কেউ সদ্য বিয়ে করেছিলেন, কেউ ছিলেন সন্তানের অপেক্ষায়। সব বদলে যায় ৫ আগস্ট গণআন্দোলনে সরকার পতনের পর।
জুলাই মাস ধরে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলি চালিয়ে কয়েকশ মানুষ হত্যার জন্য অভিযোগের মূল তীর ছিল পুলিশের দিকে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার পর জনরোষ গিয়ে পড়ে পুলিশের ওপরই; যদিও পুলিশ সদস্যদের ভাষ্য, তারা কেবল ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশই পালন করছিলেন।
সেদিন দেশের বেশিরভাগ থানা সেদিন আক্রান্ত হয়। ভাংচুর, লুটপাটের পাশাপাশি ধরিয়ে দেওয়া হয় আগুন। কোথাও কোথাও হত্যার শিকার হন পুলিশ সদস্যরা।
১৬ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট সরকার পতনের দিন পর্যন্ত আন্দোলনে সহিংসতায় সারাদেশে অন্তত ৬৩১ জনের প্রাণহানির হিসাব করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য বলছে, এই আন্দোলন ঘিরে সহিংসতায় সারাদেশে ৪৪ জন পুলিশ সদস্য প্রাণ হারিয়েছেন।
এই পুলিশ সদস্যদের অনেকেই ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্য।
নিহত পুলিশ সদস্যদের একজন কনস্টেবল মো. মাহফুজুর রহমান। ৩ মাস আগে বিয়ে করেছিলেন তিনি।
৫ আগস্ট জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় দায়িত্বরত অবস্থায় আক্রান্ত হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান মাহফুজুর।
জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার তিলকপুর পূর্ববাজার গ্রামের সোলাইমান আলীর ছেলে মাহফুজুরের স্ত্রী হোসনে আরা হিমা বিধবা হয়ে এখন আক্কেলপুরেই নিজের বাবার বাড়িতে আছেন। স্বামী হারানোর শোক এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি তিনি।
হিমা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “সেদিন দুপুরের পর আমাকে ফোন দিয়ে বলেছিলেন, হাসিনা (শেখ হাসিনা) পালাইছে। সবখানে গণ্ডগোল হচ্ছে, বাসার সবাইকে নিয়ে সাবধানে থেক।”
এরপর নিজের মায়ের সঙ্গে কথা বলে তাকেও সাবধানে থাকতে বলে কলটি কেটে দিয়েছিলেন মাহফুজুর। এরপর তার মোবাইলে কল করে তা বন্ধ পাচ্ছিলেন হিমা।
“তার কিছুক্ষণ পর জানতে পারি আমি বিধবা হয়ে গেছি,” বলেন হিমা।
মাহফুজের চাকরির বয়স মাত্র ২ বছর ২৩ দিন। তাই কোনও পেনশন সুবিধা পাবে না পরিবার। তবে পুলিশ কল্যাণ তহবিলের ১০ লাখ টাকা পাবেন তারা। এর মধ্যে মাহফুজুরের মা পাবেন অর্ধেক, আর বাকি অর্ধেক পাবেন হিমা।
হিমা জানান, মাহফুজের লাশ বাড়িতে পাঠানোর সময় দেড় লাখ টাকা দিয়েছে পুলিশ। এরপর ৮ সেপ্টেম্বর তার হাতে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা তুলে দিয়ে যায় ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)।
প্রায় একই রকম মানসিক দুরবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন হবিগঞ্জের বানিয়াচং থানায় নিহত এসআই সন্তোষ কুমার চৌধুরীর স্ত্রী পপিতা রাণী। ৮ মাস আগেই সন্তোষের সঙ্গে তার বিয়ে হয়।
