হামলার মাধ্যমে এখন আমাদের অঞ্চলকে একটি বৃহত্তর যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে।
“এটি এখন স্পষ্ট, এই অঞ্চলে ইসরায়েলি সন্ত্রাসের অবসান ঘটানো আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ও শান্তি নিশ্চিত করার জন্য একটি ঐতিহাসিক কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবিলম্বে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “আমরা আমাদের অঞ্চলে আর কোনও যুদ্ধ, সহিংসতা বা অনাচার চাই না।”
ইরাক
ইরাকের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় মুখপাত্র বাসিম আলাওয়াদি এক বিবৃতিতে ইসরায়েলি কর্মকাণ্ডে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নীরবতার নিন্দা জানিয়েছেন।
তিনি বিবৃতিতে বলেছেন, “দখলকারী ইহুদিবাদী সত্তা তার আগ্রাসী নীতি অব্যাহত রেখেছে এবং দায়মুক্তির সঙ্গে ইরানের লক্ষ্যবস্তুসহ এই অঞ্চলে সংঘাতকে প্রসারিত করছে।”
থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ইরাক গাজা ও লেবাননে যুদ্ধবিরতি এবং এই অঞ্চলে স্থিতিশীলতাকে সমর্থন করার জন্য ব্যাপক আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টার আহ্বান জানিয়ে তার দৃঢ় অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করছে।
জর্ডান
জর্ডানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই তাদের দায়িত্ব পালন করতে হবে। উত্তেজনা কমনোর দিকে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে গাজা, পশ্চিম তীর ও লেবাননে ইসরায়েলি আগ্রাসন বন্ধ করার জন্য তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ইসরায়েলের আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন বন্ধ করতে হবে এবং অব্যাহত ইসরায়েলি হামলার বিপর্যয়কর পরিণতি থেকে এই অঞ্চলের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা রক্ষা করতে হবে।
কুয়েত
ইসরায়েলি হামলার নিন্দা করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের মাধ্যমে ইসরায়েলি দখলদার বাহিনী বিশৃঙ্খলার নীতি অনুসরণ করছে। এর মধ্যে দিয়ে তারা এই অঞ্চলের নিরাপত্তাকে বিপন্ন করছে।
হামাস
ইরানের বিরুদ্ধে ইহুদিবাদীদের আগ্রাসনের নিন্দা করেছে হামাস।
তারা বলেছে, “আমরা এই হামলাকে ইরানের সার্বভৌমত্বের একটি স্পষ্ট লঙ্ঘন এবং এই অঞ্চলের নিরাপত্তা এবং এর জনগণের নিরাপত্তাকে লক্ষ্য করে একটি হামলা বলে মনে করি। এই আগ্রাসনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রও দায়ী।”
পাকিস্তান
পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, ইসরায়েলি হামলা ইরানের সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতার বিরুদ্ধে ইসরায়েলি সামরিক হামলা জাতিসংঘের সনদ এবং আন্তর্জাতিক আইনের গুরুতর লঙ্ঘন।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এই হামলাগুলো আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার পথকে ক্ষুণ্ন করে এবং ইতিমধ্যে এই অঞ্চলকে বিপজ্জনক করে তুলেছে। ইসরায়েল এই অঞ্চলে সংঘাতের আরও বাড়িয়েছে, যা সম্পূর্ণ দায় তাদের।
মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের বেপরোয়া ও অপরাধমূলক আচরণের অবসান ঘটানোর জন্য অবিলম্বে পদক্ষেপ নিতে আহ্বান জানিয়েছে পাকিস্তান।
সংযুক্ত আরব আমিরাত
উপসাগরীয় দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে ইরানের হামলার নিন্দা জানিয়ে আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার উপর এর প্রভাবের জন্য গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
সংঘাতের বিস্তার এড়াতে সর্বোচ্চ সংযম ও প্রজ্ঞার অনুশীলনের গুরুত্বের উপর জোর দিয়েছে দেশটি।
মালয়েশিয়া
ইসরায়েলি হামলাকে আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন বলে অভিহিত করে তা আঞ্চলিক নিরাপত্তাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে বলে এক বিবৃতিতে উল্লেখ করেছে মালয়েশিয়া।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, মালয়েশিয়া অবিলম্বে শত্রুতা বন্ধ করার এবং সংঘাতের বিস্তার বন্ধের আহ্বান জানাচ্ছে।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় ইসরায়েলের ক্রমাগত আক্রমণ এই অঞ্চলকে আরও বিস্তৃত যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে বেলে মনে করে মালয়েশিয়া।