পপিতা এখন ৩ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। অনাগত সন্তান কখনোই বাবার আদর পাবে না, সেই কষ্ট বুক চেপে আছেন তিনি।
সন্তোষের ছোট ভাই লিংকন চৌধুরী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বাবা হওয়ার খবর শুনে খুব খুশি হয়েছিলেন ভাই। অনাগত সন্তানকে নিয়ে কতশত পরিকল্পনা ছিল তার। কিন্তু খুশির খবর পাওয়ার ২ মাস যেতে না যেতেই সব শেষ।”
তিনি জানান, ভাই সন্তোষ চৌধুরীর মৃত্যুর পর পেনশনের জন্য আবেদন করেছেন তারা। এর আগে মৃত্যুর ২-৩ দিন পর হবিগঞ্জের তৎকালীন পুলিশ সুপার তাদের পরিবারকে নগদ ৫০ হাজার টাকা অনুদান দিয়েছিলেন। এর বাইরে কিছু পায়নি সন্তোষের পরিবার, এমনকি বাহিনীর পক্ষ থেকেও কেউ যোগাযোগ করেনি।
কনস্টেবল মো. আবু হাসনাত রনির স্ত্রী সাবিনা আক্তার আশাও অন্তঃসত্ত্বা। ২ বছর আগে বিয়ে করেছিলেন তারা। আশা নিজেও পুলিশ কনস্টেবল।
গত বছর একটি কন্যাসন্তানের বাবা-মা হয়েছিলেন তারা। কিন্তু জন্মের ২ দিন পরই মারা যায় মেয়েটি। আশা বর্তমানে অন্তঃসত্ত্বা। আগামী নভেম্বরে সন্তানের মুখ দেখার অপেক্ষায় ছিলেন রনি, কিন্তু তার আর হলো না।
গত ৫ আগস্ট ঢাকার উত্তরা পূর্ব থানায় দায়িত্বপালনের সময় প্রাণ হারান রনি। বাড়ি তার
ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর থানার কাঁঠালডাঙ্গী ইউনিয়নের টেংরিয়া গ্রামে।
রনির বাবা মো. রফিকুল ইসলাম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “রনিকে মারধরের একপর্যায়ে হামলাকারীরা বলে, ‘মৃত্যুর আগে কারও সঙ্গে কথা কথা বলতে চাইলে ফোন দিতে পারিস।’
“তখন সে বাড়িতে ফোন দেয়। ফোনে স্ত্রীকে বলেছিল, ‘বাবু হইলে বাবুকে বইলো আমি তোমাকে আর তাকে খুব ভালোবাসি।’ পরে ওর মা ফোন নিলে বলে, ‘আমি খুব বিপদে আছি, দোয়া কইরো মা।’ এটুকু বলতেই হামলাকারীরা তার মোবাইল কেড়ে নেয়, পরে পিটিয়ে হত্যা করে আমার ছেলেকে।”
রফিকুলের দুই মেয়ে আর এক ছেলে। রনির উপার্জনের ওপরই নির্ভরশীল ছিল পুরো পরিবার। সেই ছেলেকে হারিয়ে দিশেহারা সবাই। বড় মেয়েকে আগেই বিয়ে দিয়েছেন। ছোট মেয়েটা পড়াশুনা করে। তার পড়াশোনা, পরিবারের খরচ কীভাবে চালাবেন, বুঝতে পারছেন না রফিকুল।
ছেলের চাকরির বয়স চার বছর হয়েছিল জানিয়ে তিনি বলেন, “এখন পরিবারের অবস্থা জানিয়ে আইজির কাছে আবেদন জানিয়েছি। তিনি বিষয়টি দেখার আশ্বাস দিয়েছেন।”
সেদিনের সহিংসতায় নিহত কনস্টেবল মো. সুজন মিয়ার স্ত্রী জেরিন আক্তারও ৮ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। হীরামণি নামে তাদের ১৮ মাস বয়সী আরেকটি মেয়ে আছে।
বাবার মৃত্যুর পর থেকে মেয়েটি বাবা আসবে কখন, বাবা কোথায় গেছে, বাবা আসে না কেন, এমন প্রশ্ন করছে সবাইকে।
কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলার চাঁনপুর ইউনিয়নের গোপালপুর গ্রামের মো. বাছির মিয়ার ছেলে সুজন মিয়া।
সরকার পতনের দিন ঢাকার উত্তরা-পূর্ব থানায় দায়িত্বরত ছিলেন সুজন। থানায় হামলা হলে তিনি তিনতলা ভবনটির ছাদে চলে যান। একপর্যায়ে জীবন বাঁচানোর জন্য ছাদ থেকে লাফ দেন। নিচে পড়ে ভেঙে যায় তার দুটি পা-ই। তারপরও রেহাই পাননি, পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল তাকে।
সুজনের বোন ময়না খাতুন বলেন, “ভাইকে হারিয়ে বৃদ্ধ বাবা-মা একেবারে অসহায় হয়ে পড়েছেন। সুজনের স্ত্রী-সন্তানের পাশাপাশি যেন বাবা-মার বিষয়টিও একটু দেখা হয়, সেই অনুরোধ রইলো আমার।”
ঢাকার শ্যামপুর থানার সামনে ৫ আগস্ট আন্দোলনকারীদের হামলায় মাথায় গুরুতর আঘাত পান কনস্টেবল খলিলুর রহমান তালুকদার। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৪ আগস্ট মারা যান তিনি।
টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার দেওপাড়া ইউনিয়নের তালতলা গ্রামের মো. আফাজ উদ্দিন তালুকদারের ছেলে খলিল। তার ছেলে বেসরকারি ইউনাইটেড বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ম বর্ষের শিক্ষার্থী, মেয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে।
স্বামীকে হারানোর পর দুই সন্তান নিয়ে আকুল পাথারে পড়েছেন আফরোজা খাতুন লিপি। তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, হামলার পর থেকেই অজ্ঞান ছিলেন খলিলুর। তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছিল। তাই স্বামীর সঙ্গে শেষ কথাটুকুও হয়নি।
স্বামীর মৃত্যুর পর সন্তানদের পড়াশোনা নিয়ে যে দুশ্চিন্তায় পড়েন আফরোজা, পুলিশ প্রধানের কাছ থেকে পাওয়া আশ্বাসে কিছূটা চিন্তামুক্ত হয়েছেন তিনি।
“আগামী বৃহস্পতিবার আইজি স্যার আমাদের ডেকেছেন। তিনি বলেছিলেন নিহতদের পরিবারে যোগ্য কোনও সদস্য থাকলে তাকে চাকরি দেওয়া হবে।”
কী কী সুবিধা পাবে নিহতের পরিবার
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (ওয়েলফেয়ার) মো. নাজমুল ইসলাম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “কর্তব্যরত অবস্থায় কোনও পুলিশ সদস্য মারা গেলে নিয়ম অনুযায়ী তার পরিবার যেসব সুবিধা পেয়ে থাকেন, আন্দোলনের সময় নিহত পুলিশ সদস্যদের পরিবারও সেসব সুবিধা পাবেন।”
তিনি জানান, নিহত পুলিশ সদস্যের পরিবার বাংলাদেশ পুলিশের পক্ষ থেকে ১০ লাখ টাকা অনুদান পাবে। এর মধ্যে ২ লাখ টাকা নগদ পাবে তারা, আর বাকি ৮ লাখ টাকা দেওয়া হবে এফডিআর হিসেবে।
এছাড়াও যেকোনও সরকারি চাকরিজীবীই চাকরিকালীন সময়ে মারা গেলে ৮ লাখ টাকা অনুদান পায় তার পরিবার। পুলিশ সদস্যদের পরিবারও সেই অনুদান পাবে।
এছাড়া পুলিশ কল্যাণ তহবিল থেকে পরিবার নিরাপত্তা প্রকল্পের অধীন ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা করে পাবে। প্রতিমাসে কিস্তি হিসিবে ১৫ বছরে এই টাকা পাবে তারা। পরিবার নিরাপত্তা প্রকল্পের অধীনে র্যাংক অনুযায়ী এককালীন ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা অনুদান পাবে পরিবারগুলো।
নিহতদের দাফন কিংবা সৎকারের জন্য প্রয়োজনীয় খরচও দেওয়া হয় পুলিশের পক্ষ থেকে। এছাড়াও নির্দিষ্ট নিয়ম অনুযায়ী পেনশন ও রেশন সুবিধা পাবে নিহতের পরিবার।